|
|
|
|
পোশাকি সঙ্কোচ খুলে |
সমাজের কাছে সব আচরণের কৈফিয়ত দিতে হবে? কেন? |
|
প্রতিমা বেদি |
প্রতিমা বেদিকে মনে আছে? ষাটের দশকের শেষ দিকটায় অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন ‘মার্কামারা বাজে মেয়ে’। মডেলিং আরও অনেকেই করত। কিন্তু এই মেয়েটি ভীষণ ভীষণ উগ্র। চুলে সোনালি রং, হল্টারনেক পরে শরীর দেখান, টাইট ট্রাউজার্স পরে ঘোরেন। একাধিক পুরুষসঙ্গী। লিভ ইন করেন, পার্টনার কবির বেদি। তাঁকেই বিয়ে করলেন শেষমেষ। ওপেন ম্যারেজ নাকি। বিলেতের মতো। বিয়ের বাইরেও অন্য পুরুষ-মহিলার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা।
চুয়াত্তরে মুম্বইয়ের বিচে বিবস্ত্র দৌড়োলেন সেই মেয়ে। দু’বাচ্চার মায়ের শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই! বেশরম ছবিটা ছাপল নতুন ম্যাগাজিন ‘সিনেব্লিজ’। প্রচ্ছদ করার সাহস হয়নি, সেখানে সুন্দর সেজে জিনত আমন। ভেতরে পাতা জুড়ে ‘বিস্ফোরক’ প্রতিমা। আর, যা হয়, তুমুল পরনিন্দা পরচর্চা। ন্যুড শুটটা নাকি দু’বার হয়েছিল। কাকভোরে, বম্বের জনহীন রাস্তায় প্রথম বার ন্যুড দাঁড়ান তিনি। সে ছবি মেয়ের পছন্দ হয়নি। তাঁর অবয়বের গঠন নাকি তাতে তেমন মজবুত দেখাচ্ছিল না। তাই আবার পোশাক খোলেন ক্যামেরার সামনে, এ বার জুহু বিচে। আসলে পোশাক নয়, শরীরের সঙ্গে আজন্ম লেপ্টে থাকা যৌনতা আর সঙ্কোচটাকেই খুলে ফেলে দিলেন প্রতিমা। এবং এক দৌড়ে সময়ের অনেক আগে পৌঁছে গেলেন। আজ এত দিন পরেও সময় সেই খোলামেলা, মুক্তবাতাস পৃথিবীটায় পৌঁছতে পারেনি।
প্রতিমাদের সেই মুক্ত পৃথিবীতে, বড় হওয়ার সময়, মেয়েদের শরীর দেখিয়ে শেখানো হয় না, এটা পাপ। শরীরকে তিনি সুন্দর, শিল্পবস্তু বলে চিনেছেন। নিজের যৌবন নিয়ে গর্ব অনুভব করেছেন। ওই বস্ত্রহীন দৌড়ও আসলে এক উদারনৈতিক বিবৃতি। ‘ইচ্ছেগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার অধিকার আমার আছে’, এই মতবাদটা প্রতিষ্ঠা করতেই চেয়েছিলেন। আর যখন দেখেছেন, তাঁর অনাবিল আনন্দটুকু অনুভব করার ক্ষমতাই নেই কারও, অন্যদের কাছে এটা নিছক পাবলিসিটি স্টান্ট, তখনই মতবদল। বলেছিলেন, ওটা তো একটা নুডিস্ট ক্যাম্পে তোলা ছবি। পরে বিচের ছবিটা বসিয়ে সুপারইম্পোজ করা হয়েছে। সবাই ঘাড় নেড়ে বলল, এ রকম মেয়েরা তো অনেক ছলাকলা জানে, মিথ্যে বলতে পারে যখন তখন। কেউ আবার খোঁজখবর করে বললেন, মেয়েবেলায় যৌন অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন প্রতিমা, মাথাটা বিগড়ে গেছে তখনই, শরীর সম্পর্কে বাছবিচারের ওখানেই ইতি।
সমাজ, সমাজের অভ্যেসেই, ভাল-মন্দ মাপে। ভাল খারাপ, সাদা কালো, উচিত অনুচিত। সমাজের ধরিয়ে দেওয়া স্কেল। তাই দিয়ে মাপলে, প্রতিমা আলবাত বিষকন্যা। কারণ তিনি স্বাধীনচেতা। তাতেই তো বিপদ। মেয়েরা যখনই নিজের শরীরের রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, নিজের ইচ্ছা মতো বেঁচেছে, তখনই সেই তেজস্বিনী সাহসিনীর দলকে সমাজ ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাদের নিয়ে খুব অস্বস্তি। ওরা যে পিতৃতন্ত্রের গোড়াটার দিকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। প্রতিমা যেমন। বিয়ে ভেঙে যখন তখন বেরিয়ে আসেন। শরীরটা নিয়ে যা খুশি তাই করেন। সমাজ ভুল বোঝে, ভুল ব্যাখ্যা করে, ভুল ভাবে তাঁর আচরণকে ব্যবহার করে।
এক সময় তিনি সরে আসেন, বা প্রত্যাখ্যান করেন সমাজটাকে। খুঁজে নেন নিজেকে প্রকাশের অন্য শিল্পমাধ্যম। ওড়িশি নাচের কিংবদন্তি হয়ে, একটা গুরুকুল স্টাইল আশ্রম গড়েন নিজে হাতে। নৃত্যগ্রাম। এক টুকরো নিজের আকাশ। তার পর এক দিন সন্ন্যাস নিয়ে নেন, নাম বদলে হয়ে যান প্রতিমা গৌরী, মাথাও মুড়িয়ে ফেলেন! হয়তো তরতাজা ছেলের আত্মহত্যা তার একটা কারণ। কিন্তু শুধুই কি তাই? না কি এটাও বিবৃতি? যে, এই নির্বোধ সমাজের কোত্থাও থাকবই না আমি। নিজের মতো আছি, কারও ক্ষতি তো করিনি, তবু অন্যরা নাক গলায় কেন? হয়তো এই গভীর বৈরাগ্য নিয়েই ১৯৯৮ সালে হিমালয়ে পাড়ি দেন প্রতিমা। আর মানসরোবরে তীর্থযাত্রার পথে, এক পাহাড়িয়া ধসে হারিয়ে যান। সব আলোচনার বাইরে।
প্রতিমা... অন্তত আপনার ওই দূষণমুক্ত দুনিয়াটা যদি পাওয়া যেত! ওখানে রাত বারোটায় মেয়েরা একা বাড়ি ফেরে নিশ্চয়ই। |
|
|
|
|
|