‘গাফিলতি’ ঢাকতে সক্রিয় লালবাজার
অভিযোগের গুরুত্ব মাপেন এক জনই
কোথাও লঘু অভিযোগ ঘিরে ব্যাখ্যাতীত সক্রিয়তা। আবার কোথাও গুরুতর অভিযোগ নিয়ে বিস্ময়কর নিষ্ক্রিয়তা।
গত চার দিনে কলকাতার দুই থানায় এ হেন পুলিশি-কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসছে আরও গুরুতর অভিযোগ, যার অভিমুখ খোদ পুলিশেরই দিকে। প্রশ্ন উঠেছে, নিউ গড়িয়া আবাসনের নেট-কাণ্ডে ‘কার্যত ধোপে না-টেকা’ অভিযোগের ভিত্তিতে চটজলদি এফআইআর করে এক অধ্যাপককে তড়িঘড়ি হাজতে পুরেছিল যে পুলিশ, কালিকাপুরে শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিয়ে তারাই কেন এত নিস্পৃহ রইল? যার ফলে এফআইআর তো হলই না, এমন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে গেল থানা থেকেই?
বস্তুত, কোনও অভিযোগ সম্পর্কে পুলিশের ‘বিশেষ’ তৎপরতা বা নিষ্ক্রিয়তার বিভিন্ন নজির বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছে ও যাচ্ছে। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বাইরে থেকে আসা চাপ’ই দায়ী বলে জানিয়েছেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তা ও আইনজীবী মহলের একাংশ। তবে তাঁরা এ-ও বলছেন, থানায় দায়ের অভিযোগের ভবিতব্যটা অধিকাংশ সময়ে যে প্রাথমিক ভাবে এক জনেরই ‘মর্জি’র উপরে নির্ভর করে, কালিকাপুরের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এবং এই ব্যবস্থা না-বদলালে বহু মারাত্মক অভিযোগের পরিণতি এমনই হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ওঁরা।
কিন্তু কে সেই ‘এক জন,’ যার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরে একটা অভিযোগের ভাগ্য নির্ভরশীল?
তিনি হলেন থানার সেই সময়কার ‘ডিউটি অফিসার।’ আইন মোতাবেক, আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে, বা তাঁর হয়ে অন্য কেউ পুলিশে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। কেউ কোনও অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলে তিনিও পারেন। অপরাধ হতে দেখলে কোনও পুলিশকর্মীও অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু ওঁদের অভিযোগ কী ভাবে থানায় লিপিবদ্ধ হবে, সেটা পুরোপুরি থাকে ভারপ্রাপ্ত ডিউটি অফিসারের হাতে। কারণ, অভিযোগ (এফআইআর বা জিডি) লেখেন তিনিই। আইনই তাঁকে সে ক্ষমতা দিয়েছে।

এফআইআর
যে ভাবে করতে হয়
এফআইআর লেখার নিয়ম কী?
• অভিযোগকারীর বয়ান পুলিশকে লিখে নিতে হবে।
• কী লিখল সেটা অভিযোগকারীকে পড়ে শোনাতে হবে।
• না হলে অভিযোগকারী নিজেই অভিযোগ লিখবেন।
• যিনি নিরক্ষর, তিনি বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ দেবেন।
• অভিযোগকারীকে নিখরচায় এফআইআর-এর প্রতিলিপি দেবে পুলিশ।
(সূত্র: ১৯৭৩ সালের ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড, ১৫৪ নম্বর ধারা)।
এফআইআর-এ কী কী থাকা বাধ্যমূলক?
• অভিযোগকারীর নাম, ঠিকানা, অপরাধের তারিখ, সময়, স্থান।
• যে ভাবে অভিযোগকারী অপরাধ হতে দেখেছেন।
• অপরাধীদের পরিচয় বা চেহারার বিবরণ।
• ঘটনাস্থলের বিবরণ।
• যদি কোনও প্রত্যক্ষদর্শী থাকে, তাঁর নাম।
পুলিশ এফআইআর নিতে না চাইলে তার কোনও বিহিত আছে কি?
• উচ্চতর অফিসার এমনকী ডিসি, এসপি, আইজি-র সঙ্গে দেখা করে তাঁদের কাছে সরাসরি অভিযোগ জানানো যায়।
• ডাকযোগেও ঊধ্বর্তন পুলিশ কর্তাদের কাছে অভিযোগ পাঠানো যায়।
• পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে অভিযোগকারী নিজের এলাকার আদালতে গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন।
• রাজ্য মানবাধিকার কমিশন কিংবা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের করা যায়।
পুলিশ প্রভাবিত হয়ে অভিযোগ লিখেছে বলে মনে
করলে অভিযুক্তের কিছু করনীয় আছে কি?

• তাৎক্ষণিক ভাবে করার কিছু নেই। পরবর্তীকালে আদালতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যায়।
এই ‘এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক’ পদ্ধতির ফলে অনেক সময়েই বিতর্ক দানা বাঁধে। কখনও বলা হয়, নিতান্ত ‘লঘু’ অভিযোগকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ অভিযুক্তকে চটজলদি গ্রেফতার করেছে। কখনও অভিযোগ ওঠে, ‘গুরু’ অপরাধকে ‘লঘু’ দেখাতে ডিউটি অফিসার এফআইআরের পথই মাড়াননি, স্রেফ জেনারেল ডায়েরি হিসেবে তা নথিভুক্ত করেছেন, যাতে তদন্তের প্রয়োজন না পড়ে। অনেক সময়ে অভিযোগকারীর লিখে দেওয়া অভিযোগপত্র ‘বাজে’ কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়ার মতো অনিয়মের কথাও শোনা যায়।
যেমন শোনা যাচ্ছে গত চার দিনে কলকাতার দুই থানায় দাখিল তিনটি অভিযোগ ঘিরে।
একটি হল নিউ গড়িয়া সমবায় আবাসনের নেট-কাণ্ড। ওই ঘটনায় পূর্ব যাদবপুর থানায় তৃণমূলের এক নেতার দায়ের করা যে অভিযোগের ভিত্তিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে পুলিশ বৃহস্পতিবার রাতে সাততাড়াতাড়ি গ্রেফতার করে ১৬ ঘণ্টা হাজতে রেখে দিয়েছিল, সেটা আদৌ এফআইআরের যোগ্য কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। অথচ অম্বিকেশবাবু তাঁকে নিগ্রহের যে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, আইনজীবীদের অনেকের মতে তা অনেক বেশি গুরুতর। তবু সে ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয় অভিযোগ দায়েরের দশ ঘণ্টা পরে। তা-ও থানায় ডেকে পাঠিয়ে, জামিনযোগ্য ধারা দেওয়ার
কথা বলে!
‘বৈষম্যের’ এক পিঠ যদি হয় নিউ গড়িয়া, আর এক পিঠ তা হলে কালিকাপুর। যেখানে নববর্ষের রাতে আক্রান্ত তরুণী থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন, এমনকী অভিযুক্তকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন এক পুলিশ অফিসার স্বয়ং। তা সত্ত্বেও থানা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ, তার বিরুদ্ধে পেটি কেস (গুরুত্বহীন মামলা) দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ডিউটি অফিসার। থানা এখানে আইন মেনে কাজ করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
কাঠগড়ায় পুলিশ
পুলিশ কী করেছে পুলিশ কী করেছে
• অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে সাত তাড়াতাড়ি গ্রেফতার করেছে
• তাঁকে ১৬ ঘণ্টা হাজত বাস করিয়েছে
• অধ্যাপকের উপরে হামলাকারীরা গ্রেফতার হল ১০ ঘণ্টা পরে
• হামলাকারীকে অভিযোগকারীদের ঠিকানা জানতে দিয়েছে
• সার্ভে পার্ক থানা অভিযোগ না নিয়ে গরফা থানায় পাঠিয়ে দিয়েছে
• অভিযোগকারী লিখিত বয়ানকে জিডি বা এফআইআর হিসেবে ধরেনি
• অভিযোগকারীর অভিযোগপত্রে সিলমোহর লাগিয়ে তার প্রতিলিপি দেয়নি
• অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনও কেস না লিখেই ছেড়ে দিয়েছে
যা করা উচিত ছিল যা করা উচিত ছিল
• অধ্যাপকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জেনারেল ডায়েরি করা
• প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে এফআইআর লেখা
• তদন্তের আগে অধ্যাপককে গ্রেফতার না করা
• গ্রেফতার করলেও থানা থেকে জামিন দেওয়া
• অধ্যাপকের আঘাত কতটা তার মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো
• অধ্যাপকের কথা শুনেই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লেখা
• হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া
• সার্ভে পার্ক থানারই অভিযোগ নেওয়া উচিত ছিল
• গরফা থানার উচিত ছিল এফআইআর-এর প্রতিলিপি অভিযুক্তকে দেওয়া
• অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা করা n অভিযুক্তকে নিদেন পক্ষে জামিন দিয়ে ছেড়ে দেওয়া
কী রকম?
আইনজীবীরা বলছেন, অভিযোগ অভিযোগকারী নিজে লিখতে পারেন। তখন সংশ্লিষ্ট ডিউটি অফিসার তাতে সই করে থানার সিলমোহর লাগিয়ে জিডি বা এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করবেন। অন্যথায় ডিউটি অফিসার অভিযোগকারীর মুখোমুখি বসে অথবা টেলিফোনে তাঁর বয়ান লিখবেন। তাতে সই করে থানার সিলমোহর দেবেন। তার পরে অভিযোগকারীকে দিয়ে সই করাবেন কিংবা আঙুলের ছাপ নেবেন। দু’টি ক্ষেত্রেই অভিযোগপত্রের প্রতিলিপি অভিযোগকারীর হাতে তুলে দেওয়া ব্যধ্যতামূলক।
কিন্তু শনিবার রাতে গরফা থানা অভিযোগপত্রের কোনও প্রতিলিপি অভিযোগকারিণীকে দেয়নি। আইনজীবীদের বক্তব্য: থানার ডিউটি অফিসারেরই উচিত ছিল এ বিষয়ে অভিযোগকারিণী ও তাঁর সঙ্গীকে অবহিত করা। তিনি তা করেননি। গরফা থানার ওই ডিউটি অফিসারকে অবশ্য ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড করা হয়েছে।
পাশাপাশি শনিবার রাতে সার্ভে পার্ক থানার ভূমিকাও সংশয়াতীত নয়। ট্র্যাফিক সার্জেন্ট প্রসেনজিৎ সেন ‘নিগৃহীতা’ তরুণী ও তাঁর সঙ্গীকে উদ্ধার করে সার্ভে পার্ক থানায় পাঠিয়ে দিলেও কেন তারা অভিযোগ নিল না, সে প্রশ্ন উঠেছে আইনজীবী মহলে। কলকাতা হাইকোর্টের এক ফৌজদারি আইনজীবীর কথায়, “অভিযোগ যে কোনও থানা নিতে পারে। পরে তারা তা সংশ্লিষ্ট থানায় ফরওয়ার্ড করে দেবে। সুপ্রিম কোর্ট এমনটাই বলে দিয়েছে। অথচ এখানে মানাই হয় না! জেলাতে তো নয়ই। এখন দেখা যাচ্ছে, কলকাতাতেও নয়!”
সম্প্রতি বেশ ক’টি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট এফআইআর লেখার ব্যাপারে পুলিশকর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পুলিশকর্তাদের সুপারিশ করেছে। শুধু তা-ই নয়, কেস ডায়েরি লেখার ক্ষেত্রেও যে অনেক সময়ে তদন্তকারী অফিসারেরা নিয়ম মানছেন না, হাইকোর্ট বার বার তা-ও জানিয়েছে। আইনজীবীদের একাংশের প্রশ্ন, এর পরেও পূর্ব যাদবপুর বা গরফার মতো ঘটনা ঘটে কী ভাবে?
কী ভাবে, তার ইঙ্গিত রয়েছে হাইকোর্টের এক প্রবীণ আইনজীবীর মন্তব্যে। যিনি বলছেন, “কোনও অভিযোগের তদন্ত কী ভাবে হবে, এক জন ব্যক্তির (ডিউটি অফিসার) উপরে তা পুরোপুরি নির্ভরশীল। ওঁর উপরে নানা ধরনের চাপ থাকতে পারে। রাজনৈতিক চাপ, বড় কর্তাদের চাপ, সামাজিক চাপ। দেখতে হবে, ওই পরিস্থিতির মুখে উনি কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অভিযোগ ধর্তব্য (কগনিজিবল) হিসেবে দেখছেন কি না, কী ধারা দিচ্ছেন। ঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষ ঠিকঠাক বিচার পাবেন। না-হলে কখনও কোর্টে আসার আগে অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে যাবে। কখনও নির্দোষের ভোগান্তি হবে।”
আর ফৌজদারি কার্যবিধি-দণ্ডবিধিতে বড় ধরনের বদল না-হওয়া পর্যন্ত বিচারপ্রাথর্ীর্কে যে এ ভাবে ডিউটি অফিসারের ‘মর্জি’রই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে, তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন ওই আইনজীবী।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.