কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমি বিদেশে। সেখান থেকেই শারদীয় সংখ্যার লেখা পাঠাচ্ছি। এখন তো আর পাঠাবার ঝামেলা কিছু নেই। হাতের লেখাই স্ক্যান করে বিদ্যুৎবেগে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যায়। ‘বিদ্যুৎবেগে’ কথাটা এখানেই সার্থক। অন্য কয়েকটা গল্প-কবিতা পাঠাবার পর ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যার জন্য মূল উপন্যাস। সে বারে আমি রামায়ণ নিয়ে একটা কিছু লেখার চিন্তা করেছিলাম। পড়াশোনা করেছি। অনেক বইপত্তরও জোগাড় করেছি। কিন্তু লিখতে বসে, প্যাড সামনে, কলম খোলার পর আমার মনে হল, এই বিষয়টি নিয়ে এত হুড়োহুড়ি করে লেখা উচিত নয়। ক’দিন বাদেই হর্ষ দত্ত খবর পাঠাবে, সাত দিনের মধ্যে শেষ করে দিন। তা হলে এই বিষয়টিকে একেবারে খুন করা হবে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে এই বিষয়টিই তো আমার মাথায় ঘুরছে। ওটাকে বাদ দিয়ে নতুন কী লিখব!
ঠায় বসে বইলাম ঘণ্টা খানেক। আমাদের মগজে নিশ্চয়ই একটা ব্যাঙ্কে অনেক অভিজ্ঞতা ও কাহিনি জমা থাকে। তাই হঠাৎ এখানকার একটা পার্টির কথা মনে পড়ল। তখন ঠিক করলাম, এই বিষয়টি নিয়েই লেখা যাক। এই কাহিনি পুরোপুরিই আমেরিকা-ভিত্তিক। সে দেশে আমি বহু বার গেছি, নিজেও এক সময় থেকেছি, রান্না করে খেয়েছি। সে দেশের বাঙালিদের জীবনযাত্রা ও নানান ধরনের মানসিকতা আমি পুরোপুরি জানি, এই দাবি করব না। কিন্তু বেশ ভালই ধারণা আছে। সেই কাহিনির নাম ‘দুই নারী হাতে তরবারি’।
শারদীয় সংখ্যা বেরোনোর পর কিছু দিন বাদেই, তখন আমি দেশে, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী এসে এই কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করার প্রস্তাব দেয়। অনিরুদ্ধ (ডাক নাম টোনি হিসেবেই সে বেশি বিখ্যাত) ভাল পরিচালক। তার পুরস্কার-প্রাপ্ত ফিল্ম আমি দেখেছি। কিন্তু তার এই প্রস্তাব শুনে প্রথমেই আমি আঁতকে উঠেছিলাম। কারণ, এ কাহিনির পটভূমি পুরোপুরি আমেরিকা। বাংলা ফিল্ম কি আমেরিকায় গিয়ে শুটিং করতে পারে? সে তো অনেক খরচের ব্যাপার!
অনিরুদ্ধ কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সে আমেরিকাতেই পুরোপুরি শুটিং করতে রাজি। এবং সত্যি সত্যি নানান অসুবিধের গাঁট পেরিয়ে টোনি এই ফিল্ম শেষ করেছে এবং তার উদ্বোধনও হয়ে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই আমার ঔৎসুক্য ছিল প্রচণ্ড। ছবি দেখতে দেখতে আমার মন যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। এক আমি এই কাহিনির স্রষ্টা। আর এক আমি চলচ্চিত্রের এক নির্লিপ্ত দর্শক। কাহিনির তো কিছু অদলবদল হয়-ই। কিন্তু এই ছবিতে আমার কাহিনির অনেকটা অংশই অবিকৃতই আছে। এবং দর্শক হিসেবে প্রথম থেকেই আমি মুগ্ধতা বোধ করছিলাম।
উচ্চাঙ্গ চলচ্চিত্রের যা যা গুণ, পরিচালনায় তার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ব্যবহার চোখে না পড়ে পারে না। এবং নিঃসঙ্গতাবোধের সঙ্গে পিয়ানোর বাজনা। যেমন, ফটোগ্রাফির কোমল রং। অভিনেতারা সাবলীল। কিন্তু অতিনাটকীয় নয়। সিনেমা আমার বেশি দেখা হয় না। এই প্রসেনজিৎকে দেখেছি লালন ফকিরের বেশে। এখন তাকে দেখছি আমেরিকার এক সার্থক ব্যক্তিত্ব। আগাগোড়াই চলচ্চিত্রটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। গান ক’টাও চমৎকার।
আমি আরেকটুখানি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই। কাহিনিটি রচনার সময় আমার চেনাশুনো কোনও চরিত্রের আদল যাতে ধরা না পড়ে, তা নিয়ে আমি খুব যত্ন করেছিলাম। উপন্যাসটি ছাপা হওয়ার পর কেউ কোনও অভিযোগও করেননি। কিন্তু ছবিটিতে যখন চরিত্রগুলি উপস্থিত, তারা তো জীবন্ত। সুতরাং তাদের আড়ালে আমার পরিচিতরা কে কে আছে, তা খুবই মনে পড়ে যাচ্ছিল। এটা আর কেউ জানবে না। এই কৌতুক আমি নিজেই উপভোগ করেছি।
|