লন্ডনের আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছিল ‘বেস্ট-সেলার’ ঔপন্যাসিক জেফ্রি আর্চারকে। মুক্তি পাওয়ার পর নিজের কারাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘প্রিজন ডায়েরি’। জেলের সেই রোজনামচা ছাড়াও সহ-বন্দিদের জীবন থেকে অভিজ্ঞতার টুকরো নিয়ে আর্চার বেশ কয়েকটি ছোটগল্পও লিখেছেন।
এমন কাহিনি ভবিষ্যতে তিনি লিখবেন কিনা জানা নেই। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ কারাবাসের কাহিনি বুধবার সংবাদমাধ্যমের কাছে খোলাখুলি বললেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, অধুনা বিধায়ক এবং সিপিএমের ‘দাপুটে’ নেতা সুশান্ত ঘোষ।
বললেন, খাদিম-মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আফতাব আনসারি ঈদের দিন সেলের বারান্দায় তাঁকে ‘ঈদ মুবারক’ জানিয়েছিল! সে দিন বন্দিদের সকলকে একসঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ। টানা ১৫ দিন নিরামিষ খাবারের পর ওই দিনই প্রথম জেলের মধ্যে প্রাক্তন মন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছিল আমিষ খাবার। রোজ রোজ নিরামিষ খেতে খেতে একদিন তিনি বাধ্য হয়ে জেলারকে জিজ্ঞাসাই করেছিলেন, “আপনারা কি আমাকে বৈষ্ণব বানিয়ে ছাড়বেন?” শেষ পর্যন্ত ঈদের দিন আমিষের স্বাদ পেয়েছিলেন সুশান্তবাবু।
বললেন, উজ্জ্বল আলোর নিচে একটানা ৩০ ঘণ্টা একটি চেয়ারে ঠায় বসিয়ে রেখে তাঁকে জেরা করা হয়েছিল। সারারাত জেরা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ভোররাতে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন পুলিশকর্তা। তিনি কিন্তু ঠায় জেগে বসেছিলেন। একটানা জেরার পরেই একসময়ে তাঁর রক্তচাপ বেড়ে যায়। ডাকা হয় চিকিৎসক। পাঠানো হয় হাসপাতালে।
বললেন, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ছোট বোনের স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি জেলে দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু বোনকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ। বোন ফিরে যান মেদিনীপুরে। যেমন জেলের ফটক থেকে ফিরে গিয়েছিলেন অন্য আত্মীয় বা পার্টির নেতা-কর্মীদের অনেকে।
এদিন রাজ্য বিধানসভা চত্বরের মিডিয়া সেন্টারে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের পাশে বসে তাঁর ১৮০ দিন পুলিশি ও জেল হেফাজতে থাকার অভিজ্ঞতা শোনালেন গড়বেতার বিধায়ক সুশান্তবাবু। ২০০৬ সালে নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হয়েছিল সিপিএমের তৎকালীন মন্ত্রী নারায়ণ বিশ্বাসকে। কিন্তু তখন বাম-রাজত্ব। কিছুদিনের মধ্যেই নারায়ণবাবু জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ভোটে লড়েন। মন্ত্রীও হন। কিন্তু নারায়ণবাবু সুশান্তবাবুর মাপের নেতা নন। এত দীর্ঘ সময় সিপিএমের কোনও প্রাক্তন মন্ত্রীকেও জেলে থাকতে হয়নি।
জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর সুশান্তবাবু নিয়মিত বিধানসভায় আসছেন। কিন্তু এ দিনই তিনি প্রথম কারাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুললেন। জানালেন, দশ বছরের মন্ত্রী, দীর্ঘদিনের বিধায়ককে পুলিশকর্তারা জেরা করতে গিয়ে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর মন্ত্রী নেই! বাম জমানার অবসান হয়েছে। কিন্তু তিনি পাল্টা জবাব দিয়েছেন, মন্ত্রী না-থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি এখনও বিধায়ক। ক’দিন আগেও বিধানসভায় পুলিশ তাঁকে সম্মান দেখিয়েছে। সুশান্তবাবুর কথায়, “রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অটুট বিশ্বাসই আমায় মানসিক শক্তি জুগিয়েছে।”
কী ভাবে তাঁকে জেরা করা হত? প্রাক্তন মন্ত্রী জানিয়েছেন, পুলিশি হেফাজতে একটানা ৩০ ঘণ্টা জেরা করার জন্য পুলিশের পাঁচটি দল করা হয়েছিল। ডিআইজি থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অফিসাররা ছিলেন সেই দলে। প্রতিটি দলের অফিসাররা টানা পাঁচ-ছ’ঘণ্টা করে জেরা করেছেন। একই প্রশ্ন করেছেন ঘুরিয়েফিরিয়ে। জেরার মধ্যে একাধিক বার যোগ দিয়েছেন ডিজি পদমর্যাদার পুলিশকর্তারাও।
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে প্রথমে তাঁকে রাখা হয়েছিল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের সেলে। সেখানে থাকত অধিকাংশই খুনি বা দাগী অপরাধী। সকাল সাড়ে ৬ টায় লক-আপ খুলত। তখন বারান্দায় পায়চারি করতে পারতেন। সেল বন্ধ হত বিকেল ৫ টায়। তার পরে প্রাকৃতিক প্রয়োজনের দরকার হলে সেলেই করতে হত। দুর্গন্ধ আর ছারপোকায় ভরা কম্বল গায়ে দেওয়া যেত না। সুশান্তবাবুর অভিযোগ, তিনি ডিভিশন-ওয়ান এর রাজনৈতিক বন্দি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ‘ইচ্ছাকৃত ভাবে’ ওই সেলে রাখা হয়েছিল। পর পর ২৮টি ঘর। সেখানে যেমন আছে আফতাব আনসারি, তেমনই নকশাল নেতা মধু। তিনটি খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক আসামী প্রাক্তন মন্ত্রীকে চিনতে পেরে বলেছিলেন, “আপনি ডিভিশন-ওয়ান অপরাধী। আমাদের সঙ্গে এই সেলে আপনাকে রাখার নিয়ম নেই।” তাঁর আইনজীবীকে সে কথা জানিয়েছিলেন সুশান্তবাবু। আদালতে আবেদন করার পরে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল রাজনৈতিক বন্দিদের সেলে।
প্রাক্তন মন্ত্রী জানিয়েছেন, জেলের সেল বা ভবানী ভবনের পুলিশ লক-আপ তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কতটা অপরিষ্কার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অভিযুক্তদের থাকতে হয়। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে যে অবস্থা ছিল, পরিবর্তনের জমানার ১০ মাসে তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। অভিযোগ তুললে তা যে আদতে তাঁদের দিকেই ঘুরে আসে, তা বুঝতে পেরে অবশ্য প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। কিন্তু যে ভাবে পুলিশ হাজতের একটি ভাঙা মগে একই সঙ্গে জলপান, স্নান এবং শৌচকার্য করতে হয়েছে, তা দেখে ঘনিষ্ঠ মহলে সুশান্তবাবু জানিয়েছেন, অবিলম্বে এই অবস্থা বদলানো দরকার। প্রকাশ্যে সুশান্তবাবুর বক্তব্য, ভোটের আগেই তাঁকে জেলে ভরার কথা ভেবেছিল তৃণমূল। প্রকাশ্যে বলেওছিল। তা-ই তারা করেছে। কিন্তু তিনি ‘রাজনৈতিক লড়াই’ চালিয়ে যাবেন। সঙ্গী রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অটুট বিশ্বাস। |