আশপাশের পাহাড় থেকে পাথর নিয়ে আসেন। তারপর সেই পাথর কেটে তৈরি হয় মূর্তি। সঙ্গে থালা, বাটি, চন্দনপিড়ি। এ ভাবেই সংসার চলে হরেকৃষ্ণ পাত্র, অক্কুর সিংহ, তপন সিংহদের। ওঁরা প্রত্যেকে পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা বেলপাহাড়ির বাসিন্দা। প্রত্যন্ত এলাকা। এখানেই কয়েক পুরুষ ধরে পাথরের কাজ চলছে। অক্কুরের কথায়, “পাথরের কাজ করতে পরিশ্রম বেশি। পারিশ্রমিক কম। তা-ও এই পেশা ছাড়ার কথা ভাবতে পারি না। সেই কবে থেকে এই কাজ হয়ে আসছে।” তাঁর বক্তব্য, “গ্রামে সে ভাবে চাষ হয় না। পাথর কেটেই সংসার চলে। এই শিল্পের উপরেই নির্ভর করি।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি। যে নামের সঙ্গে জুড়ে আতঙ্ক। এই জেলায় মাওবাদীদের অন্যতম আদিঘাঁটি। এক সময়ে এখানে কত নাশকতাই না হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলেছে। পাথর-শিল্পীরা জানাচ্ছেন, তাঁদের এলাকায় সে ভাবে অশান্তি হয়নি। কারণ, স্থানীয়দের প্রায় প্রত্যেকেই দিনভর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের তেমন যোগ নেই। এক শিল্পীর কথায়, “কাজের মধ্যে থাকলে ও-সব ভাবনাতেই আসে না।” রাজ্য হস্তশিল্প মেলা চলছে মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে। রাজ্যের প্রতিটি জেলা থেকেই ক্ষুদ্র ও কুটির-শিল্পীরা এখানে তাঁদের পসরা সাজিয়েছেন। জঙ্গলমহল এলাকার শিল্পীদের ‘বাড়তি’ উৎসাহ দেওয়ার জন্য পৃথক স্টলেরও বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এই বিশেষ স্টলেই নিজেদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বেলপাহাড়ির পাথর-শিল্পীরা। সব মিলিয়ে ৮ জনের দল। সকাল হলেই পাথর কাটতে বসে পড়ছেন। চোখের সামনে চলছে কর্মশালা। ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে পাথর কেটে ফুটিয়ে তুলছেন বিভিন্ন মূর্তি। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলছে কেনাবেচা। হরেকৃষ্ণ বলেন, “মেলায় ভালই বিক্রি হচ্ছে। তবে আমাদের স্টলে মূর্তির চেয়ে পাথরের থালা, বাটিই বেশি বিক্রি হচ্ছে।” অনেকে মনে করছেন, মূর্তির দাম অনেক। তাই হয়তো বিক্রি কম হচ্ছে। এক শিল্পী অবশ্য বলেন, “মূর্তি তৈরি করতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। তাই হয়তো দাম একটু বেশিই। কিন্তু এই পাথরের জিনিস বিক্রি করেই তো আমাদের সংসার চালাতে হয়।” |
বেলপাহাড়ির শিমুলপাল, কাশীডাঙ্গা, ডাকাই ও তার আশপাশ এলাকার প্রায় ২৫০ পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মেলায় আসা স্থানীয় মতিলাল সিংহের কথায়, “এলাকায় স্থায়ী হাট থাকলে আমাদের সুবিধা হত। বিক্রির সুযোগ বাড়ত। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগী হওয়া দরকার।” একই মত তপন সিংহের। তাঁর বক্তব্য, “বাজার গড়ে উঠলে স্বাভাবিক ভাবেই বিক্রি বাড়বে।” নিজেদের সুবিধার্থে পাথর-শিল্পীরা সমিতিও গড়েছেন। নাম ‘পাথর শিল্প ও শিল্পী উন্নয়ন সমিতি’। এখন রাজ্যের যেখানেই হস্তশিল্প মেলা হয়, সেখানেই পসরা সাজিয়ে বসেন এই শিল্পীরা। শুধু এ রাজ্যেই নয়, মেলায় যোগ দিতে রাজ্যের বাইরেও গিয়েছেন। এলাকায় বাজার গড়ে তোলা গেলে শিল্পীদের সুবিধা হবে বলে মানছেন জেলা শিল্পকেন্দ্রের আধিকারিকেরাও। সেই সঙ্গে তাঁদের দাবি, ইতিমধ্যেই এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এক আধিকারিকের কথায়, “ঝাড়গ্রামে গ্রামীণ হাট গড়ে তোলার পরিকল্পনা হচ্ছে।” জেলা শিল্পকেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার প্রহ্লাদ হাজরা বলেন, “বাজার গড়ে তোলার পাশাপাশি নতুন শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাও হচ্ছে। এর ফলে সবাই উপকৃত হবেন।”
এই আশ্বাসেই দিনবদলের ‘স্বপ্ন’ দেখছেন হরেকৃষ্ণ-অক্কুররা। |