এ এক অন্যরকম স্কুল। কোনও ফি নেই। উল্টে পাঠক্রম শেষ হলে ছাত্রছাত্রীরাই মাসোহারা পাবে। ব্যতিক্রমী এই স্কুল কেবলমাত্র প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য। স্কুলে শেখানো হবে হাতের কাজ। যে কোনও বয়সের প্রতিবন্ধীরাই এই স্কুলে হাতের কাজ শিখতে পারবে। কোনও প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্কুল নয়। মধ্য ত্রিশের এক শিক্ষক এবং কয়েকজন প্রতিবন্ধী কিশোর কিশোরীর চেষ্টায় আগামী বৃহস্পতিবার স্কুলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। স্কুলের নাম স্বপ্নতোরণ। ২০০৭ সালে স্কুল শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে কয়েকজন মূক ও বধির ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বপ্নতোরণ নামে একটি সংস্থা শুরু করেন জলপাইগুড়ির সেনপাড়ার বাসিন্দা দেবাশিস চক্রবর্তী। মূক ও বধিরদের সঙ্গে ইশারায় কথা আদানপ্রদান করার প্রশিক্ষণ নেন দেবাশিসবাবু। ইশারার মাধ্যমেই শুরু হয় মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের ঘর সাজানো বা হাতের কাজ তৈরির তালিম। শহরের বিভিন্ন পুজো মন্ডপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেলায় হাতের কাজের সম্ভার বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নামে ব্যাঙ্ক আকাউন্ট তৈরি করে জমানো শুরু হয়। দেবাশিসবাবুর সেনপাড়ার দু’কামরার ঘরেই চলতে থাকে স্বপ্নতোরণের কাজকর্ম। স্বপ্নতোরণের সকলেরই নিজস্ব আকাউন্ট রয়েছে। বিভিন্ন মেলা থেকে যে আয় হয় সেই টাকার একটি অংশ সংস্থার তহবিলে রেখে বাকি টাকা সকলের আক্যাউন্টে প্রতি মাসে দেওয়া হয়। কোনও মাসে মেলা না হলে সংস্থার তহবিল থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মাসোহারা দেওয়া হয়। |
দেবাশিসবাবু জানান, স্বপ্নতোরণের মূল লক্ষ্য প্রতিবন্ধীদের স্বনির্ভর করা। আর প্রতি মাসে ন্যূনতম হলেও কিছু একটা রোজগার হওয়ায় সকলেরই উৎসাহ বাড়ে। ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দুটি ঘিঞ্জি ঘরে আর কুলোনো সম্ভব হচ্ছিল না। প্রশাসনের কাছে জমি চেয়েও উত্তর পাননি দেবাশিসবাবু। অবশেষে বিভিন্ন মেলায় হাতের কাজ বিক্রি করে জমানো ৯০ হাজার টাকা দিয়ে এক শুভানুধ্যায়ীর থেকে গত বছর সেনপাড়ার ভাটাখানা এলাকায় তিনকাঠা জমি কেনে স্বপ্নতোরণ। স্বপ্নতোরণের কথা শুনে এগিয়ে আসেন জলপাইগুড়ির বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা। বিধায়ক তহবিল থেকে চার লক্ষ টাকা অনুদান পেয়ে তিনটি ঘরের একটি পাকা স্কুলবাড়ি তৈরি হয়েছে। দেবাশিসবাবু বলেন, “বহু আবেদন নিবেদন করেও বিশেষ কোনও সাহায্য প্রথমে পাইনি। প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের তৈরি হাতের কাজের বিভিন্ন জিনিস বিক্রির জমানো টাকা দিয়ে জমি কিনি। তারপরে বিধায়ক তহবিল থেকে টাকা পেয়ে অবশেষে স্বপ্নতোরণের মাথায় পাকা ছাদ তৈরি হয়েছে।” সোমবার নব নির্মিত স্কুল বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল উদ্বোধনের আয়োজনে ব্যস্ত রিঙ্কি, পম্পি, আবেয়া, মুন্নারা। কেউ দেওয়ালে রং করছে, কেউ বা ঘরের ভেতর কাগজের ভেতরে ফুল সাজাতে ব্যস্ত। স্কুলে ঢোকার মুখে মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করছে রাজু, মুন্নারা। সকলেই মূক ও বধির। দেবাশিসবাবু বললেন, “সকলকে মোবাইল ব্যবহার করতে শিখিয়েছি। ওরা সবাই এসএমএস করতে পারে। ওরাই সকলের কাছে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিচ্ছে। উদ্বোধনের দিন সব্বাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানাই।” জলপাইগুড়ির বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা বলেন, “গত বছর একবার সেনপাড়ায় স্বপ্নতোরণে গিয়েছিলাম। দেখলাম দেবাশিসবাবু নিজের ছোট ঘরে স্কুল চালাচ্ছেন। মূক ও বধির কিশোর কিশোরীদের তৈরি হাতের কাজ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একটি ভাল কাজে যুক্ত হতে পেরে, আমারও ভাল লেগেছে।” |