নিউ ইয়র্ক থেকে মুম্বই। সেখান থেকে নিজস্ব বিমানে আগরা, বৃন্দাবন, দিল্লি হয়ে জয়পুর। এই তাঁর প্রথম ভারতে আসা। “মনে হচ্ছে, দেশটা রঙিন ভিডিও গেমের মতো। উপরে বিশৃঙ্খলা, হইচই। আর নীচে নীরব শান্তি,” বললেন ওপরা উইনফ্রে।
জয়পুর ফেটে পড়ল হাততালিতে।
এখানকার অভিজাত সমাজ গত কয়েক দিন তাঁর অপেক্ষাতেই ছিল। মুম্বইয়ে অমিতাভ বচ্চনের বাড়িতে ঐশ্বর্যা-অভিষেকের কন্যাকে দেখতে গিয়েছিলেন, পার্টি ছিল পরমেশ্বর গোদরেজের বাড়িতে। কিন্তু জনতার সামনে এই তাঁর প্রথম কথা বলা! ওপরা উইনফ্রে তো শুধু টক শো-র প্রযোজক নন, ফোর্বসের কোটিপতি তালিকায় সবচেয়ে ধনী কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা।
শুধুই ধনী? দুনিয়ার সবচেয়ে ‘প্রভাবশালী’ নারী। আফ্রিকাতে শিশুদের জন্য যে ভাবে স্কুল চালান, মার্কিন সংবাদমাধ্যম তাঁকে ‘সবচেয়ে দানশীলা’ বলে উল্লেখ করে। ফুলের কারুকাজ-করা সোনালী রঙের ফিরান, তার উপরে গোলাপী দোপাট্টা জড়িয়ে ‘নমস্তে’ বলে মঞ্চে উঠলেন তিনি। ‘ওয়েলকাম টু ওপরা উইনফ্রে লাইভ শো’!
ডিগ্গি প্রাসাদ ভিড়ে উপচে পড়ছে, বাইরের রাস্তাতেও প্রায় পাঁচশো লোকের ভিড়। এ দিন আলাদা অধিবেশন ছিল শশী তারুর এবং ফতিমা ভুট্টোরও। কিন্তু এই ভিড়ের কাছে সব ম্লান! জনতার চাপে এই প্রথম আধ ঘণ্টার জন্য কাঠের সিংহদ্বার বন্ধ করে দিতে হল। “জীবনে প্রথম তাজমহল দেখলাম।” বললেন মুগ্ধ ওপরা। এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, “আপনাকে যদি কেউ তাজমহল
উপহার দেয়?” “এখানে এসে আমার জীবনটাই তাজমহল বনে গিয়েছে,” জবাব দিলেন ওপরা।
ভারতে আসার ইচ্ছেটা প্রথম জেগেছিল তিন বছর আগে। ‘বন্ধু’ বারাক ওবামা ভোটে জিতে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পর নিজের ঘরে একটি ছবি লাগিয়েছিলেন ওপরা। মরুভূমিতে চলা উটের পিঠে নারী, নীচে লেখা ‘ভারতে স্বাগত’। তখন থেকেই তিনি জানেন, এ দেশে তাঁকে আসতে হবে।
|
জয়পুর সাহিত্য উৎসবে ওপরা উইনফ্রে। রবিবার। ছবি: এএফপি |
আধ্যাত্মিক গুরু দীপক চোপড়ার সৌজন্যেই তাঁর এখানে আসা। নিজস্ব বিমানে ‘গুরু’কে সঙ্গে নিয়েই এসেছেন তিনি। সাহিত্য উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা সঞ্জয় রায় জানালেন, দীপককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁরা। তখন দীপক ওপরাকেও আমন্ত্রণের প্রস্তাব দেন। এই সুবর্ণসুযোগ কোন উদ্যোক্তাই বা ছাড়বেন?
এ দিনও ‘গুরু’র কথা বললেন ওপরা, “ওঁর কাছ থেকে আমি শান্তির সন্ধান পেয়েছি। এ দেশে দেখলাম লোকে ধর্মের কথা বলে না, ধর্মে বাস করে।”
ক্যালিফোর্নিয়ায় ‘প্রমিস্ড ল্যান্ড’ নামে এক বাড়িতে থাকেন ওপরা। মাইকেল জ্যাকসনের ‘জানাডু’র মতোই বিখ্যাত ৪২ একরের সেই বাড়ি। সামনে পাহাড় আর সমুদ্র, দুই-ই। পাহাড় আর সমুদ্রের মতো ভারতের বিচিত্র বৈপরীত্যও প্রথম আগমনেই ধরা দিয়েছে তাঁর চোখে। গরুর গাড়িতে ইস্পাতের রড টেনে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। বললেন এ দেশে তিনি কখনওই গাড়ি চালাতে পারতেন না। ভিড়াক্রান্ত রাস্তাতেও চালকেরা লাল আলোর নির্দেশ মানেন না যে! উৎসবে ফিরান আর দোপাট্টা ছিল বটে। এখানকার সিটি প্যালেসে রাজকন্যা দিয়ার দেওয়া
পার্টিতে কিন্তু পরে গিয়েছিলেন কলকাতার ফ্যাশন-ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের তৈরি শাড়ি।
এত দিন রানি-ঐশ্বর্যা-বিদ্যাকে শাড়ি পরিয়েছেন। ওপরাকে শাড়ি পরানোর অভিজ্ঞতা কেমন? “সবার ক্ষেত্রে দেখতে হয়, যাতে ভিতরের ব্যাক্তিত্বটা ফুটে বেরিয়ে আসে। ওপরার শাড়ি বাছার সময় একটা কথাই মাথায় ছিল। দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল উওম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড,” বললেন সব্যসাচী। “সবুজ জারদোসি আর তার সঙ্গে খাদির কালো ব্লাউজ পরিয়েছিলাম।” মুম্বইয়ে তাঁর বুটিক থেকে ওপরা শাড়ি কিনেছেন, রাজ-অতিথিকে শাড়ি পরানোর জন্যই কলকাতা থেকে উড়ে এসেছিলেন সব্যসাচী। শোনা গেল, ক্লিপ লাগিয়ে কুচি ঠিক করে দিতে হয়েছে।
ভারতীয় ফ্যাশনের ‘শাড়ি’তে ওপরাকে প্রথম মুগ্ধ করেছিলেন ঐশ্বর্যা। অভি-অ্যাশ তাঁর টক শো-তে গিয়েছিলেন। ঐশ্বর্যা তখন শাড়ি পরেছিলেন। “অভি-অ্যাশকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা মা-বাবার সঙ্গে এক পরিবারে থাক কেন? এখানে এসে বুঝলাম প্রবীণদের ভারতীয়রা কতটা সম্মান করে,” বললেন ওপরা। অভি-অ্যাশের কন্যা ‘বেটি বি’কে কেমন দেখলেন? “গর্জিয়াস! চোখবোজা অবস্থাতেও এত সুন্দর!” ওয়াকিবহাল মহলে খবর, ওপরা সেই শিশুকন্যাকে ‘প্রিন্সেস’ নামে ডেকেছেন।
মিসিসিপির দরিদ্র এলাকার অবিবাহিতা কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর কন্যা ওপরা। টক শো-তে এক বার বলেছিলেন, নয় বছর বয়স থেকেই আশ্রয়দাতা কাকা, খুড়তুতো ভাই তাঁকে নিয়মিত ধর্ষণ করতেন।
এ দিন ওপরার সঙ্গে কথোপকথনে সেই প্রসঙ্গটিও উঠেছিল। উত্তরে বললেন, “সারা জীবন আমাকে লড়তে হয়েছে। কাকার সঙ্গে, ভাইয়ের সঙ্গে। শিশুকন্যারা কখনওই নিরাপদ নয়।”
স্পিলবার্গের ‘কালার পার্পল’ ছবির সংলাপ মনে করিয়ে দিলেন ওপরা। শুধু শিশুকন্যা কেন, বৃন্দাবনে বিধবা মহিলাদের দেখে কী রকম ‘শক্ড’ হয়েছেন, সে কথাও বললেন। “এটা অবশ্য শুধু ভারত নয়, সারা দুনিয়ায়। ধনাঢ্য এবং সম্ভ্রান্ত জগতেও দেখবেন, স্বামী মারা গেলে মহিলারা পার্টিতে কম আমন্ত্রিত হন। যেন মৃত্যু ব্যাপারটা ছোঁয়াচে!” রাজকন্যা দিয়া জানাচ্ছেন, পার্টিতেও এ দেশের নারী ও শিশুদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন ওপরা।
আর ওপরা উইনফ্রে-র সঙ্গে সাহিত্যের যোগ? ওপরা উইনফ্রের টক শো-তে কোনও বইয়ের কথা বলা মানেই বেস্টসেলার তালিকায় তার অবধারিত নাম। তাঁর শো-তে ওপরা ‘আনা কারেনিনা’র কথা বলার পরে আমেরিকায় আরও আট হাজার কপি বেশি ছাপতে হয়েছিল।
টলস্টয় থেকে প্রুস্ত, গার্সিয়া মার্কেজ কত লেখকের বইয়ের কথাই যে সেখানে হয়! উইলিয়াম ডালরিম্পল সম্প্রতি চায়ের আসরে বলছিলেন সেই কথাও, “দুনিয়াকে আবার বই পড়া ধরিয়েছেন দুই মহিলা। জে কে রোলিং আর ওপরা উইনফ্রে।”
বইয়ের কথা দিয়েই তাই শেষ হল জয়পুর সাহিত্য উৎসবের ‘ওপরা উইনফ্রে শো’! |