‘তুই নিষিদ্ধ, তুই কথা কইস না’

তসলিমা নাসরিন
স্বাধীনতা মানে কী, জানি আমি। স্বাধীনতার প্রয়োজন আমি অনুভব করি প্রতিটি মুহূর্তে। আমি একা থাকি, কী দোকা থাকি, কী হাজার মানুষের ভিড়ে থাকি, আমার স্বাধীনতা আমি কাউকে দান করি না বা কোথাও হারিয়ে ফেলি না। স্বাধীনতা এবং অধিকারের কথা লিখি আমি, যা লিখি তা বিশ্বাস করি।’ যে মুহূর্তে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেন তসলিমা নাসরিন, সেই মুহূর্তেই তিনি আপন মৃত্যুবাণ সমর্পণ করেন তাঁকে ঘিরে থাকা সমাজের হাতে, যে সমাজ তাঁর স্বদেশে বসতি করে, তাঁর ভাষায় কথা বলে, এবং তাঁকে নির্বাসন দেয়। নাঃ, নির্বাসন শব্দটা বড় সাধু, বড় পবিত্র। তসলিমার সমাজ তাঁকে মারের ভয় দেখিয়ে, মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে, ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দেয়।
কেন? তসলিমা ‘নষ্ট মেয়ে’, তাই? কিন্তু সমাজ যাদের নষ্ট মেয়ে বলে চিহ্নিত করে, নিন্দা করে, উঠতে-বসতে গঞ্জনা দেয়, এক প্রান্তে ঠেলে দেয়, তাদেরও তো সচরাচর তাড়িয়ে দেয় না। যে নারী স্বাধীনতা চায়, সমাজ তাকে ছলে বলে কৌশলে দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যায়, পায়ের তলায় দলে পিষে দাবিয়ে রাখতে তৎপর হয়, কিন্তু পায়ের তলায় রাখবার জন্যেও তো ধরে রাখতে হয়, হয়তো বা বেঁধে রাখতে হয়, দূর করে দিলে তো আর শাসন করা যায় না! তসলিমা নাসরিন কী এমন সমস্যা, যাকে কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয়, তবে শান্তি? তাঁর আসল অপরাধটা কোথায়?
যারা তসলিমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যারা বলে তাঁকে দেশে থাকতে দেওয়া যাবে না, তাদের কাছে এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে না। ঠিক ঠিক উত্তর মিলবে তাঁদের কাছে, যাঁরা তসলিমার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন, হয়তো কেবল প্রকাশ নয়, মনে মনে দুঃখ অনুভবও করেন, কিন্তু বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গেই বলেন, ‘কী আর করা যাবে? মেয়েটা কেন যে দুমদাম ওই সব কথা বলে দেয়!’ অর্থাৎ, মনের কথাগুলো মনের মধ্যে রেখে দিলেই তো আর কোনও গোল ছিল না, সে ধর্মের ব্যাপারেই হোক আর চেনাজানা নানা পুরুষের ব্যাপারেই হোক। সব কথা কি হাটের মধ্যে বলতে হয়?
ময়মনসিংহের মেয়ে পিঠ সোজা করে ঘাড় বাঁকিয়ে জবাব দেবেন: কেন নয়? না-ই যদি বলব, তবে কীসের স্বাধীনতা, কীসের লেখালিখি? তাঁর সাফ কথা, ‘নিজেকে যদি উন্মুক্ত না করি, নিজের সবটুকু যদি প্রকাশ না করি, বিশেষ করে জীবনের সেই সব কথা বা ঘটনা যা আমাকে আলোড়িত করেছে, যদি প্রকাশ না করি নিজের ভালমন্দ, দোষ-গুণ, শুভ-অশুভ, আনন্দ-বেদনা, উদারতা-ক্রূরতা, তবে আর যাই হোক, সেটি আত্মজীবনী নয়, অন্তত আমার কাছে নয়। কেবল সাহিত্যের জন্য সাহিত্যই আমার কাছে শেষ কথা নয়, সততা বলে একটি ব্যাপার আছে, সেটি আমার কাছে খুব মূল্যবান।’
সততা। বড় পবিত্র শব্দ। এবং বড় দুঃসহ। কিশোরী কন্যা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জানতে পারল, তার বাবা রাত্রি আড়াইটের সময় রান্নাঘরে রেণুর মা’র বিছানায় আপন সহধর্মিণী দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছেন। সেই মেয়ে বড় হয়ে আপন জীবনকথা লিখতে বসে সেই সত্য গোপন রাখবে? সততা বলবে, ‘না’। ভালবেসে বিয়ে-করা প্রেমিক কবির সঙ্গে সহবাসের সময়ে ডাক্তারি-পড়া মেয়ে যদি জানতে পারে তার যৌনব্যাধির কথা, তার আত্মকথার অঙ্গ হবে না সেই চোখ-ফোটার কাহিনি? সততা বলবে, ‘আলবাত’। এমন আরও বহু বহু ‘গোপনীয়’ কথা অকপটে বলে দেয় যে মেয়ে, সমাজ তাকে ঘরে রাখে কী করে? এই সমাজ? যেখানে যাবতীয় ময়লা কাপড় সঙ্গোপনে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখাটাই দস্তুর? শালীনতা? ভদ্রতা? সভ্যতা?
কিন্তু তসলিমা তো নিজেকেও আড়াল করেননি! অন্তত এমন অনেক কথাই নিজের সম্বন্ধে লিখেছেন, যার জন্য সাহস লাগে। সততাও। প্রতারিত হওয়ার পরেও প্রেমিকের কাছে ফিরে গিয়েছেন, সেই অমোঘ আকর্ষণের কোনও ‘যুক্তি’ খাড়া করেননি, বরং সে আকর্ষণের দৈহিকতাকে খুব জোরের সঙ্গে স্থান দিয়েছেন তাঁর লেখায়। ধর্মদ্বেষী আখ্যা দিয়ে তাঁকে বিতাড়িত করা হয়েছে, শুভার্থীরা পরামর্শ দিয়েছেন বাক্সংযম পালনের জন্য, তিনি জানেন সে পরামর্শ না শুনলে তাঁর সমস্যা বাড়বে, যে স্বদেশে ফিরতে না পারার তাঁর তীব্র যন্ত্রণা, সেই স্বদেশ তাঁর কাছে দুর্গমই থেকে যাবে, তবু তিনি সংযত হন না, এমনকী অতি বড় শুভানুধ্যায়ী তাঁর পাণ্ডুলিপি থেকে ‘আপত্তিকর’ অংশ বাদ দিয়ে প্রকাশকের কাছে পাঠালে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং পরবর্তী লেখায় সেই ক্ষোভের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। তসলিমা অন্যের প্রতি নির্মম, নিজের প্রতিও।
তসলিমার অনেক কথাই হয়তো ঠিক নয়, গ্রহণীয় নয়। কিন্তু কাছে রেখেও তো প্রতিবাদ করা যায়, তিরস্কার করা যায়, তাড়িয়ে দিতে হবে কেন? আশ্চর্য, এই সমাজ তসলিমার সঙ্গে বিশেষ কোনও তর্কই করেনি, হয়তো মেয়েদের সঙ্গে তর্ক করতে এই পুরুষ-সমাজের সম্মানে বাধে। তার চেয়ে অনেক সহজ এবং অনেক পৌরুষোচিত মেয়েটাকে দূর করে দেওয়া। নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যায়।
তবে হ্যাঁ, তারও গভীরে আছে আর এক সত্য। তসলিমা নাসরিন সেটা জানেন। লিখেছেন তিনি, ‘যতক্ষণ একটি মেয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায়, যখনই সে দুর্বল এবং যখন তার দুঃসময়, ততক্ষণই তার জন্য মায়া জাগে, ততক্ষণই তাকে ভাল লাগে। আর যখনই মেয়েটি আর অসহায় নয়, অত্যাচারিত নয়, যখনই সে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, নিজের শরীরের এবং মনের স্বাধীনতার জন্য সমাজের নষ্ট নিয়মগুলো ভাঙে, তখন তাকে আর ভাল লাগে না, বরং তার প্রতি ঘৃণা জন্মে।’ যে সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে এই লেখা, তার নাম: তুই নিষিদ্ধ, তুই কথা কইস না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.