প্রবন্ধ ২...
সমাজের মনটা কিন্তু গণতান্ত্রিক হওয়া চাই
“যতক্ষণ না আপনি দেশকে ভালোবাসবেন এবং দেশের লোকের সঙ্গে এক জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার মুখ থেকে দেশের নিন্দা আমি এক বর্ণও সহ্য করতে পারব না।... সংশোধন ঢের পরের কথা। সংশোধনের চেয়েও বড়ো কথা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। আগে আমরা এক হব তা হলেই সংশোধন ভিতর থেকে আপনিই হবে।... আগে আত্মীয় হবেন তার পর সংশোধক হবেন নইলে আপনার মুখের ভালো কথাতেও আমাদের অনিষ্ট হবে।”
গোরা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গত কয়েক দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ও দলের বেশ কিছু কার্যকলাপ ও মন্তব্য নিয়ে যে দুনিয়াটা আমাদের আশেপাশে আর যেটা সহজেই নিজেদের বা মিডিয়ার চোখে পড়ে, সেখানে বেশ ঝড় উঠেছে। এবং সঙ্গত কারণেই উঠেছে। সত্যি সত্যি এমন কিছু ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে যাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এই ধরনের হস্তক্ষেপের সমর্থনে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁদের মধ্যে যেমন এক দিকে যেমন কেবল দলীয় বা ব্যক্তিগত আনুগত্যের জায়গায় দাঁড়ানো নেতা আছেন, তেমনি আবার স্তালিন অনুগামী নেতাও আছেন, যাঁদের আদর্শে মতপ্রকাশের অধিকার কখনওই স্বীকৃত হয়নি।


এই মুহূর্তে অন্তত কলকাতায় ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলতে আর জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণে দলের বাধার কথা বোঝাচ্ছে না। গত জমানার সমর্থকরা পরিবর্তন আনায় উৎসাহীদের বলছেন, ‘কী, বলেছিলাম না?’ এই মুহূর্তে খানিকটা ব্যাকফুটে খেলা সেই সাধারণ মানুষ, যাঁরা মমতাকে ক্ষমতায় আনতে চেয়েছিলেন, কেউ কেউ একটু ভাবছেনও, সত্যিই কি এত বড় একটা ভুল হয়ে গেল?
যদি তৃণমূলকে ক্ষমতায় আনা ‘ভুল’ হয়েও থাকে তবে সেই ভুলের দায়িত্ব কে নেবে? নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, কেশপুর গড়বেতায় ঘটনার পর ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা এই রাজ্যের মানুষ? না সেই কাণ্ডগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকা শাসক ও তাঁদের অনুগামীরা? গত ভোটে যদি ‘মন্দের ভাল’ বলে এক নতুন শক্তিকে বেছে নেওয়া হয়ে থাকে তবে আমাদের মনে রাখা দরকার কত দূর মন্দ ছিল আগের অবস্থা, যার জন্যে মানুষ বাধ্য হয়েছিল বিকল্প বাছতে। যদি এই বিকল্প না আসত, যত ভুলভ্রান্তি, অন্যায়, সব কিছু সমেতই, আজকে কি আরও ভাল হত পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রের চেহারা? যদি আমরা মনেও করি যে আগের শাসক দল এর চেয়ে ভাল ছিল, তবে বামপন্থার সেই বিখ্যাত ‘আত্মসমালোচনার মধ্যে দিয়ে আত্মশুদ্ধি’র আদর্শ কোথায় ছিল? কেন প্রোমোটার রাজ, জমি দখল, বেআইনি ব্যবসার শাহেনশাদের দলের মধ্যেও আলাদা করতে দরকার হল ভরাডুবির? সেই ভরাডুবি ঘটানোটা কি তবে ভুল হয়েছিল? আজও কি নানান জেলায় সেই নেতারাই দলীয় পদ নিয়ে ওত পেতে বসে নেই? ক্ষমতায় ফিরে এলেই তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সরকারটার দখল নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তারে ব্যস্ত হবেন না কি?

২০০৬ সালে যে রাজনৈতিক দলের প্রায় কোনও অস্তিত্বই ছিল না, ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১১তে এসে সেই দল এক বিশাল জয় লাভ করল। দলের কেন্দ্রের কাছে জড়ো হয়ে ওঠা শক্তির গোষ্ঠীগুলোকে যদি আমরা খতিয়ে দেখি তবে দেখব, এক দল মানুষ আছেন যাঁরা গোড়া থেকেই মমতার সঙ্গে ছিলেন, আর এক দল যাঁরা ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে অন্য বড় দল ছেড়ে এসে জুটেছেন, তৃতীয় এক ধরনের মানুষ যাঁরা নানা রকমের বামপন্থী বা মানবতাবাদী বা সমাজ-মঙ্গলে উৎসাহী মানুষ, নানান আন্দোলনে ছিলেন, নানান রাজনীতি বা মুক্তচিন্তার আবহ থেকে পরিবর্তনে উৎসাহী হয়েছিলেন।
পরিবর্তনের পক্ষে যাঁরা ভোট দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যেও নানান ধরনের মানুষ ছিলেন। এক দল মানুষ ছিলেন যাঁরা গ্রামে দলীয় অপশাসনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরিবর্তন চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন বদল হলে ভাল হবে। দলীয় অপশাসনের অভিজ্ঞতা এঁদের জীবনে আঘাত হানছিল। এর বাইরে বড় শহরে, বা মূলত কলকাতায় (কারণ বাকি শহরগুলোতে আগেকার শাসক দলগুলির খবরদারি যথেষ্টই ছিল) এক দল মানুষ ছিলেন, যাঁদের এই অপশাসনের বোধটা ছিল মূলত একটা বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়ের ধারণার থেকে তৈরি। তাপসী মালিক তো আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে ছিল না, বা ওই রকম অত্যাচার এই শহরে আমরা অনেকেই নিজেদের শরীরে ভোগ করিনি, কিন্তু তার মতো আরও অনেকের ওপর আঘাত আমাদের চেতনায় আঘাত করেছিল।
মনে রাখা দরকার, সেই সময়টায় পশ্চিম বাংলায় শাসক দলের প্রত্যক্ষ আঘাতের আওতায় থাকা আর সেই বলয়ের বাইরে থাকা গণতান্ত্রিক মানুষদের মধ্যে একটা মূল্যবান গণতান্ত্রিক ঐক্য তৈরি হতে পেরেছিল। এই বোধ কিন্তু অনেকটাই নানান সাংস্কৃতিক অভ্যাস বা জীবনচর্চা পেরিয়ে তৈরি হয়েছিল, যার মূলে ছিল একটা বৃহত্তর গণতান্ত্রিক অধিকারের বোধ। সেই বোধ সিঙ্গুরে জমির অধিকার, নন্দীগ্রামে সিদ্ধান্তের অধিকার আবার রিজওয়ানুরের ক্ষেত্রে প্রেমের অধিকার পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়েছিল। এই বোধই ছিল পরিবর্তন নিয়ে আসার পিছনের শক্তি। কিন্তু আজ এই ঐক্যে একটা বিপজ্জনক ফাটল ধরছে, যে ফাটল কিন্তু তৃণমূল বা সি পি এমকে বেছে নেওয়ার চেয়েও বড় গণতান্ত্রিক বোধ, একমাত্র যে বোধ সব জমানাতেই মানুষের অধিকারগুলোকে রক্ষা করতে পারে, তাকে দুর্বল করে তুলছে, সেই নিয়ে বোধ হয় একটু ভাবা দরকার।

আমাদের চেনা রাজনীতিতে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাগের ধারণাটা বহুপ্রচলিত। সাংস্কৃতিক শ্রেণিবিভাগ নিয়ে চর্চা আমরা কম করি, বা সেটাকে স্বীকারও হয়তো তেমন ভাবে করি না। করা দরকার। কারণ ক্রমশ এক ধরনের সাংস্কৃতিক শ্রেণিবিভাগ রাজনৈতিক গোষ্ঠী নির্মাণের ক্ষেত্রেও বেশি বেশি করে ব্যবহৃত হচ্ছে। আজ এই মুহূর্তটিতে পশ্চিমবঙ্গের শাসকের আসনে আছেন এমন এক জন মানুষ যিনি বিধানবাবু, প্রফুল্লবাবু, জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুদের আসনে এসে বসলেও ‘বাবু’ নন। আবার আমাদের রাজনীতিতে আসা মহিলাদের সাংস্কৃতিক হাবভাব পোশাক-আসাকের হিসেবে তিনি ‘বিবি’ও নন। খুব সচেতন ভাবেই তিনি তা হতেও চান না। জাতপাতের হিসেবে যিনি যাদব বা দলিত, এই ধরনের নিম্নবর্গীয় সামাজিক গোষ্ঠীর মানুষও নন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক আত্মপরিচয় নির্মাণে ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’ এই প্রায় সহজাত বৈশিষ্ট্যটি খুবই স্পষ্ট। এ কথা অস্বীকার করে বোধ হয় লাভ নেই যে এই রাজ্যের দীর্ঘ বাম রাজনীতিতেও সাংস্কৃতিক ভাবে বাবুরাই ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছেন। বর্তমান শাসকের সাংস্কৃতিক কৌলীন্য নিয়ে কেবল বিরোধী বামরাই ব্যঙ্গ করেছেন তা নয়, এই নিয়ে একটা অস্বস্তি তাঁর বুদ্ধিজীবী সমর্থকদের মধ্যে ছিল। অকুলীন হিসেবে তাঁকে নিয়ে নানান কুৎসিত মন্তব্য আমরা শুনেছি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানান বিষয়ে মন্তব্য, স্থানীয় হাউসিং সোসাইটির ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে অতি উৎসাহী সমর্থকদের অসভ্যতা ও তার সরকারি সমর্থন, সরকারি লাইব্রেরিতে খবর কাগজ নির্বাচনের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের নিন্দা নিশ্চয় দরকার। যে ভাবে রিজওয়ানুর কাণ্ডের নিন্দা, নন্দীগ্রামের নিন্দা, সিঙ্গুরের নিন্দা হয়েছিল সেই ভাবেই দরকার। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এই নিন্দার ভাষাটা কী হবে? ক্ষমতাকে আঘাত করতে গিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোন অগণতান্ত্রিক বোধগুলোকে সামনে নিয়ে আসব? গত কয়েক দিন টেলিভিশনে বা মধ্যবিত্ত সমাজের ঘরোয়া আলোচনায় বার বার যে ভাবে মমতার ‘শিক্ষা’ আর ‘মনন’-এর অভাবকে তাঁর অসহিষ্ণুতার জন্যে দায়ী করা হচ্ছে, তাতে মধ্যবিত্ত আর উচ্চমার্গীয় অহং ছাড়া কিছুই দেখছি না। যদি ধরেও নিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘স্বৈরাচারী’, কবে আমরা দেখেছি যে স্বৈরাচারীরা অশিক্ষিত হয়? কবে দেখেছি তাদের তথাকথিত মননের অভাব থাকে? ইতিহাস তো সে কথা বলে না। আমরা তো দেখেছি এমনকী ফাসিস্তরা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন, হাই আর্টের ভক্ত ছিলেন। তা হলে আমাদের এই ‘মনন’ আর ‘শিক্ষা’র গর্বের গণতান্ত্রিক ভিত্তি কী?

নাগরিক বুদ্ধিজীবী সমাজ যদি মনে করেন, কার্টুন বা ধর্ষণের ঘটনায় সমাজের সকল স্তরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ভুল করছেন। আমি বলব বরং ‘রাত দুটোয় একটি মেয়ের পার্ক স্ট্রিটে মজা লুটতে যাওয়ার কী দরকার ছিল’, বা ‘শিক্ষক পড়াশোনা করাবেন, তাঁর কার্টুন আঁকার কী দরকার’ এই জাতীয় ‘কমন সেন্স’ ভিত্তিক প্রতিক্রিয়ার উৎস আমাদের সমাজের অনেক গভীরে। ২০১১-র পরিবর্তনের জন্য জরুরি ঐক্যকে এই বিভাজনগুলো পেরিয়ে তৈরি হতে হয়েছিল। বুদ্ধিজীবীরা যত শিক্ষার অভাব বা মননের অভাবের নিন্দা করবেন, সমাজের ভেতরে ভেতরে এই অগণতান্ত্রিক বোধগুলো তত দৃঢতর হবে, জঙ্গি হবে। সংখ্যার হিসেবে শক্তিশালী হবে। মনে রাখা দরকার, আমাদের এই দেশের নানান রাজ্যে আমরা এক একটি জমানার সাফল্যের কারণ হিসেবে কিন্তু এই আত্মপরিচয় নির্মাণের কার্যকারিতার প্রমাণ পেয়েছি। বহু সফল শাসক অর্থনৈতিক প্রকল্প তৈরি করতে না পেরেও, সত্যিকারের উন্নয়ন বা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি না করেও কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ আত্মপরিচয় তৈরি করেও ক্ষমতায় টিকে গেছেন। সমাজের মঙ্গলের জন্য জরুরি অন্যান্য প্রশ্নগুলো সামনে আসতে পারেনি।
কাজেই আমাদের অগণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতা যদি ২০০৭-০৮ থেকে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ঐক্যটাকে বিপন্ন করে তোলে, সেটা বাংলার পক্ষে ভাল হবে না। ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক পথে রাখতে হলে সমাজে সব সময় গণতান্ত্রিক বোধের চাষ করে যেতে হয়, নতুন নতুন ভাবে। কাজেই যদি আমরা বলতে চাই যে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’র পাশাপাশি ‘আমার সন্তান যেন নাচে মাঝ রাতে’ বা ‘আমি যেন কার্টুন আাঁকি নিজ হাতে’ এই দাবিগুলো স্বীকৃত না হলে গণতন্ত্র হয় না, তবে নিজেদের অহংগুলোকেও প্রশ্ন করতে হবে। মানুষকে দূরে ঠেলে, ছোট করে রাজনীতি হয় না। কাজেই আমাদের অগণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতা যদি ২০০৭-০৮ থেকে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ঐক্যটাকে বিপন্ন করে তোলে, সেটা বাংলার পক্ষে ভাল হবে না। এই কথাটা কোনও দলীয় স্বার্থের কথা নয়। ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক পথে রাখতে হলে সমাজে সব সময় গণতান্ত্রিক বোধের চাষ করে যেতে হয়, নতুন নতুন ভাবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.