|
|
|
|
স্মরণ ... |
|
মেরি ভি এক মুমতাজ থি
চিঠি পাঠাতেন রোজ একে অপরকে। এক জন সামনে না বসলে অন্য জন
প্রেমের গান গাইতে পারতেন না। সুলোচনা ও মান্না দে। এক অনবদ্য
প্রেমকথা। থেমে গেল ১৮ জানুয়ারি। লিখছেন রূপায়ণ ভট্টাচার্য |
|
|
অ্যায় মেরি জোহরা জবিঁ
তুঝে মালুম নেহি
তু আভি তক হ্যায় হঁসি
ঔর ম্যায় জওয়ান
তুঝপে কুরবান মেরি জান, মেরি জান।
ঝপ করে গানটা শেষ হয়ে গেল।
আমার এক দিকে শুধু তুমি,
পৃথিবী অন্য দিকে।
এই গানও স্তব্ধ মাঝপথে।
প্রতি দিন একটা করে চিঠি দিতেন একে অন্যকে। তখন তো এসএমএস ছিল না, ফোনও না। ওটাই অভ্যেস।
বেঙ্গালুরুর সবুজ পার্কে ঘুরে বেড়াতেন প্রেম করার সময়। কাব্বন পার্ক, লালবাগ...।
বেঙ্গালুরুতেই রোমাঞ্চক বিয়ে।
এবং বেঙ্গালুরুর শ্মশানেই বিলীন হয়ে গেলেন মান্না দে-র প্রেমের গানের প্রাণপ্রতিমা। |
|
বেঙ্গালুরুর কল্যাণনগরের বাড়িতে কিছু আগেও বিকেলে হারমোনিয়ামে বেজে উঠত রবীন্দ্রসঙ্গীত। এক প্রবীণের সঙ্গে গলা মেলাতেন প্রবীণা। ‘লহো লহো তুলে লহো’। ‘হিমের রাতে ওই গগনে’। ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’।
ওই তিনটে গান এক বাঙালি গায়ককে মিলিয়ে দিয়েছিল মলয়ালি তরুণীর সঙ্গে। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপিকাকে। মুম্বইয়ের ফাংশনে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ডুয়েট গাইতে গিয়েই দু’জনের আলাপ।
তাঁর গান থেমে গেছে। যেন মান্নারই সেই বিখ্যাত হিন্দি গীত, ‘মেরি ভি এক মুমতাজ থি’।
এত অসংখ্য প্রেমের গান গেয়েছেন। মান্না দে’র বনলতা সেন বা নীরা কে? কাকে মনে রেখে আজীবন প্রেমের গান গাওয়া? এই প্রশ্নে মান্না ৫৯ বছরের জীবনসঙ্গিনী সুলোচনাকে দেখাতেন। “জানেন, ও আমার জন্য অধ্যাপনা, গান সব ছেড়ে দিয়েছে।” কী গর্ব চোখমুখে!
এইচএমভি স্টুডিওতে শেষতম সিডিতে প্রেমের গান গাইছেন বছর কয়েক আগে। পছন্দ হচ্ছে না নিজের। দূরে বসা স্ত্রীকে বললেন, আমার সামনে এসে বসো। স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে গান শুরু,
‘হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা, বাংলা থেকে সুদূর আমেরিকা
অনেক ঘুরেছি আমি
তবু তোমার মতো কাউকে চোখে পড়েনি, কাউকে মনে ধরেনি।’
এক টেকে গান ও কে।
ফাংশন শুরু করছেন সিডনি বা সিউড়িতে। মঞ্চে ওঠার আগে মান্নার ফোনটা যেত মুম্বই বা বেঙ্গালুরুতে সুলোচনার কাছে। একেবারে আদর্শ স্বামী-স্ত্রী। মনে হত তাঁদের রিং টোন, কলার টিউন এক গান।
‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি, তুমি যে দিয়াছ সবই ভুলায়ে
মুছায়ে দিয়েছ আঁখিজল, কোমল পরশ তব বুলায়ে।’
১৯৫৩ সালে বিয়ের পরেই মান্নার জীবন বদলে যায় দ্রুত।
প্রথম দিকে নায়কের বদলে গান আসত প্রবীণদের লিপে। হতাশ মান্না সে সময় ভেবেছিলেন, সব ছেড়েছুড়ে আশ্রমে চলে যাবেন। সুলোচনার প্রবেশে সন্ন্যাসী হওয়ার ভাবনায় ইতি।
কী ভাবে বাঙালি গায়ক-জীবন বদলে দিলেন মলয়ালি সুলোচনা? বিয়ের আগে ১৯৫০-এ ‘উপর গগন বিশাল’ ছাড়া সুপারহিট গান ছিল না মান্নার। বিয়ের বছরেই ‘হমদর্দ’-এর ‘ঋতু আয়ে ঋতু যায়ে’, ‘দো বিঘা জমিন’-এর ‘ধরতি কহে পুকার কি’, ‘রাত ঔর দিন’-এর ‘রাত গয়ে দিন’ সুপারহিট। প্রথম বাংলা গানও সে বছরেই।
ভীমসেন যোশীর সঙ্গে ‘কেতকী গুলাব জুহি’ গাইতে রাজি নন। “আমি ভীমসেনজিকে হারাব কী করে?” মান্নাকে রাজি করান সুলোচনা।
কিশোরকুমারের সঙ্গে ‘এক চতুর নর’ গাইতে আপত্তি। “আমি কিশোরের কাছে হারব কেন?” মান্নাকে রাজি করান সুলোচনা।
বিখ্যাত মলয়ালম গান ‘মানস মইনে ভরু’র জন্য জাতীয় পুরস্কার মান্নার। হাতে ধরে ধরে স্বামীকে উচ্চারণ শিখিয়েছিলেন সুলোচনা।
মান্নার দুই বিখ্যাত বাংলা গান ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’, ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’ ওয়েস্টার্ন সুর ভেঙে। যে গান প্রেমের সময় শোনাতেন সুলোচনা। মান্নার গানে পাশ্চাত্য প্রভাব স্ত্রীর জন্য। সব গান প্রথমে শুনে রায় দিতেন সুলু। কী বাংলা, কী হিন্দি। সাধে স্ত্রীর মৃত্যুর পরে মান্না বললেন, “সুলু হিসাব কষে আমায় পাল্টে দিয়েছিল। নিজেও হিসেব কষে জন্মদিনেই চলে গেল।”
বছর দুই ধরে ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন। মান্না ঠায় জেগে বসে থাকতেন শিয়রে। স্ত্রী হাসপাতালে গেলে মান্নাও সেখানে পাশের এক বেডে শুয়েছেন। যেতেন সকাল, সন্ধ্যা। এরই নাম প্রেম। ক্রমশ আর জ্ঞান নেই। চিনতে পারছেন না। সঙ্গিনীর সঙ্গ ছাড়তেন না মান্না। ফাংশন বন্ধ। বাকশক্তিহীন স্ত্রীর শিয়রে বসেই হয়তো সুর দিতেন নতুন প্রেমের গানে। গীতিকার দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীকে ফোনে নতুন প্রেমের গানে সুর শোনাতেন, “তোমার জন্য না মেলা হিসেব সহসা মিলে যায়। তোমার জন্য বিবর্ণ ফুল রং আজও ফিরে পায়।”
সুলোচনার ক্যান্সার ধরা পড়েছে সবে। ধর্মতলা স্ট্রিটের নার্সিংহোমে স্ত্রীর পাশে সন্ধ্যা থেকে রাত পাঁচ ঘণ্টা কাটানোর ফাঁকে গানের রেকর্ড করতে গেছেন মান্না। নেতাজি ইন্ডোরে ফাংশন। এই অবস্থায় ওটা না করলে হত না? মান্না কী বলেছিলেন মনে আছে, “সুলু বলেছে, কথা যখন দিয়েছ, গান গাইতে হবে।” সে বারই আর এক দিন। ইনফেকশনের জন্য স্ত্রী হোটেলে বন্দি। রিহার্সালের জন্য মান্না চলে এসেছেন বাড়ি। সেখানে মিউজিক রুমে গাইছেন,
“তোমায় কিছুই বলিনি তো, ভাল বা মন্দ কিছু
কী হল তোমার, বলে যাও’।
আবার ফোন করছেন স্ত্রীকে। ডাক্তারকে।
বিরানব্বইয়ের মান্না দে এখনও সুর তোলার চেষ্টায় হারমোনিয়ামে। নতুন সুর আসছে। সুরের সঙ্গে সুলোচনা। আর হয়তো ২৫ বছর আগে মান্নার গাওয়া সেই গান
‘এই সেই ঘর, সেই জানলা যাতে সুচে ফুল তোলা....
জয়পুরি ফুলদানি, তাতে কিছু শুকনো ফুলের হাসি
সেই বিষ্ণুপুরী ঘোড়া, শান্তিনিকেতনী মোড়া
এ ঘরের যেখানে যা যেমনটি ছিল, সব আছে এই
শুধু তুমি নেই, শুধু তুমি নেই। |
|
|
|
|
|