একই পরিবারের পাঁচ জনের দগ্ধ দেহ উদ্ধার
য়েক বছর আগে চারু মার্কেটের একটি বাড়ি থেকে একই পরিবারের সাত জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। তদন্তে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জেনেছিল, ওই ঘটনার পিছনে কোনও ব্যবসায়িক বিবাদ থাকতে পারে। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়নি।
এ বার রিজেন্ট পার্কের ফ্ল্যাট থেকে মিলল একই পরিবারের পাঁচ জনের অগ্নিদগ্ধ দেহ। পুড়ে মৃত্যু হয়েছে বাড়ির পোষা একটি কুকুরেরও। রবিবার গভীর রাতে দেহগুলি উদ্ধারের পরে সোমবার রাত পর্যন্ত এর কারণ সম্পর্কে কূলকিনারাই করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনাস্থলে একটি রক্তমাখা মুগুর পাওয়ার পরে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। রক্ত লেগে ছিল একটি বিছানাতেও। দেহগুলি ময়না-তদন্তে পাঠানো হয়েছে। চলছে ফরেন্সিক তদন্তও।
বিছানার যেখানে ছিল রক্তের চিহ্ন, তা ঢাকা দেওয়া ছিল বালিশ দিয়ে। সেই বালিশে আগুনের চিহ্নমাত্র ছিল না। অথচ, দক্ষিণ কলকাতার রিজেন্ট পার্কের ওই ফ্ল্যাট থেকে একই পরিবারের যে পাঁচটি মৃতদেহ রবিবার বেশি রাতে উদ্ধার করেছে পুলিশ, সবগুলিই ছিল গুরুতর অগ্নিদগ্ধ। যে ঘরে ছিল দেহগুলি, সেখানকার আসবাবও সর্ম্পূণ পোড়েনি। কী ভাবে? এই প্রশ্নগুলিরই উত্তর খুঁজছে কলকাতার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।
রিজেন্ট পার্কের বসু বাড়ি।
পুলিশ জানিয়েছে, রিজেন্ট পার্কের ৪৫ই/১৫এ ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের চারতলা একটি বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে যাঁদের দেহ উদ্ধার হয়েছে, তাঁদের নাম সুদেশ বসু (৭৫), তাঁর ছেলে সুপ্রতিম (৪৮), পুত্রবধূ সঙ্গীতা (৪৫) এবং সুদেশবাবুর দুই নাতনি সারণি ওরফে মুন (১৮) এবং সহেলি ওরফে জুন (১৪)। রাতেই এমআর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁদের মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
তা হলে কি পরিবারের অন্যদের খুন করার পরে আত্মঘাতী হয়েছেন সুপ্রতিমবাবু? তাই যদি হয়, তা হলে কি খুন করার পরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেহগুলিতে? পুলিশ জেনেছে, ওই রাতে দক্ষিণ কলকাতার একটি রেস্তোরাঁয় খেয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে ছিল বসু পরিবার। তবে কি বাড়ি ফেরার পরে বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল পরিবারের সদস্যদের? তা না হলে মৃত্যুর আগে অবশ্যই প্রাণে বাঁচতে চরম বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেন সুপ্রতিমবাবুর স্ত্রী কিংবা মেয়েরা, মত অভিজ্ঞ পুলিশকর্তাদের। যদিও সেই বাধার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলেনি ঘর জুড়ে। আসবাবপত্র ঠিকঠাক ছিল, বিছানার চাদরেও কোনও ভাঁজ ছিল না। এমনকী, ফ্ল্যাটের অন্য আবাসিকেরাও বসু পরিবারের ঘর থেকে কোনও চিৎকারের শব্দ পাননি।
একমাত্র জীবিত ‘সদস্য’ মারফিন নামের এই পোষা কুকুরটি।
ওই বাড়িতে ছিল দু’টি কুকুর। তার একটি বেঁচেছে, অন্যটির মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে। প্রাণে বাঁচতে সেই কুকুরটিরও ছোটাছুটির কোনও প্রমাণ পাননি তদন্তকারী অফিসারেরা। তা হলে কী ভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটল? সোমবার রাত পর্যন্ত পুলিশ সেই অন্ধকারেই। তদন্তে আলো খুঁজতে মৃতদেহগুলি ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ফরেন্সিক দলও ইতিমধ্যেই ওই ফ্ল্যাট থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। জরুরি ভিত্তিতে সেই রিপোর্ট দিতে বলেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তকারী অফিসারেরা মনে করছেন, ওই রিপোর্ট খানিকটা হলেও রহস্যের জাল কাটাতে সাহায্য করবে।
পুলিশ জানায়, ওই ফ্ল্যাটে চারটি ঘর। দু’টি শোয়ার, একটি খাওয়ার ও অন্যটি বসার ঘর। চারটি দেহ পড়ে ছিল বারান্দা লাগোয়া শোয়ার ঘরের মেঝেতে। কেবল সঙ্গীতাদেবীর দেহটি ছিল ওই ঘরেরই ডিভানের উপরে। তাঁরই মাথায় মিলেছে আঘাতের চিহ্ন। ওই ঘরটি সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে ঘরের এক দিকের জানলার কাচ। যে কুকুরটি বেঁচে গিয়েছে, সেটি ঘটনার সময়ে ভয়ে বাথরুমে ঢুকে ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানিয়েছে পুলিশ। অন্য একটি শোয়ার ঘর (সুপ্রতিমবাবু ও সঙ্গীতাদেবী ওই ঘরে ঘুমোতেন) থেকে মিলেছে মুগুরের মতো দেখতে কাঠের একটি জিনিস। তাতে রক্তের দাগ আছে। পুলিশের প্রশ্ন, ওই মুগুর দিয়েই কি সঙ্গীতাদেবীর মাথায় আঘাত করা হয়েছিল?
ধোঁয়াশা যেখানে
মুগুরে রক্তের দাগ কেন?

সুপ্রতিমবাবুর বিছানায় কার রক্তের দাগ?

অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগে কোনও বিষক্রিয়া হয়েছিল কি?

ক’টি গাড়িতে নৈশভোজে গিয়েছিলেন বসু বাড়ির লোকজন?

বাড়ি ফেরার পরে কি ঝগড়া হয়েছিল স্বামী-স্ত্রীর?

অন্য ঘর থাকলেও সকলে একই ঘরে শুয়েছিলেন কেন?

আগুন লাগার পরেও কেউ পালানোর চেষ্টা করেননি কেন?
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাত দেড়টা-দু’টো নাগাদ ওই ফ্ল্যাটের জানলা ভাঙার শব্দ শোনা যায়। দেখা যায়, বারান্দা লাগোয়া ঘর থেকে ঘন কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বাসিন্দারাই খবর দেন দমকল ও পুলিশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে দমকল। তার পরে পুলিশ দরজা ভেঙে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢোকে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জেনেছে, ঘটনার সময়ে শোয়ার ঘরে এসি চলছিল। তা থেকে কোনও ভাবে আগুন লেগেছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কম্পিউটারের ব্যবসা ছিল সুপ্রতিমবাবুর। স্ত্রী-ও ছিলেন ওই ব্যবসার অংশীদার। পুলিশ জেনেছে, এক শ্যালিকা ও ভায়রাভাইয়ের সঙ্গে স্টিলের আসবাবের ব্যবসাতেও যুক্ত ছিলেন সুপ্রতিমবাবু। শেয়ারেও তিনি টাকা খাটাতেন বলে স্থানীয় সূত্রে জেনেছে পুলিশ। তাঁদের বড় মেয়ে সারণি দক্ষিণ কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে এ বছর দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। ছোট মেয়ে সহেলি ছিল ওই স্কুলেরই নবম শ্রেণির ছাত্রী। সুপ্রতিমবাবুর বাবা সুদেশ বসু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। ১২ বছর আগে ম্যুর অ্যাভিনিউয়েরই অন্য একটি ফ্ল্যাট থেকে এই ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন সুপ্রতিমবাবু। পুরনো ফ্ল্যাটে থেকে যান তাঁর বাবা-মা। বছর দেড়েক আগে সুপ্রতিমবাবুর মা মারা গেলে বেশ কিছু দিন পুরনো ফ্ল্যাটেই ছিলেন সুদেশবাবু। শেষে পাকাপাকি ভাবে গত অক্টোবরে ওই ফ্ল্যাট বিক্রি করে বাবাকে এই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন সুপ্রতিমবাবু।
পুলিশ জানিয়েছে, রবিবার সন্ধ্যায় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে করে দক্ষিণ কলকাতার একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন সুপ্রতিমবাবু। তবে সুপ্রতিমবাবু ও সঙ্গীতাদেবী একই গাড়িতে গিয়েছিলেন, না কি আলাদা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন (তাঁদের দু’টি গাড়ি রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ) তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে পুলিশ। কোন গাড়িতে মেয়েরা ছিল, তা-ও স্পষ্ট জানা যায়নি। পুলিশ জেনেছে, রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ ফেরেন সুপ্রতিমবাবু। পৌনে ১০টা নাগাদ মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ফেরেন সঙ্গীতাদেবী। পুলিশ জানতে পেরেছে, যে ঘরে মৃতদেহগুলি পড়ে ছিল গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে বসেই টিভি দেখছিলেন সুদেশবাবু।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, সঙ্গীতাদেবীর মৃতদেহ যে ডিভানের উপরে পড়ে ছিল, রাতে দুই নাতনিকে নিয়ে সেখানেই ঘুমোতেন সুদেশবাবু।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার রাতে ওই এক ঘরেই পাঁচ জন এলেন কী করে? তা হলে কি ‘পরিকল্পিত ভাবে’ সকলকে ওই ঘরে আনা হয়েছিল? যে ঘরে দেহগুলি উদ্ধার হয়েছে সেটি থেকে বারান্দায় যাওয়ার দরজাটি ঘটনার সময়ে বন্ধ ছিল। তাই ডিভানে আগুন লাগার পর ঘর ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল বলে পুলিশের অনুমান। আগুনের তাপ ও ক্রমশ জমতে থাকা ঘন ধোঁয়ার চাপের জেরেই বারান্দার জানলার কাচ ভেঙে গিয়েছিল বলে মনে করছে পুলিশ। প্রতিবেশীরা ওই ধোঁয়াই দেখেছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ফ্ল্যাট থেকে একটি কেরোসিনের বোতল উদ্ধার হয়েছে। সেই কেরোসিন দিয়েই আগুন লাগানো হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ব্যবসার কারণে সম্প্রতি সুপ্রতিমবাবু একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নেন। তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও যোগ আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

ছবি: সুমন বল্লভ।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.