‘গাফিলতি’ ঢাকতে সক্রিয় লালবাজার
অবশেষে ধৃত গরফার অভিযুক্ত, সাসপেন্ড সেই ডিউটি অফিসার
ববর্ষের রাতে মোটরবাইক-আরোহী এক যুবক তাঁর শ্লীলতাহানি করেছে বলে গরফা থানায় গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন এক তরুণী। যুবকটিকে ‘হাতে-নাতে’ ধরে থানায় জমা দিয়েছিলেন এক পুলিশ অফিসারই।
কিন্তু রাতেই সেই ‘দুষ্কৃতী’কে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে গরফা থানার এক পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করল লালবাজার। রমেশচন্দ্র দাস নামে ওই পুলিশ অফিসার শনিবার রাতে গরফা থানায় ‘ডিউটি অফিসার’-এর দায়িত্বে ছিলেন। পাশাপাশি ‘গাফিলতি’ ঢাকতে রবিবার রাতে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে নতুন করে অভিযোগ লেখান পুলিশকর্তারা। যার ভিত্তিতে রবিবার রাতেই গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত যুবককে। লালবাজার সূত্রের খবর: ধৃতের নাম অরিজিৎ বসু, বাড়ি গরফা থানা-এলাকার পূর্বাচল খালপাড় বস্তিতে।
ঘটনার পরে অভিযোগকারিণী জানিয়েছিলেন, শনিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তিনি ও তাঁর সঙ্গী দেবাঞ্জন ব্রহ্ম যখন ইএম বাইপাসের কালিকাপুরে বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন মোটরবাইকে চেপে ওই যুবক সেখানে এসে তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। তরুণীর অভিযোগ, গায়ের কাছে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে তাঁর শ্লীলতাহানি করে সে। দেবাঞ্জনবাবু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করায় তাঁকেও নিগৃহীত হতে হয় বলে অভিযোগ। তরুণী আতঙ্কে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে থাকেন।
ঘটনাচক্রে সে সময়ে ওই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ট্র্যাফিক সার্জেন্ট প্রসেনজিৎ সেন। তাঁর মোটরসাইকেলের পিছনে ছিলেন এক ট্র্যাফিক কনস্টেবল। প্রসেনজিৎবাবু যুবকটিকে পাকড়াও করেন। অভিযোগ দায়ের করার জন্য মেয়েটিকে প্রথমে সার্ভে পার্ক থানায় পাঠান তিনি। পুলিশ-সূত্রের খবর: পরে সার্ভে পার্ক থানার পুলিশ এসে অভিযুক্তকে থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু কালিকাপুরের ঘটনাস্থলটি যে হেতু গরফা থানার আওতায়, তাই সার্ভে পার্ক থানা থেকে অভিযোগকারিণী ও অভিযুক্তকে গরফা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। দেবাঞ্জনবাবুও তরুণীর সঙ্গে ছিলেন। অভিযোগ, গরফা থানার কর্তব্যরত অফিসারকে ঘটনার কথা জানানো হলেও তা এফআইআর হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়নি।
পরিত্রাতা সার্জেন্ট
প্রসেনজিৎ সেন
ধৃত অভিযুক্ত
অরিজিৎ বসু
পুলিশ-সূত্রের খবর: রবিবার রাতে তরুণীর অভিযোগের কথা কানে যেতেই নড়েচড়ে বসেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা। ডিসি (সাউথ সাবার্বান) সুজয় চন্দ গরফা থানার ওসি পার্থ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন। পার্থবাবু ডিসিকে জানান, ঘটনাটি সম্পর্কে তিনিও অবহিত ছিলেন না। দ্রুত ওই তরুণীর অভিযোগ গ্রহণ করার নির্দেশ দেন পুলিশকর্তারা। সেই মতো রবিবার রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ পুলিশ অফিসারেরা দেবাঞ্জনবাবুর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে যান, এবং সেখানে বসে তরুণীর অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন। রাতেই থানায় যান যুগ্ম কমিশনার (এস্টাবলিশমেন্ট) চঞ্চল দত্ত এবং বিভাগীয় ডিসি সুজয় চন্দ।
শুরু হয় অরিজিতের খোঁজও। রবিবার রাতেই সে ধরা পড়ে। অরিজিৎ পূর্ব যাদবপুর, সার্ভে পার্ক ও গরফার তিনটে ঠিকানা দিয়েছিল। দেখা যায়, গরফা ছাড়া অন্য দু’টো ভুয়ো। তরুণী অভিযোগে যে কালো রঙের মোটরবাইকের কথা জানিয়েছিলেন, অরিজিতের গরফার বাড়িতে সেটাও মিলেছে বলে পুলিশ-সূত্রের খবর। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, অরিজিৎ পেশায় গাড়িচালক। পুলিশের দাবি, বাইপাস এলাকায় ছিনতাই-সহ নানা অপরাধের সঙ্গে সে যুক্ত, মাস দেড়েক আগে ওই তল্লাটে এক মহিলার সোনার হার ছিনতাইয়েও সে জড়িত। ওই ঘটনার তদন্তের জন্য এ দিন ধৃতকে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।
কিন্তু শনিবার রাতে শ্লীলতাহানির মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও থানা থেকে কেন ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল?
লালবাজার-সূত্রের খবর: মেয়েটির বয়ান নেওয়ার পরে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ‘অভব্যতা’র একটা ‘পেটি কেস’ (গুরুত্বহীন মামলা) দায়ের করা হয়েছিল। সে কারণেই স্রেফ ১০০ টাকার চালান কেটে তাকে ছেড় দেয় থানা। শুধু তা-ই নয়, ট্র্যাফিকের কয়েক জন অফিসার জানিয়েছেন, পর দিন অর্থাৎ রবিবার সকালে অরিজিৎ গিয়ে প্রসেনজিৎবাবুকে বলে, ‘পারলেন আমাকে আটকে রাখতে? থানা থেকে কী ভাবে ছাড়া পেতে হয়, আমার জানা আছে।’ এটা শোনার পরেই তাঁরা অভিযোগকারিণীর নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন বলে সোমবার জানিয়েছেন ওই পুলিশ অফিসারেরা।
একটি মেয়ে অত রাতে থানায় এসে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করা সত্ত্বেও ডিউটি অফিসার কেন গুরুত্ব দিলেন না? কেন এফআইআর করলেন না?
গরফা থানার এক অফিসারের ব্যাখ্যা, “থানায় দু’পক্ষই ব্যাপারটা মিটমাট করে নেওয়ায় ডিউটি অফিসার আর এফআইআর করেননি।” কিন্তু সেটাও অভিযোগকারিণীকে জানানো হল না কেন?
এ দিন পুলিশকর্তাদের কাছে এর কোনও সদুত্তর মেলেনি। এ দিকে তরুণীটির অভিযোগ ছিল, সার্ভে পার্ক থেকে গরফা থানায় যাওয়ার পথে গাড়ির মধ্যে অভিযুক্তের সামনেই দুই পুলিশকর্মী বার বার তাঁর ঠিকানা জানতে চাইছিলেন। তিনি ঠিকানা বলার পরে ছেলেটি পুলিশের সামনেই তাঁদের হুমকি দিয়েছিল।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তের সামনে অভিযোগকারিণীর ঠিকানা জানতে চেয়ে পুলিশকর্মীরা চাপ দিয়েছিলেন কেন?
পুলিশকর্তারা জানিয়েছেন, এই বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে শনিবার রাতে সার্ভে পার্ক থানার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক, ঘটনাস্থল যেখানেই হোক না কেন, অভিযোগ দাখিল করা যাবে যে কোনও থানায়। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানায় সেটি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে। তা সত্ত্বেও সার্ভে পার্ক থানা ওই রাতে অভিযোগ নিল না কেন?
পুলিশের একাংশের বক্তব্য: সার্ভে পার্কে অভিযোগ নিলেও মূল তদন্ত গরফাকেই করতে হতো। যে হেতু গরফা ও সার্ভে পার্ক থানা কাছাকাছি, তাই ওঁদের প্রথমেই গরফা থানায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য অভিযোগকারিণীদের সঙ্গে পুলিশ-পাহারাও দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু অভিযোগ দায়ের করার পরে শনিবার রাত একটা নাগাদ গরফা থানা থেকে মেয়েটি যখন বেরোলেন, তখন তাঁকে বাড়ি পাঠানোর জন্য পুলিশ-প্রহরা দেওয়া হল না কেন?
পুলিশকর্তারা জানিয়েছেন, এটা নিয়েও বিভাগীয় তদন্ত হবে। তবে পুলিশ যতই আশ্বাস দিক, ওই তরুণীর আতঙ্ক এখনও কাটেনি। কালিকাপুর-কাণ্ড উস্কে দিচ্ছে দশ বছর আগের এক রাতের স্মৃতিও। ২০০২-এর ৩১ ডিসেম্বরের সেই রাতে মধ্য কলকাতায় এক মহিলার শ্লীলতাহানি ঠেকাতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের সার্জেন্ট বাপি সেন। সেই মহিলাকে পরে পুলিশ আর খুঁজে পায়নি।
তবে কালিকাপুরে নিগৃহীতা মেয়েটি অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সার্জেন্ট প্রসেনজিৎ সেনকে। এ দিন তিনি বলেন, “ওই সময়ে প্রসেনজিৎবাবু না এসে পড়লে কী যে ঘটত, জানি না। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.