আইন লঙ্ঘন যে দুষ্কর্ম, তাহা নূতন কোনও তথ্য নহে। আইন লঙ্ঘনের ঘটনাকে ধিক্কার প্রদান কর্তব্য, নানা স্তরে সে কর্তব্য পালিতও হয়, তাহাতে আইনভঙ্গকারীগণ কত দূর নিরুৎসাহিত বোধ করেন, তাহা অনুমানের বিষয়। সমান্তরাল ভাবে, আরও একটি প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। আইনভঙ্গের প্রতিবাদ করিলে প্রতিবাদীর উপর ভীতিপ্রদর্শন, অত্যাচার ইত্যাদি। সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় ইহা দেখা গিয়াছে। ইহাও নূতন কিছু নহে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করিলে ললাটে পুষ্পস্তবক না-থাকিবারই সম্ভাবনা প্রবল। সমস্যা হইল, অন্যায়কারীর আস্ফালন সম্প্রতি ঈষৎ বাড়িয়া গিয়াছে বলিয়া অভিযোগ। কলিকাতার উপকণ্ঠে বিবেকানন্দ সেতুতে একটি পণ্যবাহী গাড়ি লইয়া সম্প্রতি বিতর্ক সৃষ্টি হইয়াছিল। কর্তব্যরত পুলিশকর্মীটি থানায় অভিযোগ দায়ের করিয়াছেন। একই ভাবে, সন্নিহিত বালি এলাকাতেও কর্তব্যরত পুলিশের উপরে জনতা হামলা করিয়াছে বলিয়া অভিযোগ।
দুইটি ঘটনার ভিতর কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ‘আক্রান্ত’গণ অভিযোগ করিয়াছেন, দুইটি ক্ষেত্রেই আইন ভাঙিয়া কোনও কাজ করিতে চাওয়া হইয়াছিল। অনুমতি না-দিবার ফলে ‘আক্রমণ’ বা ‘শারীরিক নিগ্রহ’ ঘটে। অভিযোগ অনুযায়ী, একটি ক্ষেত্রে আক্রমণকারী জনৈক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তি, এবং জনৈক প্রভাবশালী মন্ত্রীর গৃহে একটি ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের জন্যই গাড়িটি আইন ভাঙিয়া সেতু পার হইতেছিল। অন্য ঘটনায়, জনতাই আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছিল বলিয়া দাবি। অর্থাৎ, অভিযোগ মানিলে বলিতে হয়, শাসক এবং শাসিত-এর ভিতর এই ক্ষেত্রে বিশেষ ফারাক নাই। ইহার প্রতীকী তাৎপর্যটি সহজবোধ্য। শাসক হউন বা শাসিত, সমাজেরই সন্তান। আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা একটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হইলে শাসক এবং শাসিত, দুইয়ের উপরেই তাহার প্রভাব পড়িবে, ইহাতে বিস্ময়ের কারণ নাই। উদ্বেগের কারণ আছে। আশঙ্কারও। কোন অভিযোগের ক্ষেত্রে সত্যই কী ঘটিয়াছিল, অভিযুক্তগণ সত্যই কত দূর দোষী, সে সবই প্রমাণসাপেক্ষ বিষয়। প্রবণতাটি ভীতিপ্রদ। ক্রমবর্ধমানও বটে। সম্প্রতি একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে, শব্দদূষণের প্রতিবাদ করায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চূড়ান্ত হয়রানি, শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হইতে হইয়াছে। অর্থাৎ, যিনি আইনভঙ্গের প্রতিবাদ করিতেছেন, তাঁহার পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাঁহাকে যথাযথ নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ। ইহা হয়তো সরাসরি প্রশাসনিক গাফিলতি নহে, কিন্তু ইহাই দেখাইয়া দেয়, আইনের শাসন জুলুমবাজদের রুখিতে পারিতেছে না। এই বিষয়গুলিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবিলে ভুল হইবে। এইগুলি দেখাইয়া দেয়, প্রশাসনিক তৎপরতা যে মাত্রায় থাকা উচিত ছিল, তাহা নাই। একই সঙ্গে, নাগরিক চেতনাও যে আঙ্গিকে থাকা বিধেয়, তাহাও অনুপস্থিত। দুইটি লক্ষণই ভীতিকর। যে নাগরিক আইনভঙ্গকে কার্যত দুষ্কর্ম বলিয়া জ্ঞান করেন না, নিজস্ব সুবিধা ও সুখের জন্য আইন ভাঙিতে এবং অন্যের অসুবিধা ঘটাইতে দ্বিধা করেন না, অবিলম্বে তাঁহার যথাযথ সহবৎ শিক্ষা প্রয়োজন। কে দিবে সেই শিক্ষা? প্রশাসনিক আধিকারিকগণ আইন বলবৎ করিতে গিয়া আক্রান্ত হইয়াছেন বলিয়া অভিযোগ। একটি ক্ষেত্রে অভিযোগের সহিত রাজ্যের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নামও জড়িত। ইহাই, এক অর্থে, প্রশাসনিক অসহায়তাকে প্রমাণ করে। অন্য দিকে, জনতাও এই অন্যায়ের দায় এড়াইতে পারে না। একটি ক্ষেত্রে গণ-অভিযোগ ইহাই যে, কর্তব্যরত সংশ্লিষ্ট কর্মী অসদাচরণ করিয়াছেন। অভিযোগ প্রমাণসাপেক্ষ, কিন্তু যদি তর্কের খাতিরে ধরিয়াও লওয়া হয় যে, এমন কোনও অসদাচরণের কাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহা হইলেও কেন তাহার জন্য অন্য একটি অন্যায়কে মানিয়া লইতে হইবে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনকে ইহা ভাবিয়া দেখিতে হইবে। নাগরিক সমাজকেও। |