দিনরাতের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারোটি ঘণ্টাই রবি, মানিক, তোতনদের বহরমপুর শহরের পথেই কাটাতে হয়। ব্যস্ততম পথের অনেকটা অংশ জবরদখল করে তাঁদের মতো অনেকেই চা-বিস্কুট, রুটি-মাংস ও রঙিন মাছ বিক্রির দোকান করে এত দিন রুজি রোজগার করেন। তাঁদের কাছেও চেনা শহরটি হঠৎ যেন অচেনা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। যেন বিদেশি বিদেশি ভাব।
বহরমপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র ক্যান্টনমেন্ট রোড লাগোয়া রুটি-মাংসের দোকানদার রবি ঘোষ তো বলেই বসলেন, “পরিবার পরিজনদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য ১৯৮৪ সাল থেকে শহরের রাস্তায় পড়ে রয়েছি। হাতের তালুর মতো চেনা সেই শহরটিই হঠাৎ কেমন করে টিভিতে দেখা অচেনা বিদেশি শহরের মতো আদল পেতে চলেছে!” শহরের ভোল বদলের প্রাথমিক পর্বে প্রায় তিন মাস অবশ্য জীবিকা হারানোর আশঙ্কায় রবি সিঁটিয়ে ছিলেন। রবির দোকানের পাশেই রয়েছে মানিক ঘোষের চায়ের দোকান।
মানিক বলেন, “প্রথম দিকে খুব সংশয়ে ছিলাম। পুলিশ ও পুরসভা মিলে আমাদের মতো ফুটপাতের দোকানদারদের সত্যিই পথে বসাবে না তো! এখন আশঙ্কা দূর হয়েছে। পুরসভা ও পুলিশের উদ্যোগে আমার মতো ফুটপাথের আরও অনেক দোকানদার খুশি। পুরসভা ও পুলিশের উদ্যোগেই আমাদের কপালে জুটেছে ভ্রাম্যমান সুদৃশ্য স্থায়ী দোকানঘর।”
সেই সৌন্দর্যায়নের সলতে পাকানোর নাতি-দীর্ঘ একটি পর্ব রয়েছে। |
পলাশির যুদ্ধের কয়েক বছর পরে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৪০০ বিঘা জমি জুড়ে বহরমপুরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা বাহিনীর ব্যারাক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু হয়। বছর দু’য়েকের মধ্যে ৩ লক্ষ ২ হাজার ২৭০ পাউন্ড খরচ করে ব্যারাক নির্মাণ সম্পন্ন হয়। প্রায় ১৬০০ বর্গ মিটার আয়তনের মাঠের (ব্যারাক স্কোয়ার মাঠ)-এর উত্তর ও দক্ষিণে সরকারি কার্যালয় ও আবাসন (অতীতের সেনা ব্যারাক)। পশ্চিমে জেলাশাসক, জেলা জজ, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের বাংলো ও বহরমপুর গার্লস কলেজের হস্টেল। ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের পূর্বে রয়েছে আদালত, জেলাশাসকের কার্যালয়, রেজিস্ট্রি অফিস, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও টেক্সটাইল কলেজ। বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ারে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। বহরমপুর শহরের ঐতিহাসিক ওই ব্যারাক স্কোয়ারের চারদিকে ইংরেজরা রেঙ্গুন থেকে আমদানি করা রেনট্রি লাগিয়ে সবুজায়ন ঘটিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক ওই ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের পূর্বদিক ও উত্তরদিক জবরদখল করে দোকান ঘর গড়ে তোলা হয়। ফি বছর পুরসভা ও পুলিশ যৌথ ভাবে ওই জবরদখল মুক্ত করলেও কয়েকদিন পর ফের সেই আগের মতো চেহারায় ফিরে যেত ওই ঐতিহাসিক এলাকা। বহরমপুর পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “ফলে কয়েক মাস আগে ব্যারাক স্কোয়ারের চারপাশের জবরদখল উচ্ছেদ করে লোহার রেলিং দিয়ে মাঠটি ঘিরে দেওয়া হয়। মাঠ ও রেলিং-এর মাঝের এলাকার সৌন্দর্যায়নও করা হয়। তখন জীবিকা হারানো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বহরমপুর পুরসভার মুখ্য উপদেষ্টা, স্থানীয় সাংসদ অধীর চৌধুরীর দ্বারস্থ হন। সাংসদের পরিকল্পনা মতো মাদ্রাজ, দিল্লি, মুম্বই-এর মতো ভ্রাম্যমান সুদৃশ্য দোকানঘর তৈরি করে দোকানিদের দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়।” মাছ, আম, কমলা, আপেল, আতার আকৃতির ওই দোকানঘরগুলি পুরসভার ব্যবস্থপনায় তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।” খরচ পড়ছে ৩০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা।
পুরপ্রধান বলেন, “নগদে যে পারছেন কিনছেন, না হলে পুরসভার মাধ্যমে স্বর্ণজয়ন্তী শহরি রোজগার যোজনা প্রকল্প থেকে করে দেওয়া হচ্ছে। দোকনদারদের ট্রেড লাইসেন্সও করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি দোকানঘর বিলি করা হয়েছে। সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যে ওই রকম ৩০টি দোকানঘর বিলি করা হবে।” বিশাল কাতলা মাছের আকৃতির ভ্রাম্যমান দোকানঘর পেয়েছেন তোতন সরকার। রঙিন মাছের ব্যবসায়ী তোতন বলেন, “সাড়ে ছ’বছরে আমার দোকান ভাঙা পড়েছে অন্তত ২০ বার। তাতে অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে পুরসভা থেকে সুদৃশ্য দোকানঘর ও ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ায় আমাদের ব্যবসা হারানোর ভয়টা এ বার কাটল। এলাকাটারও সৌন্দর্য বাড়ল।” |