রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
ডক্টর গাঙ্গুলি

কে এই মিসেস গাঙ্গুলি, আমায় কিছু জানাতে পারো? সে নাকি এর মধ্যেই ফার্স্ট লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি পাশ করে ফেলেছে আর আগামী মার্চ মাসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। এই তরুণী বিয়ে করে ফেলেছে, ডাক্তার হবে ঠিক করার পরে! তার পর অন্তত একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যদি না দুটো জন্মে থাকে। কিন্তু ছুটি নিয়েছিল মাত্র ১৩ দিন, আর শুনছি নাকি একটাও লেকচার মিস করেনি!


কথাগুলো লিখেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, সেই বিলেতে বসে, তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুর প্রতি চিঠিতে। কলকাতার মেয়ে কাদম্বিনী যে কতখানি আলোড়ন ফেলেছিলেন দেশ-বিদেশে, এ থেকে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। চমকে দেওয়ার মতো কাজ করেছিল বই কী মেয়েটি গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েটের সে এক জন, কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রথম মেয়ে ডাক্তার, আবার সে-ই ছিল প্রথম মেয়ে যে ভারতীয় কংগ্রেসে ভাষণ দিয়েছে। বিলেত গিয়ে ডাক্তারি ডিগ্রি এনেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় গাঁধীর আন্দোলনের জন্য টাকা তুলেছেন, কলকাতায় মহিলাদের জাতীয় সভা করেছেন, নীলরতন সরকার-প্রাণকৃষ্ণ আচার্যের মতো দুঁদে ডাক্তারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্র্যাকটিস জমিয়েছেন কলকাতায়, নেপালে। বাংলার মেয়েদের শিল্পকৃতি নিজের উদ্যোগে সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন মার্কিন মুলুকের প্রদর্শনীতে। বিয়ে করেছেন প্রেম করে, অন্য জাতের পাত্রকে। ন’টি ছেলেমেয়ে মানুষ করেছেন, তাদের বিয়ে দিয়েছেন, নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার করেছেন পুরোমাত্রায়।
কাদম্বিনী রেনেসাঁস যুগের নারী তো বটেই, কিন্তু সেখানেই যেন তিনি থেমে নেই। এই একবিংশতে এসে যে মেয়েরা ঘর-দফতর-সোশাল ওয়ার্ক সামলাতে হিমশিম, কাদম্বিনীকে তাদের বড় আপন মনে হবে। এই হল অরিজিনাল ‘সুপার মম’ যে সংসার-সন্তান সামলেও পেশায় সফল, আবার সমাজ-রাজনীতিতেও সক্রিয়। এমন মেয়েদের আজও সবাই একটু আড়চোখে দেখে, মুখে সৌজন্য দেখিয়ে মনে মনে বলে ‘বেশি বেশি।’ তা হলে কাদম্বিনীর সম্পর্কে তাঁর সমকালের মনোভাব কেমন ছিল, আন্দাজ করা যায়। গোঁড়া হিন্দুদের তো কথাই নেই, একটি বাংলা খবরের কাগজের এক সম্পাদক স্বচ্ছন্দে তাঁকে ‘বেশ্যা’ লিখেছিল। কাদম্বিনী তখন ডাক্তার, পাঁচ ছেলেমেয়ের মা। ছাড়েননি সম্পাদককে, মামলা করে জেল খাটিয়েছিলেন ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালকে। কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের মানুষদের মধ্যেও তাঁর অবস্থানটা যেন আলগোছে সম্ভ্রমের। হয়তো তাঁর স্পষ্টবাদিতার জন্য, প্রবল ব্যক্তিত্বের জন্য কিংবা স্রেফ ব্যস্ততার জন্য, তাঁকে ঠিক কোনও দলের মধ্যে পাওয়া যায় না।
শোনা যায়, দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর ছয় নম্বর গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়িটির ছাদে রবীন্দ্রনাথ মাঘোৎসবের গান শেখাতে আসতেন, গান গলায় তুলে নিতে আসতেন যে যুবকরা তাঁদের মধ্যে ছিলেন নরেন্দ্র দত্ত, বেহালা হাতে বসতেন উপেন্দ্রকিশোর। এক দিকে ঠাকুর বাড়ি, যার সদস্যদের মধ্যে সরলা ছিলেন কাদম্বিনীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অন্য দিকে রায়চৌধুরী পরিবার, উপেন্দ্রকিশোরের স্ত্রী বিধুমুখী কাদম্বিনীর সৎকন্যা। সে সময়ে সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতিতে যাঁরা অগ্রগণ্য, তাঁদের সকলেরই পরিচিতি ছিল কাদম্বিনীর পরিবারের সঙ্গে তিনি আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্মিকাদের এক জন। দুঁদে ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষের আত্মীয়া, ‘অবলাবান্ধব’ সম্পাদক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী। সে সময়ের কোনও নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে তাঁকে ফেলাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় নয় দশক পেরিয়ে এসে মনে হয়, তিনি একক জ্যোতিষ্ক। একেই তো সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন অনেকও কেবল ডাক্তারি বলে নয়, মেয়েদের পেশাদার কর্মী হিসেবে দেখতে সমাজ রাজি ছিল না এই সে-দিনও। লীলা মজুমদারের আত্মকথায় পাওয়া যায়, তাঁর মেয়ে-বন্ধুদের শান্তিনিকেতনে পড়ানোর অনুমতি যদি বা মিলত, মাইনে নেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। মেয়েরা রোজগার করবে? ছিঃ! তাঁর সময়ের যে সব কাজ মানুষকে ‘পপুলার’ করত স্বদেশি আন্দোলন, সমাজ-ধর্ম সংস্কারের চেষ্টা, আগুনে লেখালেখি, সে সব কিছুই কাদম্বিনী করেননি। তিনি স্নেহময়ী মাতৃমূর্তি নন, আত্মত্যাগী সন্ন্যাসিনীও নন। সশস্ত্র বিপ্লব করেননি, অনশন-অরন্ধন করেননি, আবার বনেদি জমিদার গিন্নির ইমেজও তাঁর নয়। তাঁর ছবিটা এই রকম টাট্টুঘোড়ায় টানা ফিটন চেপে এক মহিলা যাচ্ছেন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, রোগী দেখতে। হাতে কুরুশ-কাঠি, অপূর্ব লেস বুনছেন রাস্তায়। বিধবা বড় ননদের জন্য হিন্দু মতে রান্না করছেন, আবার বিহার, ওড়িশায় খনিমজুর মেয়েরা কেমন আছেন, তা সরেজমিনে দেখে রিপোর্ট দিয়েছেন সরকারকে। এমন মেয়েকে ঠাহর করা সহজ নয়।
রবীন্দ্রনাথ-প্রফুল্লচন্দ্রের সার্ধশতের সেলিব্রেশন শেষ হতে চলল, বিবেকানন্দের শুরু হয়ে গিয়েছে। এত ঘনঘটার মাঝখানে কাদম্বিনী প্রায় বিস্মৃত। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ তাঁকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছে, মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররাও তাঁর স্মরণে বক্তৃতার আয়োজন করেছিল জানুয়ারিতে। জন্মদিন উদযাপনের সেই আয়োজনে দেখা গেল কাদম্বিনী আজও সাদরে, সসম্মানে গৃহীত হননি। মেডিক্যাল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ কাদম্বিনীর জীবনালেখ্যর মাঝখানেই প্রতিবাদ করে কক্ষ ত্যাগ করলেন। কেন বলা হল কাদম্বিনীকে মেডিক্যাল কলেজের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট? এ কি ইতিহাসের বিকৃতি নয়?
কী ছিল কাদম্বিনীর ইতিহাস? কে এই মিসেস গাঙ্গুলি, যে আবারও ইতিহাস পড়তে বাধ্য করে?
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী
কাদম্বিনীর জন্ম সেই সময়ে, যখন বাংলার সমাজ ক্রমশ মেনে নিচ্ছে যে মেয়েদের পড়াশোনা বোধ হয় আর রোখা গেল না। বেথুন সেই ১৯৪৯ সালেই বালিকা বিদ্যালয় খুলে ফেলেছেন কলকাতায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চারটি জেলায় বেশ কয়েকটি মেয়েদের ‘মডেল স্কুল’ খুলেছেন। কিন্তু ষাটের দশকের গোড়াতেও ইস্কুলে গিয়ে পড়ার চাইতে, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে ‘অন্তঃপুর শিক্ষার’ চল ছিল বেশি। কলকাতায় তখন হাজার দুয়েক মেয়ে স্কুলে যেত, তারা বেশির ভাগই প্রাথমিকের ছাত্রী।
কাদম্বিনী অবশ্য কলকাতায় জন্মাননি, তাঁর জন্ম ভাগলপুরে, ১৮৬১ সালে। তাঁর বাবা ব্রজকিশোর বসু সেখানকার স্কুলে পড়াতেন, কিন্তু ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে দেশের প্রথম ‘মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তা হলে হবে কী, কাদম্বিনীর মায়ের নাম কোথাও পাওয়া যায় না। চোদ্দো বছর বয়সে কাদম্বিনী আসেন কলকাতায়, ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন। একদল তরুণ তুর্কি ব্রাহ্ম এই স্কুল খুলেছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। মেয়েরা দর্শন, অঙ্ক, বিজ্ঞান পড়লে তাদের নারীত্ব নিয়ে টানাটানি হবে, এমন কথা মানতে রাজি ছিলেন না দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো মানুষরা। মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল খোলা হল, সেখানে বিলিতি কায়দায় কাঁটা-চামচ দিয়ে খাওয়া, কিন্তু রান্না করতেও শিখতে হয় মেয়েদের। ক’দিন পরে সেই স্কুল মিলে গেল বেথুন স্কুলের সঙ্গে। কাদম্বিনী ও তার এক সহপাঠিনী এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন বেথুন থেকে।
সেই থেকেই কাদম্বিনীর ইতিহাস তৈরির শুরু। গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তখনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় দরজা খোলেনি মেয়েদের জন্য। কাদম্বিনী সেই দরজা তো খুললেনই, উপরন্তু মেয়েরাও যে বিজ্ঞান পড়তে পারে, তার নিদর্শন রেখে রীতিমতো চমকে দিলেন। সাহেব ভাইস চ্যান্সেলার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে তাঁর বক্তৃতায় বললেন, কাদম্বিনী কেবল যে বাংলা আর ইতিহাসে ভাল নম্বর পেয়েছেন তাই হয়, পেয়েছেন বিজ্ঞানেও, যে বিষয়টি মেয়েদের বুদ্ধির পক্ষে সুবিধেজনক বলে মনে করা হয় না। কাদম্বিনী তখনই ডাক্তারি পড়তে চেয়ে মেডিক্যাল কলেজে আবেদন করলেন, হল না। শেষে বেথুন কলেজ থেকে (তাঁর জন্যই কলেজ খোলা হল বেথুনে) বি এ পাশ করে আবার আবেদন করলেন। এ বার তাঁকে নিতেই হল মেডিক্যাল কলেজের নিয়মই ছিল, বি এ পাশ করলে যে কেউ বিনা খরচে মেডিসিন পড়তে পারবে। নিয়মটা করা হয়েছিল সব জাতের জন্য কলেজ খোলা রাখতে। ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী তার সুযোগ নিয়ে দরজা খুলে দিলেন মেয়েদের জন্য। আবার সেই বছরই, ২১ বছর বয়সে বিয়ে করলেন বিপত্নীক দ্বারকানাথকে।
একটা মেয়ের নিজের পছন্দের বিয়ে, নিজের পছন্দের কেরিয়ার। সে যে কত আশ্চর্য, আজ তা ঠাহর করা কঠিন। দুটো চিঠির দিকে একটু চোখ রাখলে বোঝা যায়। প্রথম চিঠিটি বাবু নীলকমল মিত্র, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ বন্ধু, লিখছেন এক সরকারি কর্তাকে, ১৮৭৫ সালে। তিনি তাঁর নাতনিকে ডাক্তারি পড়াতে চান, কিন্তু ‘মেয়েটিকে চিক বা পর্দার আড়াল থেকে নোট নিতে দেওয়া হবে কি? আর মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের সময়ে পুরুষ সহপাঠীদের থেকে অন্য ঘরে, তার স্বামী বা আমার উপস্থিতিতে, তা করতে দেওয়া হবে কি? বর্তমানে হিন্দু সমাজ মানবদেহের কিছু কিছু অঙ্গ নিয়ে অপরিচিতদের সামনে মেয়েদের কাজ করতে দেবে না।’ অন্য চিঠিটি লেখা ১৮৮৭ সালে (যখন কাদম্বিনী মেডিক্যালের ফাইনাল ইয়ারে)। মুম্বইয়ের রুক্ষ্মাবাই চিঠি লিখছেন পন্ডিতা রমাবাইকে। মদ্যপ, অত্যাচারী স্বামীর বাড়ি রুক্ষ্মাবাই ত্যাগ করেছেন, স্বামী ‘রেস্টিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস’ আইনে মামলা করেছে, মুম্বইয়ের হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চ রায় দিয়েছে, রুক্ষ্মাবাইকে ফিরে যেতে হবে স্বামীর কাছে। রুক্ষ্মাবাই আদালত অবমাননার দায়ে কারাবাস মেনে নিচ্ছেন। লিখছেন, ‘এই চিঠি পৌঁছনোর আগে আমাকে জেলে ভরা হবে, কারণ আমি জাস্টিস ফারান-এর আদেশ কিছুতেই মানব না।’
কাদম্বিনীর মেডিক্যাল কলেজে ঢোকা নিয়ে যে সমাজে সমালোচনার ঝড় উঠবে, এ তো প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু প্রবল বাধা ছিল ডাক্তারদের মধ্যেও। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট ১৮৭৫ সালে লিখেছিল, ‘that females of any kind are fit to be doctors is a very doubtful point.’ সন্দেহ যেন না থাকে, বোধ হয় তার জন্য কিছু সচেষ্ট ছিলেন রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র। মেডিক্যাল কলেজের এই বিলেত-ফেরত শিক্ষকটি আগাগোড়াই কাদম্বিনীর বিরোধিতা করেছিলেন, তিন বছরের শেষে প্রথম পরীক্ষায় তাঁর কাছে ফেল হলেন কাদম্বিনী। এম বি পড়া হল না, সেনেট ‘লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ পড়ার অনুমতি দিল। দু’বছর পর ফাইনাল পরীক্ষায় আবারও একই পরীক্ষক ফেল করালেন, সেনেটের অনুরোধে পুনর্মূল্যায়ন হল, তাতেও পাশ করালেন না। তখন তৎকালীন অধ্যক্ষ ডা. কোটস তাঁর উপর ন্যস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অব দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ উপাধি দিলেন। কাদম্বিনী ডাক্তারি প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স পেলেন, মেডিক্যাল কলেজের ইডেন হাসপাতালে তাঁর চাকরিও হল এই উপাধির ভিত্তিতেই।
কিন্তু কাদম্বিনীর ওই ব্যর্থতাকে এখনও অনেকে বিশেষ গুরুত্ব দেন, তিনি ‘প্রথম মহিলা ডাক্তার’ কি না, তাতে প্রশ্ন তোলা হয় সেই সূত্রেই। এর একটা উত্তর আইনের দিক থেকে। অধ্যাপক বাণীকুমার ষড়ঙ্গী বলেন, ‘১৯০৬ সাল অবধি মেডিক্যাল কলেজের ডিগ্রি দেওয়ার নিজস্ব ক্ষমতা ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সে ক্ষমতা সরিয়ে নিয়েছে তার পর। সুতরাং ১৮৮৮ সালে দেওয়া ওই ডিগ্রি বৈধ।’
অন্য উত্তরটি দেওয়া হয় কাদম্বিনীর উৎকর্ষের নিরিখে ১৮৯৩ সালে বিলেত গিয়ে মাত্র সাড়ে তিন মাস ক্লাস করার পর তিনি এডিনবারা থেকে এল আর সি পি, এল আর সি এস, এবং গ্লাসগো থেকে এল এফ পি সি উপাধি পেয়ে ফিরে এলেন। এর পর তাঁর ক্ষমতা বা দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন কেন?
কিন্তু কাদম্বিনীর ব্যর্থতার আর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ইতিহাস থেকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি এত তীব্র বিরোধিতা ছিল ব্রিটিশ সমাজে, যে প্রথম যে মেয়েটি চেষ্টা করেছে তাকে প্রায় কখনওই পূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কাদম্বিনীর তিন দশক আগে ইংরেজ মেয়ে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল ইউরোপে কোথাও মেডিক্যাল পড়তে না পেরে আমেরিকার একটা অখ্যাত কলেজ থেকে পাশ করে এলেন। ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন তাকে ১৮৫৯ সালে রেজিস্ট্রেশন দিল, পরের বছরই নিয়ম বদলে বলল, কেবল ব্রিটিশ মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তাররাই রেজিস্ট্রেশন পাবে। এলিজাবেথ অ্যানডারসন ব্রিটেনের প্রথম মহিলা ডাক্তার, কিন্তু কোনও কলেজ তাকে ক্লাস করতে দেয়নি। প্রাইভেটে পড়ে তিনি ডাক্তারি পাশ করার পরের বছরই নিয়ম হল, প্রাইভেটে পড়ে পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। এডিনবারাতে ছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে গেলে ছাত্ররা অপেক্ষা করত, যতক্ষণ না মেয়েগুলি গেটের কাছাকাছি আসে। তারপর তাদের মুখের উপর গেট বন্ধ করে দিত তারা। ছাত্রদের সঙ্গে একই পরীক্ষা দিলেও, এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েরা পেতেন সার্টিফিকেট, ছেলেরা পেতেন ডিগ্রি। বলা বাহুল্য, ওই সার্টিফিকেট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন জুটত না। ভারতে দেখতে পাচ্ছি, কাদম্বিনীর আগে ১৮৭৬ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছিলেন চন্দ্রমুখী বসু, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত ছিল, তাঁর খাতায় নম্বর দেওয়া হলেও উত্তীর্ণদের তালিকায় নাম উঠবে না। পাশ করেও তাই সার্টিফিকেট পাননি চন্দ্রমুখী।
কাদম্বিনীকে মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ডাক্তার বললে ‘ইতিহাসের বিকৃতি’ হয় কি না, সে প্রশ্ন করতে গেলেও বোধ হয় মনে রাখতে হয় যে, প্রশ্ন যখন মেয়েদের নিয়ে তখন ইতিহাস নিজেই বিকৃত। কাদম্বিনীর অবমাননা বিধুমুখী, ভার্জিনিয়ার ‘এম বি’ পাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছিল।
কেমন ছিল মেডিক্যাল কলেজে কাদম্বিনীর জীবন? কী আচরণ সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে, কী ধরনের পিঠ-চাপড়ানি পেয়েছিলেন তিনি? দুঃখের কথা, কাদম্বিনী নিজে তা লিখে যাননি। তাঁর অনেক পরে, ১৯২৫ সাল নাগাদ এক ছাত্রী পড়তে ঢুকেছিলেন। স্মৃতিকথায় তিনি লিখছেন, ‘ইডেন হাসপাতালে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের প্রসব করাতে দেওয়া হত না, অন্য জায়গায় যেতে হত। আমাদের জন্য আলাদা ঘর ছিল না, তাই ইমার্জেন্সি বা নাইট ডিউটির সুযোগ ছিল না। মেয়ে ডাক্তারদের হাউসস্টাফশিপ শুরু হয়নি।’ দুঃখ করছেন, মেয়েদের স্টুডেন্ট ইউনিয়নে নেওয়া হত না। এমনকী রিইউনিয়নের নাটকেও ছেলেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করত।
তার কত দিন আগে, কত বড় এক মঞ্চে কাদম্বিনী পুরুষের ভূমিকায় নেমেছিলেন। পড়াশোনা বা চাকরিতে যত বৈষম্যই থাকুক মেয়েদের প্রতি, নেটিভদের প্রতি, বাজারে তখন দেশি মহিলা ডাক্তারের দারুণ চাহিদা। এমন ছড়িয়েছিল তাঁর খ্যাতি যে নেপাল থেকে ডাক এল রাজমাতার চিকিৎসার জন্য। তাঁকে সারিয়ে কেবল মোটা ফি পেয়েছিলেন তাই নয়, পেয়েছিলেন দু’কুইন্টাল ওজনের রুপোর বাসন (রাজপরিবার থেকে খেতে দেওয়ার পর বাসন ফেরত নেওয়ার নিয়ম ছিল না), দুটো মস্ত হাতির দাঁত, একটা টাট্টু ঘোড়া, আর দেড় বছরের ছেলের জন্য রাজপোশাকের খুদে সংস্করণ। দীর্ঘ দিন নেপালের রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তাঁর, তারপর কবি কামিনী রায়ের বোন ডাক্তার যামিনী রায়কে সেখানে কাজের সুযোগ করে দেন।
মাত্র ৩৭ বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পর কাদম্বিনী দীর্ঘ ২৪ বছর সংসার চালিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেদের মানুষ করেছেন, অসুস্থদের সেবা করেছেন। মৃত্যুর দিন সকালেও একটা অপারেশন করেছিলেন। বাড়ি ফিরে পুত্রবধূকে বলেছিলেন, সেদিন কাজ খুব ভাল হয়েছে। ‘আমার আজ উড়তে ইচ্ছে করছে,’ বলেছিলেন তিনি। স্নান করতে গিয়ে সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়, মারা যান ডাক্তার আসার আগেই। হাতব্যাগে পাওয়া গিয়েছিল সে দিনের ফি ৫০ টাকা।
তাঁর সময়ে কাদম্বিনীকে নিয়ে কাগজে কাগজে অজস্র লেখালেখি হয়েছে। পড়াশোনা, চাকরি খোঁজা, বিলেতযাত্রা, সব কিছুর খুঁটিনাটি বেরিয়েছে কাগজে কাগজে। তবু মানুষটি ঠিক ‘পপুলার’ ছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁকে ঘিরে বারবার বিতর্ক হয়েছে মেয়েরা কী করতে পারে, কী পারে না, কী করা উচিত, কী নয় এ সব ধারণাই তাঁর জন্য নতুন করে ঢেলে সাজতে হয়েছে। কিন্তু তবু তিনি ঠিক কারও রোল মডেল হয়ে ওঠেননি। তাঁর মতো একটা চরিত্রকে মাঝখানে রেখে কেউ নাটক-নভেল লেখেনি, এমনকী নারী আন্দোলনের ইতিহাসেও তাঁর কথা তেমন ভাবে আসে না। বোধ হয় তার কারণ এই যে, কাদম্বিনীর মধ্যেই তাঁর সময় প্রথম দেখেছিল সেই মেয়ে, যার কাছে ঘরের কাজ আর বাইরের কাজে কোনও বিরোধ নেই। পেশার জগতে সে প্রতিযোগিতা করে নিজের জায়গা তৈরি করে, গাঁধীর আন্দোলনের জন্য টাকা তোলে, ডাফরিন হাসপাতালের জন্য ২৪ হাজার টাকা সংগ্রহ করে, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দেয়, আবার পুত্রবধূকে চিঠি লেখে, ‘কাল বিকালেও রাঁধুনি আইসে নাই। আজও ক্যাঁও ক্যাঁও করিয়াছে শরীর ভাল না। কাল আসিবে কি না জানি না।’ মালবিকা কার্লেকর লিখছেন, ঘর-বার সমান ভাবে সামলানোর যে চেষ্টা কাদম্বিনী করেছিলেন তখনকার বাঙালি সমাজে সেটা সমাদর পায়নি। ‘যা প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল তা হল, তিনি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যেখানে এই দুয়ের স্বার্থে সংঘাত হতে পারে। আর ঠিক এই সংঘাতের ধারণাটাই বাঙালি সমাজের অধিকাংশ মানুষ এড়িয়ে চলতে চাইতেন।’
আজও কি তাই নয়? যে সব পেশায় প্রতিযোগিতা তীব্র, যেখানে সংসারের জন্য বরাদ্দ সময়ে টান পড়তে পারে, সেখানে আজও মেয়েরা সহজে এগোতে চায় না। মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসেই দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ দশকে ছাত্রীদের অনুপাত রয়ে যাচ্ছে পাঁচ জনে এক জন। কলকাতায় প্র্যাকটিস করছেন পুরোদমে, এমন মেয়ে হয়তো দশ জনে এক জন।
কাদম্বিনী কি তবে একবিংশের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন?

তথ্যসূত্র: বরুণ চট্টোপাধ্যায় ও প্রবুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়ের ‘কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথ: দায়বদ্ধ দাম্পত্য’ (প্রকাশিতব্য)।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.