সলমন রুশদির পর তসলিমা নাসরিন। জয়পুরের সাহিত্য উৎসবে ধর্মাশ্রিত কট্টরপন্থীদের হুমকি আমন্ত্রিত সাহিত্যিক রুশদিকে হাজির থাকিতে দেয় নাই। আর প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলিকাতায় পুস্তক মেলার আয়োজকরা তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধনের অনুমতি অনুরূপ হুমকিতে শেষ মুহূর্তে প্রত্যাহার করিয়া লইল। মজার ব্যাপার, এই মেলার প্রেক্ষাগৃহেই আয়োজিত সাহিত্য-উৎসবে মূল আলোচ্য বিষয় হইয়া ওঠে ‘সাহিত্যিকের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার’, যাহা লইয়া বিক্রম শেঠের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সাহিত্যিক রুশদি-কাণ্ডের নিন্দায় মুখর হন। কিন্তু এই নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের কাপুরুষতা রাজস্থানের সহিত পশ্চিমবঙ্গও ভাগ করিয়া লইতে উৎসুক, অন্তত কলিকাতা পুস্তক মেলার আয়োজক এবং রাজ্যের প্রশাসন যে সেই অংশীদারিত্বের জন্য লজ্জিত নয়, ইহা প্রকট হইয়া গিয়াছে। ইহাই কলিকাতার লজ্জা, সারা পশ্চিমবঙ্গের লজ্জা, বাঙালির লজ্জা।
মেলার উদ্যোক্তারা প্রথমে প্রেক্ষাগৃহ ‘অপ্রস্তুত’ থাকার অজুহাতে তসলিমার গ্রন্থ ‘নির্বাসন’-এর প্রকাশ-অনুষ্ঠান বাতিল করেন। পরে তাঁহাদের সাফাই-- সংখ্যালঘুদের একটি সংগঠন এই প্রকাশনা বিষয়ে আপত্তি জানানোতেই তাঁহাদের ওই সিদ্ধান্ত। তসলিমার রচনা সংখ্যালঘু ভাবাবেগ আহত করিয়া জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিতে পারে, এই যুক্তি মেলা-উদ্যোক্তারা যেমন মানিয়া লইয়াছেন, তেমনই পুলিশ প্রশাসনের তরফেও এই বিষয়ে উদ্যোক্তাদের সতর্ক করিয়া দেওয়া হয়। পাঁচ বছর আগে তসলিমাকে কলিকাতায় তাঁহার আশ্রয় হইতে নির্বাসিত করা হইয়াছিল। তাহার পশ্চাদ্বর্তী উদ্যোগ যে সংখ্যালঘুদের কোনও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ছিল না, কায়েমি স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী ও রাজনীতিকদের সংগঠিত চক্রান্ত ছিল, তাহা মনে করিবার বিলক্ষণ কারণ আছে। এ বারের ঘটনাও সংখ্যালঘু সমাজের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ পিরতিবাদ বলিয়া মনে করিবার কোনও হেতু নাই। আম সংখ্যালঘু জনসাধারণ যদি কোনও পুস্তক বা তাহার রচয়িতা সম্পর্কে এ ধরনের অসহিষ্ণুতা পোষণ করিতেন, তবে একই দিনে মেলা-প্রাঙ্গণের মধ্যেই ‘নির্বাসন’ একটি স্টল হইতে প্রকাশিত ও বিক্রীত হইতে পারিত না। লক্ষণীয়, সেখানেও আপত্তিকারী কিছু লোক গোল পাকাইবার চেষ্টা করে, কিন্তু সমবেত বইপ্রেমীদের প্রতিরোধে তাহাদের অপচেষ্টা বানচাল হইয়া যায়।
মেলা-কর্তৃপক্ষের অবিশ্বাস্য ভীরুতার লজ্জাকে কতকাংশে ম্লান করিতে পারিয়াছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সাহসী কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আগ্রহে মেলা-প্রাঙ্গণ হইতেই বইটি প্রকাশের গৌরব। কিন্তু তাহাতে ভিন্নমত পোষণের স্বাধীনতাকে কট্টরপন্থীদের কাছে বন্ধক রাখার সার্বিক লজ্জা হইতে উদ্যোক্তা ও প্রশাসন অব্যাহতি পাইবে না। প্রশ্ন উঠিবে, তবে কি মুষ্টিমেয় বিপথগামী উগ্রপন্থীই অতঃপর শাসনপ্রণালীর এজেন্ডা স্থির করিয়া দিবে আর প্রশাসন তদনুযায়ী চলিবে? জনসাধারণের মতপ্রকাশের, ভিন্নমত পোষণের কিংবা শুনিবার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক দায় কি নির্বাচিত সরকার পরিচালিত প্রশাসনের নাই? তসলিমার বই যদি কাহারও আপত্তিকর মনে হয়, গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ করুক। কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গকে স্থির করিতে হইবে, সে গণতন্ত্রে স্থিত থাকিবে, না যূথবদ্ধ অন্যায়ের নিকট আত্মসমর্পণ করিবে? এই আত্মসমর্পণ কিন্তু সর্বনাশের পথিকৃৎ। |