জাতীয় সন্ত্রাসদমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) নিয়ে আসন্ন বৈঠকে যে কী ঝড় উঠতে পারে, তা আজই হাড়েহাড়ে টের পেলেন মনমোহন-চিদম্বরমরা। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে আজকের সম্মেলন কার্যত মনমোহন-সরকারের সঙ্গে অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের সংঘাতের মঞ্চ হয়ে উঠল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আক্রমণে নেতৃত্ব দিলেন নরেন্দ্র মোদী, জয়ললিতা এবং নবীন পট্টনায়ক। পিছিয়ে থাকেননি নীতীশ কুমার, মানিক সরকারও। ফলে যেখানে আলোচনার বিষয় ছিল ‘সন্ত্রাসবাদ বনাম সরকার’, তা হয়ে দাঁড়াল ‘কেন্দ্রীয় সরকার বনাম রাজ্য সরকার’-এ।
আজ মুখ্যমন্ত্রী-সম্মেলনের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা প্রায় একমত যে, ৫ মে এনসিটিসি নিয়ে বৈঠকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় প্রবলতর হবে। এবং সেই বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও থাকার কথা। এ দিনই নবীন, নীতীশ, মানিকরা এনসিটিসি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়েননি। নবীন প্রশ্ন তুলেছেন, এনসিটিসি নিয়ে বৈঠক ডাকতে এত দেরি হল কেন?
নীতীশের প্রশ্ন, প্রথমেই মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক না করে কেন মার্চ মাসে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে বৈঠক হয়েছিল! কেন্দ্রের পক্ষে একমাত্র স্বস্তি, উত্তরপ্রদেশের নতুন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব আজ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তেমন কড়া মনোভাব নিতে চাননি। এনসিটিসি নিয়েও অবস্থান খোলসা করেননি। তবে তাতে দুশ্চিন্তা কাটছে না। বরং পরের বৈঠকে আরও কড়া আক্রমণেরই আশঙ্কা করছেন মনমোহন-চিদম্বরম। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বা বাকি সব মুখ্যমন্ত্রীর তরফে তো বলাই হয়েছে, এনসিটিসি নিয়ে যা বলার, ৫ তারিখই সবিস্তার বলা হবে।
কেন্দ্র বনাম রাজ্য সংঘাতের মূল প্রশ্ন ছিল এনসিটিসি-কে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে। এক ডজন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এতে আপত্তি তোলেন। মমতা, মোদী, জয়ললিতার দাবি মেনেই এ বিষয়ে মে-তে পৃথক বৈঠক ডাকা হয়েছে। বিতর্ক এড়াতে আজ সম্মেলনের শুরুতেই সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন মনমোহন। চিদম্বরম ওই প্রসঙ্গেই যাননি। তাতেও বিতর্ক এড়ানো যায়নি। এনসিটিসি-র মতোই বিএসএফ এবং আরপিএফ আইনের সংশোধন করেও রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন জয়ললিতা, মোদী, মানিকবাবুরা। বিএসএফ আইনে প্রস্তাবিত সংশোধনের বিরোধিতা করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তরফেও। কড়া ভাষায় মোদী যুক্তি দিয়েছেন, “কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। কেন্দ্র রাজ্যের মধ্যে পৃথক রাজ্য তৈরি করতে চাইছে।” রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না করে কেন্দ্রের ‘একতরফা ভাবে এগোনোর’ মনোভাবেরও সমালোচনা করেছেন মোদী ও জয়ললিতা। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ তোলেন, সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে সম্মান দেখাচ্ছে না কেন্দ্র। রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের উপর আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল করে তুলে ‘গৌরবান্বিত পুরসভা’-য় পরিণত করা হচ্ছে।
এমনিতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে জয়ললিতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভাল। গুজরাতে মোদীর সদ্ভাবনা মিশনে যোগ দিতে জয়ললিতা তাঁর দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে পাঠিয়েছিলেন। আবার তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে জয়ললিতার সঙ্গে চিদম্বরমের বিরোধও সুবিদিত। লোকসভা নির্বাচনে চিদম্বরমের জয় নিয়েই প্রশ্ন তুলে মামলা করেছে এডিএমকে। আজ সেই ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এবং বিদ্বেষেরও যেন প্রতিফলন দেখা গিয়েছে বিজ্ঞান ভবনের সম্মেলনে। মোদীর সঙ্গে জুটি বেঁধে কার্যত একই ভাষায় চিদম্বরমের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে আক্রমণ করেছেন জয়ললিতা। অনুঘটকের কাজ করেছেন নবীন। সঙ্গত করে গিয়েছেন নীতীশ, মানিক ও বিজেপির অন্য মুখ্যমন্ত্রীরা।
রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে আজ বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে ইউপিএ-সরকারের বিরুদ্ধে সরব হবেন, মনমোহন সিংহ বা পি চিদম্বরমের তা অজানা ছিল না। আঞ্চলিক দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের এই ক্ষোভকে যে বিজেপি কাজে লাগাতে চাইবে, তা-ও তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্য সম্মেলনের শুরুতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মন জয়ের চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মাওবাদী সমস্যা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র ও রাজ্যের একত্রে কাজ করার ডাক দেন প্রধানমন্ত্রী। চিদম্বরম বলেন, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় কেন্দ্র ও রাজ্যের সংস্থাগুলি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। তাঁর বক্তব্য, “২০১১ সালে ১৮টি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। ৫৩ জন গ্রেফতার হয়েছেন। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই তিনটি গোষ্ঠীকে নিষ্ক্রিয় করে ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর অর্ধেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ প্রচেষ্টায় সাফল্য এসেছে। এটাই বাস্তব।” রাজ্যগুলির তরফে যখন অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্র সাংবিধানিক গণ্ডি অতিক্রম কররে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করতে চাইছে, তখন চিদম্বরম মুখ্যমন্ত্রীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টায় বলেন, “সংবিধানের গণ্ডির মধ্যে থেকে একসঙ্গে কাজ করে দেশকে আরও সুরক্ষিত করতে পারব।” কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কেন্দ্রকে প্রবল অস্বস্তিতে ফেলতে মোদী ইউপিএ-সরকারের সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিংহর সংঘাতের প্রসঙ্গ তোলেন। তাঁর যুক্তি, দেশের নিরাপত্তায় এর কুপ্রভাব পড়বে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়টি প্রতিরক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সেনাপ্রধানের চিঠিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যে ফাঁকফোকরের ছবি তুলে ধরা হয়েছিল, তা উসকে দিয়ে মোদী বলেন, “এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, কেন্দ্র আমজনতার মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বাস জোগাতে ব্যর্থ হয়েছে।” সিবিআইয়ের রাজনীতিকরণের প্রসঙ্গও তোলেন মোদী। সম্মেলনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যে ‘অ্যাজেন্ডা নোট’ তৈরি করেছিল, তাতে বলা হয়েছিল, গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানের জন্য যে ‘মাল্টি-এজেন্সি সেন্টার’ বা ম্যাক তৈরি হয়েছে, সেখানে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলিই ৯৭ শতাংশ তথ্য জোগান দিচ্ছে। সব রাজ্য মিলিয়ে আসছে বাকি তিন ভাগ। মোদী প্রশ্ন তুলেছেন, কোথা থেকে এই হিসেব মিলল, তা খতিয়ে দেখতে কমিটি তৈরি করা হোক। এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশেরও দাবি তুলেছেন তিনি। |