রাজ্যে ইনফোসিস প্রকল্প ঘিরে ক্রমশ আরও ঘন হচ্ছে অনিশ্চয়তার মেঘ।
বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের (এসইজেড বা সেজ) তকমা ছাড়া এ রাজ্যে প্রকল্প গড়লে, কর ছাড়-সহ বিভিন্ন সুবিধা কী ভাবে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে ধন্দে ইনফোসিস। এ দিন আনন্দবাজারকে পাঠানো ই-মেল বার্তায় এই সংশয়ের কথাই জানিয়েছেন সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও গ্লোবাল হেড (কমার্শিয়াল অ্যান্ড কর্পোরেট রিলেশন্স) বিনোদ হামপাপুর। তাঁর বক্তব্য, ‘সেজ’-এর তকমা ছাড়া আর্থিক সুযোগ-সুবিধাগুলি কী ভাবে পাওয়া যাবে, তা দেখতে চান তাঁরা। তার পরেই এ বিষয়ে যা বলার বলবেন। প্রকাশ্যে এ কথা বললেও এসইজেডের তকমা নিয়ে রাজ্য সরকারের টালবাহানায় দেশের অন্যতম অগ্রণী এই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ক্ষুব্ধ বলেই শিল্পমহলের খবর।
ইনফোসিস পা রাখলে, বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে রাজ্যের ভাবমূর্তি যে উপকৃত হবে, তা বিলক্ষণ জানে রাজ্য সরকারও। যে কারণে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এই ব্র্যান্ড এবং তার হাত ধরে ২০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগকে ধরে রাখতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই তৎপর শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সমস্যা হল এসইজেডের বিরুদ্ধে তৃণমূলের ঘোষিত অবস্থান। তাঁর কথায়, “এসইজেড নিয়ে আমাদের অবস্থান সর্বজনবিদিত। তাই ওই আবেদন আমরা কেন্দ্রের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারি না।” কিন্তু কোনও এসইজেডের যাবতীয় আর্থিক সুযোগ-সুবিধার দায় কেন্দ্র বহন করলেও, সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের সুপারিশ ছাড়া ওই তকমা দেয় না কেন্দ্র।
তাই এ ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান থেকে না সরেও ইনফোসিসের লগ্নি ধরে রাখতে তিনটি সম্ভাব্য সমাধান সূত্রকে সামনে রেখে এগোতে চাইছে রাজ্য এক, সংস্থাকে দেওয়া বিগত বাম সরকারের নথিপত্রে এসইজেড সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি।
দুই, বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের তকমার জন্য সুপারিশ না করেও রাজ্য স্তরে যাবতীয় আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।
এবং তিন, কোনও ভাবে রাজ্যের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছাড়াই এই প্রকল্পকে কেন্দ্র যদি এসইজেডের তকমা দেয়, তা হলে তার বিরোধিতা না করা।
কিন্তু এর কোনওটিতেই এখনও সমাধানের পথ বেরোয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর।
২০১০ সালের নভেম্বরে সমঝোতাপত্র সই না করে সরাসরি ‘অ্যালটমেন্ট লেটার’ তুলে দেওয়া হয় ইনফোসিস কর্তৃপক্ষের হাতে। হিডকো সূত্রে খবর, ওই চিঠিতেই এসইজেড তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আগের বাম সরকার। কিন্তু সমস্যা হল, শুধু ওই চিঠির দৌলতে বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের তকমা পাওয়া শক্ত। এ প্রসঙ্গে পার্থবাবুর দাবি, কোনও নিগম সরকার হয়ে উঠতে পারে না। তাই তকমা পেতে শুধু ওই চিঠি যথেষ্ট নয়। এবং একই কথা জানিয়েছে কেন্দ্রও।
তা ছাড়া, এসইজেডের তকমা পেলে যে সুযোগ-সুবিধা কেন্দ্র দিতে পারে, তা রাজ্যের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। কারণ, পরিষেবা কর, শুল্ক, কোম্পানি কর ইত্যাদিতে ছাড় পায় বিশেষ আর্থিক অঞ্চল। যা দেওয়ার এক্তিয়ার রাজ্যের নেই।
প্রশ্ন থাকছে রাজ্যের সুপারিশ ছাড়া কেন্দ্রের অনুমোদন পাওয়ার আশা নিয়েও। এই নিয়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করা যে তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়, তা স্পষ্ট জানিয়েছেন পার্থবাবু। কিন্তু রাজ্য যদি প্রকল্পের ফাইলই কেন্দ্রের কাছে না পাঠায়, তা হলে কোন নিয়মে অনুমোদন দেবে কেন্দ্র? মন্ত্রীর অবশ্য দাবি, চিঠি না পাঠালেও কেন্দ্রের কাছে দরবার করতে নিজের দফতরের সচিবকে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
ইনফোসিসের প্রকল্প নিয়ে এই টালবাহানায় কিছুটা অবাক শিল্পমহল। তাদের মতে, মূলত দু’টি কারণে ‘সেজ’-এর বিরোধিতা করে রাজনৈতিক দলগুলি। এক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক লপ্তে অনেকটা জমির প্রয়োজনীয়তা।
আর দুই, শ্রম-আইন মানার বাধ্যবাধকতা না-থাকায় সেখানে কর্মী বা শ্রমিকদের বঞ্চনা এবং কাজের অনিশ্চয়তা।
কিন্তু শিল্পমহলের মতে, এই দু’টির একটিও এখানে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কারণ, ইনফোসিসকে জমি দেওয়ার কাজ ইতিমধ্যেই সারা। আর এ ধরনের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় যে সব কর্মী কাজ করেন, তাঁদের কাজের অনিশ্চয়তা তো দূর অস্ৎ বরং মোটা মাইনে দিয়েও ধরে রাখাই সমস্যা। ফলে অনেক উৎপাদন শিল্পের মতো শ্রমিকদের বঞ্চনার সুযোগ এখানে নেই।
একই মতের শরিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকমও। ইনফোসিস মুখপাত্রেরও দাবি, “তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে প্রধান পুঁজি মেধা সম্পদ। তাই চাকরি ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ায় ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’-এর সুযোগ নেই এখানে।”
তবে এ নিয়ে অবশ্য এখনও হাল ছাড়তে নারাজ পার্থবাবু। তিনি বলেন, “বেঙ্গালুরু গিয়ে নারায়ণমূর্তির সঙ্গে কথা বলে এসেছি। ব্যবস্থা কaরেছি প্রকল্পের জমি দ্রুত হস্তান্তরেরও। আমাদের আশা, ইনফোসিস এখানে প্রকল্প তৈরি করবে।” |