অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া দীপশিখা দাম এবং তার সহপাঠী সুদীপ্ত চাকী বুধবার সন্ধ্যায় নিউ ব্যারাকপুরের সাজিরহাটে সুদীপ্তদের আবাসনের পাঁচতলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল একসঙ্গেই।
কিন্তু সুদীপ্তই কি স্কুল ছুটির পরে দীপশিখাকে তাদের আবাসনে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? সাজিরহাটের সুদীপ্তদের আবাসনের ছাদে পাওয়া একটি চিঠি পড়ে এই বিষয়ে সংশয় জেগেছে তদন্তকারীদের। ‘গভীর’ ব্যক্তিগত সম্পর্কের উল্লেখ করে চিঠিতে লেখা হয়েছে শুধু হতাশার কথা। কিন্তু চিঠিটি কার লেখা? মরণঝাঁপ দিতে কে কাকে ডেকেছিল? সংশয় তা নিয়েই।
|
দীপশিখা দাম |
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, দেখে মনে হচ্ছে, চিঠিটির হাতের লেখা সুদীপ্তেরই। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান দীপনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “স্কুল-কর্তৃপক্ষ এবং ওই ছাত্র ও ছাত্রীর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলে পুরো বিষয়টি যাচাই করা হবে। সুদীপ্তের হাতের লেখার সঙ্গে ওই চিঠির হাতের লেখা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।”
বৃহস্পতিবার সকালে তদন্তকারীরা সুদীপ্তদের ফ্ল্যাটে যান। তাঁরা জানান, ফ্ল্যাটের ছাদে রাখা দু’টি চেয়ারের কাছেই চিঠিটি পড়ে ছিল। এক পাতার চিঠি ইংরেজি হরফে লেখা। চিঠির কিছু অংশ ইংরেজিতে আর কিছু বাক্য ইংরেজি হরফে বাংলায় লেখা। চিঠিটি পড়ে তদন্তকারীদের প্রাথমিক অনুমান, সুদীপ্ত সেটি দীপশিখার উদ্দেশেই লিখেছিল। এবং সেটা বুধবার তাদের স্কুল জুলিয়ান ডে-তে বসেই লেখা।
কী আছে ওই চিঠিতে? সংশয়ই বা কেন?
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ওই চিঠিটা এমন ভাবে লেখা যে, মনে হবে কথোপকথন। পাশাপাশি বসে দু’জন একটি চিঠিতে পরপর লিখে কথোপকথন চালিয়েছে। অথচ পুরো চিঠির হাতের লেখা এক জনেরই। তদন্তকারীদের অনুমান, এক জনই দু’জনের কথা লিখেছে। চিঠিতে যা লেখা আছে, তাতে স্কুল ছুটির পরে সাজিরহাটের ফ্ল্যাটে গিয়ে আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা অনেকটাই পরিষ্কার। পুলিশ জানায়, পুরো চিঠিতেই নানান আশঙ্কার কথা লেখা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে ‘গভীর’ ব্যক্তিগত সম্পর্ক উল্লেখ করে চিঠি জুড়ে হতাশার চিহ্ন স্পষ্ট। চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে পুলিশ দুই পরিবার এবং স্কুল-কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলছে।
গঙ্গানগরে সুদীপ্তদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে গিয়েও এ দিন তদন্ত চালানো হয়। বুধবার দীপশিখা ও সুদীপ্ত কোন কোন ক্লাস করেছিল, সেই বিষয়েও খোঁজখবর নেন তদন্তকারীরা। স্কুল-কর্তৃপক্ষ জানান, বুধবার চতুর্থ ঘণ্টায় ছিল পিটি ক্লাস। সুদীপ্ত সেই ক্লাস করেনি। দীপশিখা সেই ক্লাস করতে গিয়ে শিক্ষককে বলে, তার শরীর খারাপ। পিটি ক্লাস করতে পারবে না। সে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। তার পরে দীপশিখা ও সুদীপ্তকে একটি ক্লাসরুমে গল্প করতে দেখেন এক শিক্ষক। ক্লাস না-করে গল্প করায় তিনি সুদীপ্ত ও দীপশিখাকে প্রধান শিক্ষকের ঘরে নিয়ে যান। প্রধান শিক্ষক জিজ্ঞাসাবাদ করে চতুর্থ থেকে সপ্তম ঘণ্টা পর্যন্ত তাঁর ঘরেই বসিয়ে রাখেন তাদের। স্কুল ছুটি হলে তাদের ছেড়েও দেন। প্রধান শিক্ষক এন ম্যাকলামারা বলেন, “ক্লাস না-করে গল্প করার জন্য আমি দু’জনকে আর ক্লাস করতে না-দিয়ে আমার ঘরেই বসিয়ে রাখি। বকাঝকা করিনি। স্কুল ছুটির পরেই ওদের ছেড়ে দিই।”
পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জেনেছে, বুধবার বিকেলে ওই দুই কিশোর-কিশোরী একই সঙ্গে স্কুল থেকে সুদীপ্তের বাড়িতে যায়। দীপশিখাকে নিয়ে সুদীপ্ত সোজা উঠে যায় তাদের আবাসনের পাঁচতলায়। ছাদে থাকা দু’টো চেয়ারের সাহায্যে কার্নিসে উঠে তারা ঝাঁপ দেয়। তদন্তকারীরা জানান, পাঁচতলা থেকে ঝাঁপানো দীপশিখার রক্তাক্ত শরীরের উপরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিল সুদীপ্ত। সুদীপ্ত ও দীপশিখার পড়ার ধরন দেখে প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, পাঁচতলার ওই ফ্ল্যাটের কার্নিস থেকে প্রথমে ঝাঁপ দেয় দীপশিখা। তার পরে ঝাঁপায় সুদীপ্ত। পাঁচতলা থেকে পড়ার সময় ফ্ল্যাটের কেব্ল লাইনে ধাক্কা খায় দু’জনেই। আবাসনের শান বাঁধানো মেঝেতে পড়ায় দু’জনেরই আঘাত মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ জানিয়েছে, সুদীপ্তের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তার ঘাড়ে, মাথায়, কোমর ও পায়ে গুরুতর চোট লেগেছে। এ দিন তার মাথায় অস্ত্রোপচার হয়।
এরই মধ্যে আজ, শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল ও বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চে স্কুলপড়ুয়াদের দৈহিক ও মানসিক শাস্তি সংক্রান্ত মামলাটির শুনানি হবে। এর আগে হাইকোর্ট দৈহিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধের ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে কিছু নির্দেশ দিয়েছিল। সরকার সেই নির্দেশ যথাযথ ভাবে পালন করেনি বলে বৃহস্পতিবার মূল মামলার আবেদনকারী, আইনজীবী তাপস ভঞ্জ ডিভিশন বেঞ্চকে জানান। তিনি বলেন, শাস্তি দেওয়া যে এখনও চলছে, জুলিয়ান ডে স্কুলের দুই ছাত্রছাত্রীর বহুতলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনাই তার প্রমাণ। |