আগুনে ধোঁয়ায় আমরি-আতঙ্ক এসএসকেএম, মেদিনীপুরেও
য়ার্ডের মধ্যে কালো ধোঁয়া দেখে বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করছেন মুমূর্ষু রোগীরা। চারদিক ঝাপসা, শুরু হয়েছে শ্বাসকষ্টও। আউটডোরের রোগীরা পড়িমরি করে ছুটে বেরোচ্ছেন। গুরুতর অসুস্থদের উদ্ধার করতে স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি ছোটাছুটি করছেন রোগীদের আত্মীয়রাও। অনেককে বার করে এনে কোনওমতে রাখা হচ্ছে হাসপাতাল চত্বরের গাছতলায়। বুধবার সকাল ন’টা। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল তখন আতঙ্কপুরী।
প্রায় একই সময়ে সওয়াশো কিলোমিটার দূরে এক নার্সিংহোম জুড়েও তখন শুধু ভয়ার্ত রোগীদের চিৎকার। বেসমেন্ট থেকে পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সিঁড়ি দিয়ে নামতে দমবন্ধ হয়ে আসছে। জানলার কাচ ভাঙা গেলেও লোহার গ্রিল ভাঙে কার সাধ্য! প্রাণপণ চেষ্টা চলছে, মেদিনীপুর শহরের ওই নার্সিংহোমটা থেকে সদ্যোজাত বাচ্চাগুলোকে যেন নিরাপদে বার করে আনা যায়।

উদ্ধারের পর সন্তান
কোলে মা। মেদিনীপুরে।
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ
এই দূরত্ব পেরিয়ে আমরি-অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি তখন মিলিয়ে দিয়েছে দুই শহরকে। ফিরে এসেছে সেই ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। উদ্ধারকারীদের তৎপরতায় এ দিন অবশ্য দু’জায়গাতেই রক্ষা পেয়েছে সব ক’টি প্রাণ।
গত ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের বেসমেন্টে আগুন লেগেছিল। এসি-র ‘ডাক্ট’ দিয়ে সেই বিষাক্ত ধোঁয়া হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়ায় মারা যান নব্বইয়েরও বেশি মানুষ। বুধবারের জোড়া আগুনে সেই বিপর্যয়েরই খণ্ডচিত্র ফিরে এসেছে নতুন করে।
দমকলের অভিযোগ, মেদিনীপুরের নার্সিংহোমটির বেসমেন্টে ছিল তুলো-গজের মতো দাহ্য বস্তু ও বর্জ্যের স্তূপ। খড়্গপুর দমকল কেন্দ্রের ইনচার্জ রবীন্দ্রনাথ সরকার বলছেন, “দমকলের কোনও বিধিই মানেননি মেদিনীপুরের ওই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। বেসমেন্টে দাহ্য বস্তু, আবর্জনার স্তূপ ছিল। মজুত ছিল অক্সিজেনের বেশ কিছু সিলিন্ডারও।” দমকলের অনুমান, শর্ট সার্কিট থেকেই আগুন লেগেছিল। বেসমেন্টে দাহ্য পদার্থ জড়ো থাকায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই আমরি-কাণ্ডের পরে হাসপাতালের অগ্নিবিধি নিয়ে হাজারো তোলপাড় সত্ত্বেও ওই নার্সিংহোমটি যে সে সবের তোয়াক্কা করেনি, তা স্পষ্ট। উপরন্তু এই বাড়িটি এমনই এক সংকীর্ণ গলিপথে, যেখানে দমকলের একাধিক ইঞ্জিনের ঢোকা মুশকিল। ঘটনার পরে নার্সিংহোমটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর পীযূষ পাল এবং আর এক ডিরেক্টর অলোক ঘোষ-সহ চার কর্তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শতাধিক শয্যাবিশিষ্ট নার্সিংহোমটি আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর।
কিন্তু রাজ্যের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমে এ দিনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী কে? দমকল জানিয়েছে, এখানে কালো ধোঁয়ার উৎস ছিল হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের আউটডোরের এসি মেশিন। প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, ওই যন্ত্রে শর্ট সার্কিটের ফলে আগুন লেগেছিল। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুতের তার এবং কাগজপত্রে। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এই ঘটনায় হাসপাতালের কর্মীদের একাংশকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “কর্মীদের গাফিলতিতে মঙ্গলবার সারা রাত এসি মেশিন চলেছিল। যার ফলে ওভারলোড হয়ে গিয়ে শর্ট সার্কিট হয়।” রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র হাসপাতালে যান। মদনবাবু বলেন, “হাসপাতালে এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। এ দিন অনেক বড় বিপদ এড়ানো গিয়েছে। কর্মীদের গাফিলতির বিষয়টিও গুরুতর।”

এসএসকেএমে ওয়ার্ড থেকে
বার করা হচ্ছে রোগীকে।
ছবি: সুদীপ আচার্য।
‘দোষী’ কর্মীদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিলেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? হাসপাতালের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “যান্ত্রিক ত্রুটি থেকেই আগুন লেগেছিল।” তবে কী সেই যান্ত্রিক ত্রুটি, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি। পুরমন্ত্রী যে অভিযোগ এনেছেন, সে বিষয়ে প্রদীপবাবু বলেন, “এমন কোনও কথা শুনিনি।”
এ দিন সকাল থেকেই লম্বা লাইন ছিল এসএসকেএমের আউটডোরে। জরুরি বিভাগে এমন কয়েক জন রোগীও ছিলেন, যাঁদের নড়াচড়ার অবস্থা ছিল না। আগুন লাগে ওই সময়েই। প্রায় ৫০ জন রোগীকে শয্যা থেকে সরিয়ে নিতে হয়। জায়গার অভাবে তাঁদের রাখা হয় হাসপাতালের সামনের খোলা চত্বরে। সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় আউটডোর বিভাগ। দমকলের তিনটি ইঞ্জিন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল চত্বরে সার বেঁধে শুইয়ে রাখা হয়েছে রোগীদের। অনেকের আত্মীয়েরই হাতে ধরা স্যালাইনের বোতল। তাঁদেরই এক জন, আন্দুলের অসীমা মণ্ডল জানালেন, তাঁর জামাইবাবু ভর্তি ছিলেন জরুরি বিভাগে। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তেই কয়েক জনের সাহায্যে তড়িঘড়ি তাঁকে বার করে এনেছেন। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতেরা যে ‘নিউ ক্যাজুয়ালটি ব্লক’-এ ভর্তি থাকেন, সেখান থেকেও ছ’জন রোগীকে বাইরে নিয়ে আসা হয়। তিন জনকে আবার সরানো হয় অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ ফের চিকিৎসা শুরু করা হয়। এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগকে আপাতত অন্য ঘরে সরানো হয়েছে।
গত ২৭ জানুয়ারি রাতে এসএসকেএমের ম্যাকেঞ্জি ওয়ার্ড লাগোয়া একটি শেডে আগুন লেগেছিল। তদন্তে জানা যায়, ওই ওয়ার্ডের একটি শৌচাগার থেকে জ্বলন্ত বিড়ি-সিগারেটের টুকরো আবর্জনায় ফেলে দেওয়ার ফলেই আগুন লেগেছিল। আমরি-কাণ্ডের তদন্তের সময়েও ওই হাসপাতালের বেসমেন্টে ধূমপানের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল বলে একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে মেদিনীপুরের নার্সিংহোমটিতেও সেই বেসমেন্টই আগুনের উৎস বলে প্রাথমিক তদন্তে অনুমান। নার্সিংহোমটির এক কিশোর কর্মীর দাবি, সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ বেসমেন্টের ফার্মাসি-র এক ধারের একটি সুইচবোর্ডের তারে সে প্রথম আগুন দেখতে পায়। কিন্তু ব্যাপারটা সে অন্য কর্মীদের জানালেও তাঁরা গুরুত্ব দেননি বলেই অভিযোগ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ধরে ফার্মাসি-র শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে। গলগল করে বেরোতে থাকে ধোঁয়া।
মঙ্গলবারই মেদিনীপুরের নার্সিংহোমটিতে আইসিসিইউ থেকে সাধারণ শয্যায় ফিরেছিলেন গঙ্গাধর পাল। তাঁর অনুব্রতী জোৎস্না চালক বললেন, “বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষকে কী ভাবে বার করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। জানলার ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে শুধু চিৎকারই করে গিয়েছি।” নার্সিংহোমে ছিল মধুসূদননগরের বাসিন্দা অশোক সেনের সদ্যোজাত নাতনি। অশোকবাবুর কথায়, “বাচ্চাটাকে নামাব কী করে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।”

চত্বরেই রাখা হয়েছে রোগীদের। এসএসকেএমে। নিজস্ব চিত্র
এই অবস্থাতেও নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ এবং কর্মীরা প্রথমে নিজেরাই ‘সব সামলে নেওয়া’র চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ। কয়েকশো মিটার দূরের দমকল কেন্দ্রে খবর পৌঁছয় প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আমরি-কাণ্ডের মতোই ওই হাসপাতালে কর্তব্যরতদের অনেককেই বিপদের সময়ে পিঠটান দিতেও দেখা গিয়েছে এ দিন! উৎকণ্ঠা যখন চরমে, সেই সময়ে বিশাল বাহিনী নিয়ে পৌঁছন পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) কল্যাণ মুখোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসন ও স্থানীয় মানুষের উদ্ধারকার্যে প্রাণ বাঁচে জনা পঞ্চাশ রোগীর। তিনতলার জানলা থেকে এসি মেশিন খুলে ফেলে সেই ফাঁকের সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে পাশের বাড়ির ছাদে লাগানো হয় মই। সেই মই বেয়েই এক-এক করে ১২টি শিশুকে বার করে আনা হয়। ধোঁয়ায় এক দমকল অফিসার, এক পুলিশকর্মী-সহ চার জন অসুস্থ হয়ে পড়েন।
প্রাণহানি এড়ানো গেলেও একটা প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছেই আমরি-কাণ্ডের পরেও এই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে অগ্নি-সুরক্ষায় দায়বদ্ধ করা গেল না কেন? জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্র বলেন, “আমরি-র পরে পরিদর্শন করে যে-সব পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তা মানেনি ওই নার্সিংহোম।” কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর কেন ফের পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেনি? জবাব মেলেনি।
তা ছাড়া অভিযোগ, সরু গলিতে চারতলা তৈরির অনুমতি নিয়ে এই নার্সিংহোমটি পাঁচতলা করা হয়েছিল। এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “অনুমতির পরে কিছু মানুষ উল্টোপাল্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়েছে কি না, দেখা হবে।” এত দিন কেন ‘দেখা’ হয়নি তারও জবাব মেলেনি।
নার্সিংহোমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পীযূষ পাল প্রথমে বলেছিলেন, “পরিকাঠামোর ত্রুটি ছিল না। মনে হয় অন্তর্ঘাত হয়েছে।” শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁকে গ্রেফতারই হতে হয়েছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.