দুর্নীতির জেরে অন্ধকারাচ্ছন্ন টেলিকম ক্ষেত্রে কি অবশেষে ‘সুখের দিন’ আসতে চলেছে? নাকি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো মোবাইল ব্যবসাতেও বিদেশি বিনিয়োগ আসা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হল?
টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টনে সুপ্রিম কোর্ট ৯টি টেলিকম সংস্থার ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়ার পরে আজ সারা দিন এই প্রশ্নটাই ঘুরে বেড়ালো শিল্পমহলে। বিশেষ করে মোবাইল পরিষেবা ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী ও অংশীদারদের মধ্যে। ইউরোপ ও আমেরিকায় মন্দার জেরে দেশের বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে মনমোহন সরকার। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও তা স্থগিত রাখতে হয়েছে মনমোহন সরকারকে। আজকের রায়ের পরে মোবাইল ক্ষেত্রেও বিদেশি বিনিয়োগ আসার রাস্তা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াল কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। লাইসেন্স বাতিল হয়েছে যে ৯টি সংস্থার তার অনেকগুলিতেই বিদেশি অংশীদারি রয়েছে। বেশ ক’টি সংস্থা রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে এ দিনই। বিনিয়োগকারীরা অনুকূল কোনও আইনি ফয়সলার জন্য অপেক্ষা করবে, এমন আশা কম। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রভাবে এ দিনই লাইসেন্স বাতিল হওয়া সংস্থাগুলির শেয়ার পড়েছে।
এই অবস্থায় অনেক লগ্নি-বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, এই রায়ের পরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তুলে নেবেন তাদের লগ্নি।
যদিও এর ঠিক উল্টো দাবিই করেছেন কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী কপিল সিব্বল। তাঁর মতে, “বিনিয়োগকরারীদের জন্য আজ সুখের দিন।” সিব্বলের যুক্তি হল: নিলামের মাধ্যমেই যে স্পেকট্রাম বিলি উচিত, সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এ দিনের রায়ে। লগ্নিকারীরাও বুঝতে পারবেন, নিলামের মাধ্যমেই স্পেকট্রাম কিনতে হবে। এ নিয়ে ধোঁয়াশা কেটে যাওয়ার ফলে যে কেউ ভারতে এসে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
সেলুলার অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া-র ডিরেক্টর জেনারেল রাজন ম্যাথুজেরও মত, আপাতত বিদেশি লগ্নিকারীদের উপরে এই রায়ের কোনও প্রভাব পড়বে না। বরং এ দেশের আইন ব্যবস্থা যে যথেষ্টই শক্তিশালী সেই বার্তাই পৌঁছবে তাঁদের কাছে। সরকার স্বচ্ছ নীতি নিতে উদ্যোগী হবে, এমনটাই আশা করবেন লগ্নিকারীরা। তবে নতুন করে যাতে কোনও আইনি জটিলতা তৈরি না হয়, কিংবা কী ভাবে সুষ্ঠু ভাবে গোটা বিষয়টির সমাধান করা যায়, সে ব্যাপারেও সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করেন ম্যাথুজ। ভবিষ্যতেও লগ্নিকারীদের আস্থা ধরে রাখতেই সেটা জরুরি বলে তাঁর মত।
টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টনের পরেই দেশের বাজারে মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার সংখ্যা এক লাফে এক ডজনে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে কে কত সস্তায় পরিষেবা দিতে পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম টেলিকম বাজার হয়ে ওঠে। কিন্তু সস্তায় পরিষেবা দিয়ে গ্রাহক ধরার প্রতিযোগিতায় সামগ্রিক ভাবে ব্যবসার ক্ষতিই হচ্ছিল বলে অনেকে মনে করছিলেন। সস্তায় স্পেকট্রাম কিনে খুব কম সময়ে বড় অঙ্কের লাভ করার জন্য ইউনিটেকের মতো ‘রিয়েল এস্টেট’ সংস্থাও মোবাইল ব্যবসায় ঢুকে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ বার যে-হেতু থ্রি-জি-র মতো টু-জি স্পেকট্রামও নিলামে মোটা টাকায় কিনতে হবে, তাই এমন সংস্থাই এই ব্যবসায় আসবে, যারা দীর্ঘমেয়াদে এই ব্যবসায় থাকতে চায়। বণিকসভা অ্যাসোচেম-এর মতে, যে সব লগ্নিকারী এ দেশে দীর্ঘমেয়াদে লগ্নি করতে ইচ্ছুক, তা দেশি বা বিদেশি যেই হোক না কেন, এই রায় তাদের জন্যই।
কিন্তু বিদেশি সংস্থাগুলির প্রশ্ন, তারা কী দোষ করেছিলেন? তারা তো শুধু এ দেশের সংস্থাগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এবং সরকারি নিয়মই তারা অনুসরণ করেছিলেন। ইউনিটেক ও নরওয়ের টেলনর সংস্থা হাত মিলিয়ে ইউনিনর তৈরি করেছিল। সোয়ান টেলিকম হাত মিলিয়েছিল দুবাইয়ের এটিসালাট সংস্থার সঙ্গে। এর ফলেই বড় অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। আজ ইউনিনর এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমাদের সঙ্গে অন্যায় করা হল। আমরা তো সরকারের পদ্ধতি মেনেই সব কিছু করেছিলাম। সরকারের পদ্ধতিগত ত্রুটির দায় যে ভাবে ইউননরের উপরে চাপানো হল, তাতে আমরা স্তম্ভিত।” আইডিয়া সেলুলার-ও গোটা বিষয়টির দায় কার্যত সরকারের উপরই চাপিয়ে দাবি করেছে যে, তারা নিয়ম মেনেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল এবং পরিষেবা চালু করেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রায়ের ফলে বিদেশি সংস্থাগুলি দেশীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে হাত মেলানোর বিষয়ে অনেক সতর্ক থাকবে। বিরোধী দলের নেতাদের বক্তব্য, সরকারের নিয়ম শিথিল করার জন্য কর্পোরেট সংস্থাগুলিও সরকারের উপর চাপ দিতে ভয় পাবে।
সব থেকে বড় তিনটি মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা, এয়ারটেল, ভোডাফোন ও রিলায়্যান্সের অবশ্য আজকের রায়ের ফলে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ফিচ-এর মতে, এর ফলে বড় সংস্থাগুলি লাভবান হবে। ইউনিনরের মতো সংস্থাগুলি সস্তায় পরিষেবা দেওয়ার ফলে এয়ারটেল, ভোডাফোনও ‘কল রেট’ কমাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এ বার ছোট সংস্থাগুলির ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় তারা দাম বাড়াতে পারবে বলে মনে করছে ফিচ। এই অবস্থায় লাইসেন্স বাতিল হওয়া সংস্থাগুলির সামনে দু’টি পথ খোলা রয়েছে। এক, তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারে। দুই, ফের স্পেকট্রাম কেনার জন্য নিলামে দর হাঁকতে পারে। এ জন্য ছোট সংস্থাগুলি নিজেদের মধ্যে হাতও মেলাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মোবাইল সংস্থাগুলি সুপ্রিম কোর্টের এই রায় পর্যালোচনার জন্য ফের আদালতে আবেদন করে কি না, তা-ও দেখার।
টেলিকম মন্ত্রী সিব্বল যুক্তি দিয়েছেন, “স্পেকট্রাম দুর্নীতি নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পর থেকেই মোবাইল ক্ষেত্র থমকে ছিল এবং বিনিয়োগের জন্য হা-হুতাশ করছিল। এ বার নতুন বিনিয়োগের দরজা খুলে যাবে।” সিআইআই-এর জাতীয় টেলিকম ও ব্রডব্যান্ড কমিটির চেয়ারম্যান কিরণ কার্নিকও জানিয়েছেন, তাঁদের আশা, এর ফলে বছরখানেক ধরে যে অনিশ্চয়তা চলছিল তা দূর হবে। |