‘দ্য রিপাব্লিক’ বলেছিল, বিচক্ষণ গণনায়কের কর্তব্য, রঙ্গরঙিন জল্পনার জোগানদারদেরই
রাষ্ট্র থেকে পাকাপাকি বহিষ্কার করা। তবে, সমস্যা কেবল, বাঁধন উৎকট রকমের আঁটো হলে,
ফস্কা গেরোর উৎপত্তির সম্ভাবনাও বাড়ে। লিখছেন
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় |
শিকারমত্ত রাজার সহচর হয়ে নাজেহাল অবস্থা মাধব্যের। একে দারুণ গরম, তায় ছায়াবিহীন বনে দাপাদাপি করে ফিরছেন রাজ্যের মৃগয়াপাগল কর্তা। পশুসংহারে বাছবিচার নেই তাঁর, নেই নিজের কিংবা অন্যের অবসর নিয়ে কণামাত্র ভাবনা। কখনও ছুটছেন তিনি স্বভাবমৃদু হরিণের পিছনে, কখনও ধাতগোঁয়ার শুয়োরের, কখনও-বা হিংস্রকুটিল বাঘের। অগত্যা, প্রভুর রক্তমাতম থেকে সাময়িক রেহাই পেতে অভিনয়কলার আশ্রয় নেয় গাঁটে-গাঁটে ব্যথাকাতর মাধব্য হাত-পা-ভাঙা বিকলাঙ্গের ভান ধরে সে। অনুচরের (সাজানো) দুর্গতি দেখে রাজা তো হেসে খুন। শুধোন তাকে, তোমার এ দশা হল কোত্থেকে? জ্ঞানপাপী আত্মসেবীর নেহাত এ আলঙ্কারিক প্রশ্নের জবাবে যা বলে শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত বুদ্ধিজীবী, তাতে, আজও, বর্তমানের রসরুচি-বিড়ম্বিত যুগেও মেলে লোকটির পোশাকি পেশার প্রমাণ। কেননা, মাধব্য কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্ নাটকের বিদূষক মাধব্য জানিয়েছিল তার নিধনপ্রমোদরত পৃষ্ঠপোষক দুষ্মন্তকে: কোত্থেকে আবার কী! নিজেই চোখে খোঁচা মেরে, ফের শুধোচ্ছেন, কেন চোখের জল পড়ছে! উত্তরটা কিন্তু ধাঁধালো ঠেকেছিল দুষ্মন্তের। ক্ষমতাপন্নের সহজাত বধিরতা অথবা সাজা বোকামির চতুরতা, যা-ই থাকুক শাসকের নাবুঝপনার মূলে, মাধব্য তবু থামে না। বরং তার বিদূষণটিকে রূপকছলে বেশ খোলসাই করে দেয়। বলে সে: বেতগাছ যে দেখতে কুঁজোর মতন তার কারণ নদীর বেগপ্রহার। অর্থাৎ কিনা, রাজকাজছুট দুষ্মন্তের বন্য হনন-আমোদই বাধ্য করেছে মাধব্যকে বিকলাঙ্গের আত্মব্যঙ্গে নামতে। মন্দের ভাল, এ বক্রভাষণে খুব কিছু কুপিত হন না কালিদাসের নৃপতি। |
হরবোলা ভাঁড়। দি ইন্ডিয়ান পাঞ্চ, ১৮৭৪ |
অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্-এর দুইয়ের অঙ্কে মাধব্য-পরিবেশিত অঙ্গবিকৃতির কৌতুকে যদি চটে উঠতেন দুষ্মন্ত, সটান চালান দিতেন তাকে রাজকারাগারে, তা হলে কি নাটকের ছয়ের অঙ্কে ওই একই ব্যক্তির কণ্ঠ থেকে শুনতে পেতেন তিনি বয়স্যোচিত এ গুরুপরামর্শ: ‘(সাবধান, মহারাজ!) শোকের অধীন হবেন না প্রবল ঝড়তুফানেও পর্বত নিষ্কম্পই থাকে’। মাধব্য-মাফিক রাষ্ট্রশির রাজন্যদের সভাসদ ভাঁড়েরা নিজেদের যারা প্রায়শই ‘মাটির ঢেলার মতো জড়বুদ্ধি’ বলে বিজ্ঞাপিত করে অন্যদের বেশি-চালাক ভাবার লীলাপ্রসঙ্গ সৃষ্টি করে যে আদৌ ‘ফুল’ বা ‘নির্বোধ’ নয়, ধারণ করলেও সমালোচকের পরিধান আসলে যে তারা তাদের মনিবদেরই শুভাকাঙ্ক্ষী, তার বিস্তর নজির মজুত আছে বিশ্বসাহিত্যে।
তবে, রাজহিতৈষী হাসিকেরও যে ধৈর্যের সীমা আছে, তার নিদর্শনও বড় কম নেই সাহিত্যে। শ্লেষশিল্পী পার্ষদ যখন হাড়ে হাড়ে অনুভব করে তার চটপটে চটুলতায় মসনদ-আসীনের গাম্ভীর্যহানির আর কোনও সম্ভাবনা নেই, তখনই বোঝে সে, আয়েসের দিন তার ফুরোল বলে। আজ হতে ঠিক পঁয়ষট্টি বছর আগে বৈশাখ ১৩২৯-এ লিখিত, লিপিকা-অন্তর্গত রবীন্দ্রনাথের প্যারবল ‘বিদূষক’-এর নামচরিত্রটি যেমন। কর্ণাটবিজয়ের পর, উৎফুল্ল কাঞ্চীর রাজা বলেশ্বরীর মন্দির বলির রক্তে ভাসিয়েই ক্ষান্ত হন না। অভিযান-অন্তে দেশে ফিরছেন, হঠাৎই নজরে আসে তাঁর, এক গ্রামে ছেলেছোকরারা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে এবং জয়পরাজয়ের ছদ্ম-মামলায় কাঞ্চীকে নয়, কর্ণাটকে জিতিয়ে ছাড়ছে কুদৃশ্যটি চাক্ষুষ করে তো মেজাজ তাঁর সপ্তমে। প্রথম অভিযোগের নথি দায়ের হয় কি হয় না, ক্রুদ্ধ, অবমানিত প্রজানাথের মর্জির তরিবতে সান্ত্রিসেপাই-লাঠিসোটা-সড়কিবল্লম নিয়ে মাঠে নামে সেনাপতি। সবার দফা রফা করে বেলাশেষে রাজসমীপে নিবেদন করে শান্তিরক্ষক: ‘মহারাজ, শৃগাল-কুকুর ছাড়া এ গ্রামে কারও মুখে শব্দ শুনতে পাবেন না’। রাজ-ইচ্ছাই আইন এবং সে আইন ক্ষমাহীন, ভয়ংকর এ খবরটি কানে যেতেই, কাঞ্চী অধিপতির সেবক-বিদূষক বলে সবিনয়ে: ‘আমি মারতেও পারি নে, কাটতেও পারি নে, বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব’। কর্ণাটজয়ের ভৈরব-রভসে ডগমগ, দিশহুঁশজ্ঞানহীন কাঞ্চীপতির সভা ছেড়ে পথে এসে দাঁড়ায় বিদূষক।
বিনোদন যাদের সহজধর্ম, তারা যে আবার স্বেচ্ছা-নির্বাসনও নিতে পারে, এবং ওই স্বেচ্ছার অপসরণ যে রাষ্ট্রিক ব্যাকরণে অন্বয়-বিপর্যাসের মতোই সঙ্গীন ব্যাপার, এ-বিষয়ে অনেক তাত্ত্বিকই পূর্ণমাত্রায় অবহিত। এ-ব্যাপারে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো নামাঙ্কিত ‘দ্য রিপাব্লিক’ এক রকমের আদর্শস্থল। সে-বইয়ের দশের পরিচ্ছেদে, নিখাদ সোনার দেশের চালক হতে অভিলাষীদের জ্ঞাতার্থে, উৎকলিত আছে সতর্কবাণী: শিল্প জিনিসটির সঙ্গেই মানবমনের কুশ্রী বিশ্রী অঙ্গের নিগূঢ় যোগ আছে; নান্দনিকতায় যা ফুর্তি পায় তা হল যুক্তিখেলাপি রগুড়েপনা; শিল্পীকে ও সেই সুবাদে বটকেরা করার হীন প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া আর সমাজের নিকৃষ্ট নীচ অংশের, হীনজনদের হস্তে রাজনৈতিক ক্ষমতা সোপর্দ করা তুল্যমূল্য ঘটনা; অতএব, যুক্তির থই খুইয়ে মানুষজীবন যাতে বেকার-বেকার মাটি না যায় তা সুনিশ্চিত করতে, বিচক্ষণ গণনায়কের কর্তব্য, রঙ্গরঙিন জল্পনার জোগানদারদেরই রাষ্ট্রএলাকা থেকে পাকাপাকি বহিষ্কার করা।
সমস্যা কেবল, বাঁধন উৎকট রকমের আঁটো হলে, ফস্কা গেরোর উৎপত্তির সম্ভাবনাও বাড়ে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলার চমৎকার এক নমুনা মিলবে কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ। বিভিন্ন পুঁথি-পাণ্ডুলিপি-টীকা খতিয়ে বেশ কিছু প্রথিতযশা পণ্ডিত-সম্পাদক রায় দিয়েছেন, ভারতীয় ওই ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’-এর গ্রন্থে নট-নর্তক-কথক-গায়ক-বাদক-কুহক প্রভৃতি কুশীলবদের জন্য অপ্রত্যাশিত এক বিধান আছে। সন্দেহ নেই, নাচিয়ে-বাজিয়েদের মোটমাট উপদ্রবই জ্ঞান করতেন কৌটিল্য। নইলে কেনই বা তাঁদের বসবাস, চলাচল সম্বন্ধে ‘অর্থশাস্ত্র’-এ কড়া কড়া অতগুলি বিধি বলবৎ আছে! সংবরণের নানা রাশ সত্ত্বেও সেখানে কিন্তু কুশীলবদের পেশকারির বস্তুবিষয় নিয়ে বাধাবন্ধের কোনও অনুদেশ নেই।
বরং রয়েছে, নিঃসংকোচ প্রকাশের খোলামেলা প্ররোচনা। কারণ, ‘অর্থশাস্ত্র’-এর ‘কন্টকশোধন’ ভাগে এক জায়গায় বলা হয়েছে: লাগলে প্রাণে তেমন দোল, কুশীলবগণ তাদের নিমন্ত্রকদের আঞ্চলিক, পারিবারিক বা জাতপাতগত আচার-ব্যাভার তথা ব্যক্তিক প্রেমআশনাই নিয়ে যথেচ্ছ ঠাট্টাতামাশা চালাতে পারে, কোনও বারণ নেই। ধরে নিতে মানা নেই, প্রথাগত সংস্কার বা মাতব্বরদের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে বাঁকা চোখের প্রতিবেদনে অতিরঞ্জনের ছোঁয়া লাগবেই। শিল্পে ব্যুৎপন্ন বিদ্বজ্জনদের তরফ থেকে চাঁইচুড়োদের আক্রমণের ঢালাও ফরমাশ আছে ‘অর্থশাস্ত্র’-এ, এ মতটি আবার পরোক্ষত সমর্থিত কৌটিল্য-কথিত আর এক ধারায়। নির্দেশ আছে সেখানে: কথক-নট-গায়কের মানহানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
(গল্পকার-ছড়াকার প্রভৃতির কণ্ঠরোধ অপ্রয়োজনীয়, এই পঠনের বিপরীতধারার সম্পাদক-অনুবাদকদের স্মরণে রেখেও) আমরা যদি কুশীলবদের দেওয়া বেহদ্দ বজ্জাতির ছাড়পত্রটিকে গ্রহণ করি, তা হলে বোধহয় রাষ্ট্রকৌটিল্যের আলোচনার রাস্তা আরও চওড়া হয়। মানতেই হয় তখন, কল্পনার কারিগরদের সামলাবার প্রচেষ্টায় প্লেটোর তুলনায় অনেক বেশি বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন কৌটিল্য। লোকমান্যদের সর্বসমক্ষে হেয়-খেলো করার উদার অনুমতি না রইলে কি আর রসিকতার ধারালো কাঁটাকে ভোঁতা ভদ্রতায় শোধিত-নমিত করা যায়? অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস যদি নেপথ্য-নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রতিবাদ স্বতঃই প্রশমিত, তাতে তো কায়েমি ব্যবস্থারই লাভ।
মুশকিল শুধু, প্রতিষ্ঠিতদের নিয়ে হাসাহাসির মামলায় জোরাজুরির চেয়ে শিথিলতা ঢের কার্যকর, এ-কথাটি উপলব্ধি করার মতো ধ্বক অধিকাংশ প্রাগাধুনিক সরকার যেমন, তেমনই অনেকানেক আধুনিক সরকারও অর্জন করে উঠতে পারেননি। এই অনুপলব্ধি কর্তৃপক্ষের মজ্জাগত দুর্বলতার পরিচায়ক যেমন, তেমনই ব্যঙ্গরসের অপরাজেয় সফলতার। আর ঠিক সে-জন্যই, (যেন-বা, প্লেটো-বিবরিত কমিক প্রণোদনায় নিম্নতম মানবিক প্রবৃত্তির উত্থানের কেচ্ছা-জেরেই), পেলেই কোনও বিদ্রূপময় প্লে বা কার্টুন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘অশ্লীলতা’র ধুয়ো তোলেন ক্ষমতার অছিবৃন্দ। কেবল-যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকেরাই যাবতীয় মশকরায় যৌনগন্ধের মিশেল খুঁজে বাজে হয়রান হয়েছেন, তা নয়। হয়েছেন এমনকী, জনস্বত্ত্বে সমাসীন, উদার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত শাসকগোষ্ঠীও। আধুনিক যুগে, এই বায়ুরোগে যেমন বিশীর্ণ বিদীর্ণ হয়েছে হিটলারের নাতসিবাহিনী, স্তালিনের শিল্পবিষয়ক পরিচালকমণ্ডলী, তেমনই হয়েছে তথাকথিত মতস্বাধীন ‘লিবারেল’ ভারত। এ-কালের বাংলায় তো তখ্ত-সুখের আচ্ছন্নতায় নামমাত্র কটাক্ষকে নামঞ্জুর করার ব্যগ্রতায় হাস্যকর পালটা-উত্তর নির্মাণের উদাহরণ রাশি রাশি আছে।
তবে, নিছক ‘মুকুল’ নামসাদৃশ্য সম্বল করে, কচিকাঁচাদের চিত্তবিনোদন উদ্দেশে বানানো সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছবির ক’টি উদ্ধৃতি সহকারে তৈরি অতি-পরিচিত ও প্রচারিত ব্যঙ্গচিত্র ঘিরে গোয়েন্দাগিরির যে ক্ষিপ্র প্রহসনটি সম্প্রতি উপস্থাপিত হল, তা বোধহয় বেনজির। এর পর, ঘোষিত বদলের প্রহরে কোনও বিদূষক যদি জরুরি অবস্থার সংকেত দেখে শঙ্কিত হয়, হাসিমজা-নিষিদ্ধ আপৎকালের নিরবচ্ছিন্ন অনবসরতায় প্রবেশ করল ভেবে জীবনানন্দের ‘অবসরের গান’ কবিতার কথকের মতো ঘোষণা করে, ‘জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্খানে পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ’, তা হলে কি তাকে খুব দোষ দেওয়া যায়?
|
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা’য় সংস্কৃতিবিদ্যার শিক্ষক |