অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য তাঁকে নিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরছেন পুলিশকর্মীরা। একের পর এক হাসপাতাল ফিরিয়ে দিচ্ছে নানা অজুহাতে। টানা পাঁচ ঘণ্টা ধরে হাসপাতালে-হাসপাতালে ঘোরার পরে শেষ পর্যন্ত ওই মুমূর্ষু ব্যক্তিকে ভর্তি করতে পারেন পুলিশকর্মীরা।
রবিবার রাতের ঘটনা। পুলিশ জানায়, হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে একটি বেসরকারি বাসে উঠেছিলেন বছর পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। রাত পৌনে ন’টা নাগাদ অন্য একটি বাসের সঙ্গে রেষারেষির জেরে তিনি হাওড়া ব্রিজের উপরে বাস থেকে পড়ে যান বলে ঘটনাস্থলে থাকা ট্রাফিক পুলিশ জানিয়েছে। পরে ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মীই খবর দেন উত্তর বন্দর থানায়। থানা থেকে ব্যবস্থা করা হয় কলকাতা পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্সের। পুলিশ জানায়, সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকা ওই ব্যক্তির মাথায় গুরুতর চোট ছিল। সঙ্গে ছিল একটি ব্যাগ। ব্যাগটিতে থাকা কাগজপত্র থেকে জানা যায়, ওই প্রৌঢ়ের নাম রমেশচন্দ্র আরূপ। তিনি এজরা স্ট্রিটের বাসিন্দা।
অ্যাম্বুল্যান্সে প্রথমে রমেশবাবুকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা পুলিশকে বলেন, রমেশবাবুর ‘আরও ভাল চিকিৎসা’ দরকার। তাঁকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। অ্যাম্বুল্যান্সে ছিলেন উত্তর বন্দর থানার অফিসার সুভাষ বণিক। তিনি রমেশবাবুকে নিয়ে যান এসএসকেএমে। অভিযোগ, সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা পুলিশকে জানান, ‘জায়গা নেই’। পুলিশ জানায়, জখম ওই ব্যক্তিকে এ বার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা।
পুলিশ জানায়, রমেশবাবুকে এর পরে শম্ভুনাথ পণ্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের অভিযোগ, সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, মাথায় গুরুতর চোট পাওয়া রমেশবাবুর যে ধরনের চিকিৎসা দরকার, তেমন পরিকাঠামো ওই হাসপাতালে নেই।
লালবাজারের এক পুলিশকর্তা জানান, ততক্ষণে রাত পৌনে ১২টা বেজে গিয়েছে। থানার অফিসারের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে পৌঁছে যান উত্তর বন্দর থানার ওসি কিশোরকুমার শর্মা। ইতিমধ্যে রমেশবাবুর ব্যাগ থেকে তাঁর ‘ইএসআই’ কার্ড পাওয়া যায়। ওসি ফের অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে রমেশবাবুকে নিয়ে যান শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালে। পুলিশের অভিযোগ, সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, চিকিৎসার পরিকাঠামো না-থাকায় সেখানে রমেশবাবুর ঠাঁই হবে না।
উত্তর বন্দর থানা সূত্রের খবর, এ ভাবে নানা হাসপাতালে ঘুরতে থাকায় রমেশবাবুর অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে না-পারলে যে তাঁকে বাঁচানো যাবে না, তা চিকিৎসকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন পুলিশ অফিসারেরা। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। পুলিশ ইএসআই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানায়, ‘ইএসআই কার্ড’ থাকা ওই ব্যক্তির দায়িত্ব তাঁদের নিতেই হবে। না হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ বাধ্য হবে। কর্তৃপক্ষকে এ-ও বলা হয়, পুলিশের লোকবল রয়েছে। রয়েছে অ্যাম্বুল্যান্সও। কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার জন্য ওই ব্যক্তিকে যেখানে নিয়ে যেতে বলবেন, পুলিশ সেখানেই নিয়ে যাবে। এর পরে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা রমেশবাবুকে পাঠান মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালে।
কিন্তু সেখানেও ‘পরিকাঠামো না-থাকায়’ রমেশবাবুর চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া হয়নি বলে পুলিশের অভিযোগ। পুলিশ জানায়, মানিকতলার হাসপাতাল রমেশবাবুকে বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে (সেখানে ইএসআই-এর আওতায় থাকা ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে) পাঠায়। সেখানে রাত সওয়া দুটো নাগাদ রমেশবাবুকে ভর্তি করায় পুলিশ।
বছর দুয়েক আগে দুর্ঘটনাগ্রস্ত এক প্রৌঢ়াকে সঙ্গে নিয়ে সারা রাত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে হন্যে হয়ে ঘুরে শেষ পর্যন্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করাতে পেরেছিলেন কলকাতা পুলিশের এক সাব-ইনস্পেক্টর। এ ক্ষেত্রেও কার্যত একই ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশের অভিযোগ।
কেন গুরুতর আহতকে ফিরিয়ে দিল সরকারি হাসপাতাল? স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের কথায়, “সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ রয়েছে, কোনও ইমার্জেন্সি কেস এলে রোগীকে প্রাথমিক পরিষেবা দিতেই হবে। অবস্থা জটিল হলে ভর্তি করতে হবে।” তাঁর বক্তব্য, “ওই পরিষেবা না-পেয়ে থাকলে আহতের বাড়ির লোক সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য দফতরে লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। আমরা তদন্ত অবশ্যই করব।” |