বামফ্রন্টের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলি বিষবৃক্ষ রোপিত হইয়াছিল। সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার তাহার মধ্যে একটি। রাজ্যের সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডের সূত্র আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বাঁধিয়া রাখিবার মর্মান্তিক দায় বামপন্থীদের ছিল। ফলে, ১৯৮১ সালে সরকারি কর্মচারীদের সার্ভিস রুল পরিবর্তন করিয়া তাঁহাদের ট্রেড ইউনিয়ন করিবার অধিকার দেওয়া হয়। সহজ সমীকরণ ট্রেড ইউনিয়ন তাঁহাদের রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকিবে, সেই সুবাদে কর্মীরাও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের খাস হইবেন। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু জানাইয়াছেন, এই অধিকারটি বাতিল করা হইবে। শ্রমমন্ত্রীর কথাটি যুক্তিসিদ্ধ। ট্রেড ইউনিয়নের এমন কিছু অধিকার আছে, যাহা সরকারি কর্মচারীদের থাকিতে পারে না। তাঁহারা সরকারি অনুমতি ভিন্ন মিটিং-মিছিল করিতে পারেন না, সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিতে পারেন না, ধর্মঘট করিতে পারেন না। ট্রেড ইউনিয়নের এই অধিকারগুলি রহিয়াছে। ফলে, সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করিতে দিলে তাহা স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত হয়। নিজেদের রাজনৈতিক দায়ের চাপে এত বিষয়ে মাথা ঘামাইবার অবকাশ বামপন্থীদের ছিল না, তাঁহারা দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকেই ধ্রুব মানিয়াছিলেন। বর্তমান সরকার যে সেই পথে হাঁটিতে অস্বীকার করিয়াছে, তাহা সুলক্ষণ।
প্রশ্নটি সরকারি কর্মীদের আন্দোলনের অধিকার হরণের নহে। তাঁহারা নিজেদের মধ্যে অরাজনৈতিক সঙ্ঘ গঠন করিতে পারিবেন না, কনভেনশন ডাকিতে পারিবেন না এমন কথা কেহ বলে নাই। বস্তুত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসিয়া একাধিক বার সরকারি কর্মীদের সহিত বৈঠক করিয়াছেন, তাঁহাদের দাবি মানিয়া মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি করিয়াছেন। তাহার জন্য রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকিবার প্রয়োজন পড়ে না। সমস্যা ট্রেড ইউনিয়নের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসাবে রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশ লইয়া। ছাত্র হইতে শ্রমিক, যেখানেই ইউনিয়ন গঠিত হইয়াছে, সেইখানেই তাহা রাজনৈতিক দলের অনুবর্তী হইয়াছে ইহাই পশ্চিমবঙ্গে নিয়ম। তাহা হইবার কারণ নাই। পেশা রাজনীতির ক্ষেত্র নহে। বরং, রাজনীতির অনুপ্রবেশ যে কোনও সমস্যাকে একটি ভিন্ন মাত্রায় লইয়া যায়, এবং তাহার সমাধান ক্রমেই অধরা হইতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কথাটি বিলক্ষণ জানেন। সরকারি কর্মীরা তাঁহাদের অসুবিধার কথা, অসন্তোষের কথা অবশ্যই প্রকাশ করিবেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই করিবেন। সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটির রূপ কী হইবে, তাহা সময় বলিবে। কিন্তু, তাহার জন্য কোনও রাজনৈতিক দলের সাহায্যের প্রয়োজন নাই। গণতন্ত্র মানেই যে রাজনৈতিক দল নহে, এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রধানত যে পথে হাঁটিতেছিলেন, তাহাতে সংশয় জন্মিতেছিল যে তিনি বুঝি বামপন্থীদের জনমোহনের রাজনীতির উত্তরাধিকারই বহন করিয়া চলিবেন। অন্তত এই একটি সিদ্ধান্ত বিপরীত এবং স্বস্তিজনক ইঙ্গিত দিল। সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করিবার অধিকার কাড়িয়া লওয়ার সিদ্ধান্তটি যে জনপ্রিয় হইবে না, সেই কথাটি তিনি বিলক্ষণ জানেন। জানিয়াও যখন তিনি এই পথে হাঁটিতে সাহস করিয়াছেন, তখন ক্ষীণ আশা জাগে বাম জমানার অন্যান্য বিষবৃক্ষগুলির মূলোচ্ছেদ করিতেও তিনি দ্বিধা করিবেন না। ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। তিনি বর্গার ভুল সংশোধনের মাধ্যমে কাজ আরম্ভ করিতে পারেন। বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসিয়া জমির মালিকানার প্রশ্নটিকে ঘাঁটিয়া ফেলিয়াছিলেন। জমির যিনি মালিক, তিনিই একমাত্র মালিক হইবার অধিকারী। চাষ করিলেই যে মালিকানার অধিকার জন্মায় না, এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন। পঞ্চায়েতে রাজনৈতিক নির্বাচন আর একটি ভুল। বিধানসভার নিম্নে কোনও স্তরে রাজনৈতিক নির্বাচন হইতে পারে না। বামপন্থীরা তাঁহাদের দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উল্লাসে এই নীতির তোয়াক্কা করেন নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুলগুলি সংশোধন করিয়া দিন। |