বিতর্কিত রেডিওগ্রাম নিয়ে সরকারি মহলে হইচই চলছে। চলছে তদন্তও। তবে রেডিওগ্রামে ডিজি-র উদ্ধৃতিতে রাজনৈতিক দলের নামোল্লেখ করার আগে বার্তাপ্রেরক কোন পদস্থ অফিসারকে দেখিয়ে ছাড়পত্র নিয়েছেন, তা রবিবার পর্যন্ত পুলিশকর্তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। রবি ও সোমবার ছুটি থাকায় মঙ্গলবারের আগে এই নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট ডিজি-র কাছে পৌঁছনোর সম্ভাবনাও নেই। এই অবস্থায় ওই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। সরকারি সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই ডিজি-র দফতর থেকে পুলিশের টেলিকম বিভাগের কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগামী দিনে জেলাগুলিতে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক ওই ধরনের কোনও নির্দেশনামা পাঠানোর আগে তা ন্যূনতম গেজেটেড পদমর্যাদার পুলিশ অফিসারকে দেখিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। বিভিন্ন জেলা সদর দফতর থেকে থানাগুলিতে রেডিওগ্রাম পাঠানোর আগেও ওই নিয়ম মেনে চলতে হবে।
এত দিন পর্যন্ত উচ্চপদস্থ কোনও অফিসারকে দেখিয়ে রেডিওগ্রাম পাঠানোর নিয়মটি ছিল। কিন্তু পুলিশ সূত্রেই খবর, সেই নিয়ম মানা হোত না। এত দিন এএসআই বা এসআই পর্যায়ের কেউ দেখে দিলেই বার্তা পাঠানো যেত। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, রেডিওগ্রামে এমন বার্তাই পাঠানো উচিত যা দ্রুত সব জায়গায় পৌঁছনো দরকার। কিন্তু তা না করে রোজই শতাধিক এমন বার্তা যায়, যা রেডিওগ্রামে পাঠানোর মতো জরুরি নয়। অনেক সময় কেউ কাউকে খুঁজলে, এমনকী ছুটি সংক্রান্ত খবরও রেডিওগ্রামের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এই ধরনের বার্তার জন্য যেমন সময় নষ্ট হয়, তেমনই খরচও বাড়ে। বর্তমান ঘটনাটি সামনে আসায় কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু পুলিশের যা কাজের ধরন, তাতে রেডিওগ্রাম তৈরির পরে হাতের কাছে গেজেটেড পদমর্যাদার অফিসারকে না-ও পেতে পারেন টেলিকম বিভাগের সংশ্লিষ্ট বার্তাপ্রেরক। সে ক্ষেত্রে বার্তা পাঠানো থমকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে কথা মাথায় রেখে পুলিশের টেলিকম শাখা ও জেলার কর্তাদের ডিজি-র দফতর থেকে জানানো হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক নির্দেশ রেডিওগ্রাম মারফৎ পাঠানোর আগে টেলিকম বিভাগের বার্তাপ্রেরক যাতে তা গেজেটেড পদমর্যাদার অফিসারকে দেখাতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, গেজেটেড পদমর্যাদার অফিসারদের পর্যায়ক্রমে রেডিওগ্রাম অনুমোদনের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাতে কোনও রেডিওগ্রাম নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেটি কাকে দেখিয়ে বার্তাপ্রেরক পাঠিয়েছেন, তা চটজলদি বোঝা যাবে (বিতর্কিত রেডিওগ্রামের ক্ষেত্রে যা এখনও অবধি খুঁজে পাওয়া যায়নি)। সে ক্ষেত্রে এএসআই, এসআই পর্যায়ের অফিসাররা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ লেখার সময়ে বাড়তি কিছু জুড়ছেন বা বাদ দিচ্ছেন, এমন সম্ভাবনাও অনেক কমে যাবে।
বস্তুত, মেমো নম্বর (আইএস ৩৩৪৭/ডিজি/১২,তারিখ ৩ জানুয়ারি ২০১১) একই হলেও দু’টি রেডিওগ্রামে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নির্দেশের বয়ান ভিন্ন হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় পুলিশ মহল বিব্রত। ডিজি-র পাঠানো নির্দেশনামায় তিনি কোনও দলের নাম না-করে রাজনৈতিক সংঘর্ষ রুখতে জেলার এসপি, ওসি-আইসিদের নির্দেশ দিয়েছেন। সংঘর্ষ রোখার কাজে কোথাও কোনও গাফিলতি ধরা পড়লে ওসি-আইসিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় পর্যায়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু, আইবি-র তরফে ওই একই মেমো নম্বর ও তারিখ উল্লেখ করে পাঠানো রেডিওগ্রামে ডিজি-কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ইত্যাদি জেলায় সিপিএম ‘সক্রিয় হামলাবাজি’ করছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ‘শিকার’ তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকেরা। এ নিয়ে আলোড়ন শুরু হওয়ার পরে এডিজি পদমর্যাদার এক জন অফিসারকে বিস্তারিত তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, আইবি-র রেডিওগ্রামটি পাঠানোর আগে প্রেরক তা কাকে দেখিয়ে অনুমতি নিয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানান, সাধারণত ডিজি-র অফিস বা আইবি-র সদর দফতর থেকে বার্তা সরাসরি টেলিকম বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অয়্যারলেস অপারেটরের দায়িত্বে থাকা অফিসাররা তা হুবহু পাঠিয়ে দেন। এটাই প্রথা। রেডিওগ্রাম-কাণ্ডে কোনও অংশ জোড়া হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ‘অবাঞ্ছিত ও বিতর্কিত’ শব্দ জুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছেই। পুরো ঘটনাটি থেকে শীর্ষ কর্তাদের অনেকেই এখন সেই আশঙ্কা করছেন। স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সে জন্য ডিজি বিষয়টি নিয়ে এডিজি টেলিকমের সঙ্গে কথা বলেন। তার পরেই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনামা বেতারে পাঠানোর আগে গেজেটেড অফিসারের অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেন তিনি।
তবে বিতর্কিত রেডিওগ্রাম রহস্যের কিনারা কবে হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। |