শনিবারের নিবন্ধ...
গুণে লক্ষ্মী
বিষয়টা আমি খুব নম্র ভাবেই শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বোধহয় শুরুটা ‘হাফ-ডাব্ল’-এর মতো হয়ে গেল। গল্পটা হচ্ছে যে মানসের দু’জন গার্লফ্রেন্ড ছিল। দুই গার্লফ্রেন্ড দুই যমজ বোন। এক জন লক্ষ্মী, এক জন সরস্বতী। লক্ষ্মী ছিল খুব পয়মন্ত টাইপের। ‘তোমার এই কাজটা লেগে যাবে’ বললে মানসের সেই কাজটা বেমালুম লেগে যেত। বৃষ্টির বিকেলে লক্ষ্মীকে সঙ্গে করে বেরোলে ট্যাক্সি পেতে কখনওই অসুবিধে হত না। লক্ষ্মী ছিল একটু পৃথুলা আর বেজায় সুন্দরী। সেখানে সরস্বতীকে মানসের মনে হত মেকানিক্সের মতো জটিল। একটু শীর্ণ, মুখে মাখানো উদাসীনতা, আর তর্কবাগীশ। সরস্বতী যতই ভাল গান করুক, সেই গান শুনলে মানসের বারংবার দীর্ঘশ্বাস পড়ত। মানস সাফল্যের কথা বললে, সরস্বতী শুধু চর্চা আর সাধনার কথা বলত তাকে। বিছানার ব্যাপারেও লক্ষ্মী-সরস্বতীর মধ্যে ছিল দুস্তর পার্থক্য। বিছানায় লক্ষ্মী খিলখিল করে হাসত আর বলত কাতুকুতু লাগছে। ও দিকে সরস্বতী অবিরল অশ্রুধারায় ভেসে যেতে যেতে চিরন্তন প্রেম আর চিরন্তন সার্থকতার কথা বলত মানসকে। মানসের মনে হত সরস্বতীর দৃঢ় বাহুপাশে আবদ্ধ সে অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, মানস লক্ষ্মীকেই বিয়ে করেছিল এবং নামকরা প্রোমোটার হয়েছিল একদিন। সে একটা স্কুল তৈরি করেছিল পিতামহীর নামে, যার হেডমিস্ট্রেস করে দিয়েছিল সরস্বতীকে।
বাঙালি পুরুষ চিরদিনই লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে নিয়ে গোপন দ্বন্দ্বে ভুগেছে। পুরাণে আছে সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী। এক বার সরস্বতী ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, “ত্রিভুবনে একদিন তোমার পুজো বন্ধ হয়ে যাবে।” যে নারী স্বামীকে অভিসম্পাত করতে পারে, সে হেন তেজস্বিনীকে বাঙালি পুরুষের বরাবর ভয় পাওয়ারই কথা। ফলে বৌয়ের জায়গাটা চিরদিনই লক্ষ্মীর মতো মেয়েদের জন্য বাঁধা ছিল। তা হলে সরস্বতী? সরস্বতী হলেন একমাত্র সেই দেবী, যাঁর বন্দনামন্ত্রে রয়েছে, ‘কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।’ দেবী সরস্বতী। মা সরস্বতী কদাচ নয়।










 
বাঙালি পুরুষের অবচেতন কামনা-বাসনার জায়গা এই দেবী সরস্বতী। বাঙালি ‘সেনসুয়ালিটি’র শ্রেষ্ঠতম প্রতীক। সরস্বতী হলেন বান্ধবী, প্রেমিকা, নিদেনপক্ষে লক্ষ্মীমন্ত বৌয়ের বোন কিংবা কলেজ-ফ্রেন্ড। যার সঙ্গে একটু ফস্টিনস্টিও করা যায়, আবার ‘হুইস্কি অন দ্য রক্স’ হাতে একটা-দু’টো মননশীল বাক্যও আদানপ্রদান করা যায়।
বাঙালি সমাজ সম্ভবত লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর একটা মিলিত রূপ প্রথম প্রত্যক্ষ করল ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে। ভুলে গেলে চলবে না, দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী স্বামীর কোম্পানি বাগানে নিত্য যাতায়াত আর মদ্যপান-মেয়েলোক নিয়ে হইহুজ্জুতিতে তিতিবিরক্ত হয়ে পণ্ডিতদের কাছে বিধান চেয়েছিলেন, তিনি কি এমন স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারেন? আলাদা থাকতে পারেন? অর্থাৎ সে যুগে তিনি সেপারেশন দাবি করেছিলেন। তার পর ঔপনিবেশিক যুগ থেকে এই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আজ পর্যন্ত অনেক ‘রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী’দের দেখা পাওয়া গেছে। লেখাপড়া শিখলে বিধবা হতে হয়, এই মানসিকতার বহু আগেই বদল ঘটে গিয়েছিল। একটা সময় বাঙালি জ্যাঠামশাইরা পাত্রী নির্বাচনে বেরিয়ে পায়ের গড়ন আর গানের গলা উভয় সম্পর্কেই বহুল উচ্চাশা পোষণ করতেন।
তা হলে কি গত একশো বছরের প্রচেষ্টার পরিণতিতে আজকের মেয়েরা নিজেদের মধ্যে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে মিলিয়ে-মিশিয়ে এক করে দিতে পেরেছে? উত্তরটা হল ‘না’। সরস্বতীর মতো যে মেয়েকে দেখলে মনে হবে ভিক্টোরিয়ান কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসে প্রেম নিবেদন করি কিংবা লক্ষ্মীর মতো যে মেয়েকে দেখেই মনে হবে শাখা-সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তুলে নিয়ে যাই এবং ঘড়ার জলের মতো ব্যবহার করিএই দুই জাতের মেয়েরাই বাঙালি পুরুষের চোখের সামনে থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পাঁচালির মতো দেশজ গন্ধমাখা লক্ষ্মী এখন কোনও মেয়েই হতে চায় না, এ কথা ঠিক। ২৫ বা ২৬শে যখন তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসা মনস্থ করে তখন না তারা অনাঘ্রাতা, না কুমারী। নিজের বসন্তের আস্বাদ তখন তাদের নেওয়া হয়ে গেছে। সৎপাত্রে পড়ার আগেই স্বোপার্জিত অর্থে তারা তখন হয়তো হয়ে গেছে একটা হ্যাচ্ব্যাকের মালিক সেল্ফ-ড্রিভেন। এই হয়ে ওঠাটায় সরস্বতীর ওপরই ভর করেছে মেয়েরা এবং লক্ষ্মীর তথাকথিত সংজ্ঞাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেও আসলে মেতে উঠেছে অন্য রকম লক্ষ্মী হয়ে ওঠার সাধনায়। জীবনে আর্থিক স্বাধীনতার শুভকর দিকটা বুঝে নিতে গিয়ে সরস্বতীকে আবাহন করে তার পর পিছনে ফেলে দিয়ে তারা সবাই এ যুগে আসলে লক্ষ্মীর আরাধনায় রত। উজ্জয়িনীর কালিদাসের মতো দেবী সরস্বতীর কাছে বর প্রার্থনা করে তার পর তারা কেটে পড়েছে লক্ষ্মীর সান্নিধ্য পেতে। সরস্বতী আজ শুধু চলার পথের দেবী, যে মন্দিরে পুজো পৌঁছবে, সেখানে মা লক্ষ্মী বিরাজমান।
একটি প্রেসিডেন্সির মেয়েকে চিনি। যেমন তুখোড় পড়াশোনায়, তেমনি তুখোড় গাঁজা খাওয়ায়। অনার্স করে সে গেল দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে পড়তে। আমি তার মুখার্জিনগরের অম্বেডকর হস্টেলে ক’টা দিন গেস্ট হিসেবে থেকে এসেছিলাম। সে বছর প্রেসির অন্তত আট-ন’টি মেয়ে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে অ্যাডমিশন পেয়েছিল। রোজ রাতেই জমাটি আড্ডা হত আমাদের। সে আড্ডায় প্রেম থেকে পার্টি করা, বিজনেস ক্লাসে ট্র্যাভেল করা থেকে শুরু করে ডিজাইনার পোশাক, সব বিষয়েই আলোচনা হত। বাদ থাকত শুধু অর্থনীতি। সে মেয়েটি আমাকে বলেছিল, পিজি তাকে করতেই হবে কারণ সে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে চাকরি করতে চায়। উপার্জনের টাকায় প্রথমেই কিনতে চায় একটা গাড়ি আর যেতে চায় দুবাই শপিং ফেস্টিভ্যালে। দেশ-কাল-সমাজ নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই। আর যারা দেশ-কাল-সময় নিয়ে চূড়ান্ত সংবেদনশীল, সাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্র নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনায় আত্মনিবেদিত, তারাও কিন্তু শেষ অবধি অর্থ-যশ-খ্যাতি ব্যতিরেকে নিজের অগ্রগতিকে স্বীকার করেন না। শুধু চর্চা বা সাধনার কোনও মূল্য নেই। চাই অ্যাপ্রিসিয়েশন। যার অন্য মানেসব অর্থে বিত্তশালী হয়ে ওঠা।
সেক্টরের ফাইভের এক উঠতি কর্পোরেট যুবককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী’ বলতে সে কী বোঝে? “অতি বড় সুন্দরীকেও রোজ দেখতে-দেখতে একঘেয়ে লাগে। আর সরস্বতীসুলভ গুণ নিয়ে আমি কী করব! আমার চাই চাকরি করা বৌ, যে আমার ইএমআই-এর ভার অর্ধেক বহন করতে পারবে। রান্না, খাওয়া, ঘর-গুছোনো? হস্টেল লাইফে ও সব আমার শেখা হয়ে গেছে। ও সব আবার কাজ নাকি!” উত্তর দিয়েছিল ছেলেটি। সম্পূর্ণ নতুন একটা কথা শুনলাম যাদবপুর ইউনিভার্সিটির শ্রী-র মুখে। শ্রী বলল, “ছোট থেকে মাথা পর্যন্ত ডুবে আছে পড়াশোনায়। কী চাপ, কী চাপ! এখনও সেই চাপ চলছে। আমি জানি দুর্দান্ত রেজাল্ট করব, হেভিওয়েট চাকরি করব, প্রচুর-প্রচুর টাকা কামাব, তার পর ৪৫-এ ছেড়ে দেব সব। আর চাকরি করব না, আর রোজগার করব না। দেন আই উইল হ্যাভ অল দ্য ফান! পৃথিবী ঘুরব, ক্রুজে যাব, লাক্সারি হোটেলে থাকব আর কিনব একটা কনভার্টিবল বিএমডব্লিুউ। তার আগে আবধি দাঁতে-দাঁত চিপে লড়াই।” জিজ্ঞেস করলাম, আর বিয়ে, প্রেম, সংসার, সন্তান? “বিয়ে করব ঠিকই, কিন্তু সন্তান? আ বিগ নো, নো! আবার তাদের স্কুল, আবার পড়াশোনা। আই হেট পড়াশোনা।” যে মেয়ের অসাধারণ রেজাল্ট, সে মেয়ে পড়াশোনাকে ঘৃণা করে।
খুব প্রিয়, খুব কাছের একটি মেয়েকে এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করায় সে যা বলল, তার মর্মার্থ হল গুণে লক্ষ্মী হয়ে ওঠাটাই এখন লক্ষ্য। “দেখো, তুমি যখন একটা ফেরারি ওয়াচ পড়ে অডি গাড়ি থেকে নামো, তখন তুমি বুঝিয়ে দাও, তুমি কিন্তু রিসোর্সফুল। তোমার এক ধরনের পাওয়ার আছে। প্রয়োজনে তুমি এই সমাজের কোনও বড় ধরনের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। এই সুরক্ষা একটা ছেলের মতো একটা মেয়েরও অ্যাফোর্ড করতে পারা চাই আজ। টাকাই হল বর্ম।”
টাকাই হল বর্ম। বহু হাজার বছরের আঘাতের স্মৃতি মুছে ফেলতে আজকের মেয়েরা তাই অর্থকেই জীবনে সব চেয়ে প্রাধান্য দিতে শিখেছে। কিছু বিপন্নতা কি এখনও নেই মেয়েদের? কথায় বলে ‘রোলিং স্টোন গ্যাদারস নো মস’। পিছনে ঘুরে তাকানোর সময় নেই। আজকের মেয়েরা রোলিং স্টোন। হ্যাটস অফ!

কন্যে যা ছিলেন কন্যে যা হয়েছেন
•গান শিখলেই চলত। রবিতীর্থ নয়তো দক্ষিণীর ছাত্রী
হলে তো কথাই নেই।
• হাতের কাজ জানতে হত।
• বিদুষী মানে বঙ্কিম, শরৎ, নভেল, নাটকের পোকা।
ম্যাটিনি শোয়ে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখার
অনুমতি পাওয়াটা বিরাট ব্যাপার।
• টাকার হিসেব বলতে ধোপার খাতা আর
লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে খুচরো জমানো।
• রান্না জানে না? বিয়ে হবে না।
• রিয়্যালিটি শো। বঙ্গ সম্মেলনে ডাক।
• সেলাই জানা মানে নিশ্চয়ই নিজের বুটিক আছে।
• বিদেশি ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি। এমএনসি-র চাকরি।
সারাক্ষণ ল্যাপটপ মুখে। নয় তো মোবাইলে চ্যাট।
যদি আইপ্যাড না থাকে।
• নিজের গাড়ি-বাড়ির ইএমআই।
হঠাৎ ইচ্ছেয় তানিষ্কে গিয়ে পছন্দ মতো সলিটেয়ার কেনা।
• রান্না? ওটা সরস্বতী করে।
মাইনে তিন হাজার।

ছবি: আশিস সাহা। মেক-আপ: অনিরুদ্ধ চাকলাদার।
স্টাইলিং: স্যান্ডি। গয়না: ডায়মন্ড ডায়মেনশনস।
শাড়ি: সার্চি। ইলেকট্রনিক গিটার: সনিক বুম।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.