|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ... |
|
স্নিগ্ধ শূন্যতায়
মন ভরে যায়
দুই নারী। ভালবাসা। তাড়না। হিংসে। মাঝে বিক্ষত
এক পুরুষ।
অসামান্য পদ্মাপ্রিয়া। নিখুঁত প্রসেনজিৎ।
লিখছেন কোয়েল মল্লিক |
|
|
‘নায়িকা’ দেখেন নিশ্চয়ই রোজ? সানন্দা টিভিতে। এ বার
আরও মন দিয়ে দেখবেন হলফ করে বলা যায়।
কেন না রাজ চক্রবর্তীর এই ধারাবাহিকে এ বার আসছে এমন একটা চরিত্র, ছোটপর্দায় যা হয়তো এই প্রথম দেখবেন বাঙালি দর্শক।
সুধাময়। এই মুহূর্তে ‘নায়িকা’ সিরিয়ালের যাবতীয় সংঘাত যাকে ঘিরে।
কুমোরটুলি লেনের সাবেকি রায় পরিবারের মেয়ে কথার জীবনে নাটকীয় রদবদল ঘটে গেছে বেশ কিছু দিন হল। রুপোলি পর্দায় নায়িকা হয়ে ওঠার দৌড়ে নাম লিখিয়েছে সে। নাটক এখন তুঙ্গে। এখন কথা এক জন পরিপূর্ণ নায়িকা। ধারাবাহিকের এমন একটা টানটান সময়ে এসে পড়ল সুধাময়। চেহারায় চলনে-বলনে আর পাঁচটা বাংলা সিরিয়ালের চরিত্রের থেকে একেবারে ১৮০ ডিগ্রি অন্য রকম সক্রিয় সমকামী এক লাইন প্রোডিউসার যার কাজ শিল্পীদের আর প্রযোজকদের মধ্যস্থতা করানো। একাকিত্বনিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা, নিজেকে বোঝা, নিজের চাহিদা, ভাল লাগা, ভালবাসা, কোথায় যেন অসীমে হাতড়ানো...অনন্ত সেই খোঁজ। তবু কোথাও শূন্যতা। কারও দমবন্ধ লাগে শূন্যস্থান পূরণের অবিরাম এই চেষ্টায়। আবার কেউ যেন সেই শূন্যতার গভীরে ডুবে যেতে ভালবাসে! এই নিয়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘দুই নারী হাতে তরবারি’ অবলম্বনে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর সিনেমা ‘অপরাজিতা তুমি।’
জায়গা আমেরিকা। প্রদীপ (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) আর তার স্ত্রী কুহু (পদ্মাপ্রিয়া জানকীরমণ) আর দুই সন্তানের যথেষ্ট সুখী সংসার। স্বামী প্রদীপকে বারবার দেখা যায় পিয়ানোতে বসে একটা সুর বাঁধার চেষ্টায় মগ্ন। যেখানে সে প্রায়ই হারিয়ে ফেলে সেই সুরের একটা নোট। তার জীবনেরই কোনও নোটকে সে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মনে হয়। স্ত্রী কুহু তার সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ত। তাদের বন্ধু আমেরিকার আর এক বাঙালি দম্পতি। |
|
অপরাজিতা তুমি
প্রসেনজিৎ, পদ্মাপ্রিয়া, কমলিনী, চন্দন, ইন্দ্রনীল, তনুশ্রী, কল্যাণ |
রণজয় (চন্দন রায় সান্যাল) আর ঊষসী (কমলিনী মুখোপাধ্যায়)। রণজয় প্রাণবন্ত এক চরিত্র। জীবনের ভাল মন্দ কিংবা শূন্যতাকে সে সহজ ভাবে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী ঊষসী একাকিত্বে ভোগা নারী। তার সন্তান নেই। সব সময় একটা অসম্পূর্ণতার ভাব।
‘ওভার-সেন্সিটিভ’ ভাবে জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে সামলানোর চেষ্টা করে অবিন্যস্ত এই নারী। একাকিত্বের অন্ধকার যেন তাকে গ্রাস করে। তার স্বামী যেটা পূরণ করতে পারে না। ‘প্রদীপদা’ পারে। প্রেম হয়। একস্ট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার। কুহু দুই সন্তানকে নিয়ে চলে যায় তার বাড়ি যেখানে আছেন তার মা (তনুশ্রী শঙ্কর) বাবা (সুভাষ সরকার) আর কাকা (কল্যাণ রায়), যিনি বহু বছর আগে এক রোড অ্যাক্সিডেন্টের পর মানসিক ভারসাম্যহীন। কুহু স্থির করে, তার দুই সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে সে কিছু দিন নিজের মতো জীবনযাপন করবে। সেখানে সে শুধু নিজের সঙ্গেই একা থাকবে। কিছু দিন শুধু নিজের সুখ, নিজের আনন্দের কথাই ভাববে যেটা এত দিন সংসারের চাপে হারিয়ে ফেলেছিল। এই গল্পের সব ক’টা চরিত্র
আমার ব্যাক্তিগত ভাবে যেন ভীষণ পরিচিত লাগে। বিশেষ করে সেই একাকিত্ব যা খুব গাঢ়। যেটা একা বসেও লাগতে পারে আবার প্রচুর মানুষের ভিড়েও সেই আবেগ অপরিবর্তিত থেকে যায়। এই আধুনিক সমাজে যেখানে সবের জন্য সময় আছে, মূল্য আছে। সেখানে শুধু সময় নেই প্রিয় মানুষের মন বোঝার জন্য। সেটা নাকি গুরুত্বহীন। সময় নষ্ট।
হঠাৎই কুহুর দেখা হয়ে যায় কলেজের পুরনো প্রেমিক ইউসুফ (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত)-এর সঙ্গে। ধর্মের অমিলে তাদের সম্পর্ক অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল। ইফসুফ খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেছিল সমধর্মীয় একটি মেয়েকে। কিন্তু পরে সে উপলব্ধি করে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কুহুর স্মৃতি ফিরে আসে বারবার। সেই বিয়ে টিকে থাকে না তাই। বর্তমানে সে আবার সেই অসমাপ্ত সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে যেন কুহুর সঙ্গে। শুরুতে কুহুর সায় থাকে না। কিন্তু ঘটনাক্রমে যখন তার মন নরম হতে শুরু করে ইউসুফ কুহুর কাছে একটা চিঠি রেখে চলে যায়। সারা জীবনের মতো।
কুহু আবার একা।
হঠাৎ একদিন প্রদীপের ফোন। সে তার সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেতার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
এই সিনেমায় প্রত্যেকে ভীষণ ভাল অভিনয় করেছেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় একেবারে পারফেক্ট প্রদীপের চরিত্রে। যার প্রতিটা অঙ্গভঙ্গিতে একাকিত্ব, শূন্যতা। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হাসপাতালে বসে তার স্ত্রীকে ফোন করার দৃশ্য মনকে ছুঁয়ে যায় গভীর ভাবে।
কমলিনীও যথাযথ।
চন্দন রায় সান্যাল একেবারে নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে উপযুক্ত ভাবে তাঁর সেই প্রাণবন্ত চরিত্রটা নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিছু গম্ভীর দৃশ্যে মজা করার কায়দায় তাঁর সাবলীলতা চোখে পড়ার মতো। পদ্মাপ্রিয়াকে প্রতিটা শটে ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত, সুন্দরী লাগে। একজন অত্যন্ত দৃঢ় এবং শক্তিশালী অভিনেত্রীর প্রকাশ ঘটে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তামিল। কিন্তু তাঁর আমেরিকান ইংরেজি আর অ্যাকসেন্টেড বাংলায় এক বারও মনে হয়নি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনও অভিনয় দেখছি। এক কথায় অত্যন্ত শক্তিশালী এক শিল্পী। সংক্ষিপ্ত চরিত্রে হলেও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত এক জন বাংলাদেশির চরিত্রে দাগ কেটে যান তাঁর অভিনয়ের জোরে। তনুশ্রী শঙ্কর যেখানে মেয়ে কুহুকে জামাইয়ের অসুস্থতার খবর দেনসেই দৃশ্যে তাঁর অভিনয় দর্শককে নাড়া দেবে। কল্যাণ রায়ও মানসিক ভারসাম্যহীন চরিত্রটি সুন্দর ফুটিয়েছেন।
শান্তনু মৈত্রের সুর একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় নিমগ্ন করেছে দর্শকদের। সিনেমাটোগ্রাফার রঞ্জন পালিতের কাজ সম্পর্কে যত ভাল বলব ততই কম বলা হবে। প্রতিটি ফ্রেম যেন নিখুঁত ক্যানভাস। বিশেষ করে যে দৃশ্যে বৃষ্টির রাতে প্রসেনজিৎ পিয়ানোতে বসে। জলের প্রতিবিম্ব যে সারা ঘরে খেলা করে বেড়াচ্ছে...এখনও ভুলতে পারছি না।
শ্যামল সেনগুপ্তর চিত্রনাট্য ও সংলাপ আর অর্ঘ্যকমল মিত্রর সম্পাদনা সুন্দর। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর পরিচালনা অনবদ্য। যদিও গোটা ছবিটা একটু গতি পেলেও পেতে পারত।
ঊষসীর তার ‘প্রদীপদা’কে সিডিউস করার দৃশ্যের আগে তার ব্যক্তিত্বের জটিলতাকে পরিচালক খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন। কুহুর ওপর রাগ মেটাতে তার সুখের সংসারে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছিল ঊষসী। আবার তার একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যও সিডাকশনকেই বেছে নিয়েছিল। রূপই তার তরবারি সেখানে। আর কুহুর তরবারি সে যেন নিজে।
সব মিলিয়ে ‘অপরাজিতা তুমি’ একটা অত্যন্ত সেন্সেটিভ সিনেমা। ছবির চরিত্রদের কষ্ট, ব্যর্থতা, রাগ, হিংসে, অভিমান, আকর্ষণ আর সংযম সবই মনকে নাড়া দেয়। পুরো ছবিটা জুড়ে একটা স্নিগ্ধ শূন্যতার রেশ থেকে যায়।
|
|
|
|
|
|
|