সরকার-বিরোধীদের ‘সংঘাতে’র আবহে আজ, সোমবার ময়দানে উদযাপিত হতে চলেছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১১৬তম জন্মদিন। শুধু ‘সংঘাত’ই নয়, নেতাজি-জয়ন্তী পালনে ‘নাটকীয়তা’র উপাদানও থাকছে যথেষ্ট!
দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে রেড রোডের নেতাজি মূর্তিতে মাল্যদানের সুযোগ তাঁরা পাবেন কি না, রবিবার পর্যন্ত জানেন না বামফ্রন্ট নেতৃত্ব! অন্যান্য বছরের মতো এ বারও রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় নেতাজি জন্মোৎসব কমিটি এক সঙ্গেই রেড রোডের মঞ্চে নেতাজির জন্মদিন পালন করুক, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই মর্মে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ। কিন্তু তিন দিনের মধ্যে অশোকবাবুর দু’টি চিঠির একটিরও উত্তর মুখ্যমন্ত্রী নিজে দেননি। উপরন্তু, পুলিশের তরফে জন্মোৎসব কমিটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত মঞ্চ থাকবে সরকারের হাতেই। তার পরে তা কমিটিকে ছাড়া হবে। এই ‘জটিলতা’র জেরে এ দিনও ঘরোয়া বৈঠকে বসেছিল বামফ্রন্ট। সেখানে ঠিক হয়েছে, প্রতি বছর যে সময়ে মালা দেন, সেই সময়েই মাল্যদান করতে চেয়ে এ দিন কার্জন পার্কে উপস্থিত থাকবেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু-সহ বাম নেতৃত্ব। ‘যথাযোগ্য মর্যাদায় ঠিক সময়ে’ মালা দেওয়ার সুযোগ না-পেলে তাঁরা ময়দান থেকে চলে এসে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে সুভাষচন্দ্রের মূর্তিতে মাল্যদান করে নেতাজি-স্মরণ করবেন।
সরকারি সূত্রের খবর, আজ নেতাজি মূর্তিতে মালা দিয়ে বক্তৃতা করার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। সেই সময়ে অশোকবাবু-সহ বাম নেতারা মঞ্চে থাকবেন কি না, প্রশ্ন তা নিয়েই। কিন্তু অশোকবাবুরা অদূরেই উপস্থিত আছেন জেনে মুখ্যমন্ত্রী যদি তাঁদের ডেকে নেন? অশোকবাবুর বক্তব্য, “রবাহূত হয়ে যাব না! মর্যাদা দিয়ে দুপুর ১২টা ১৫-য় মালা দিতে দিলে ঠিক আছে। না-হলে ওখান থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে গিয়ে সুভাষচন্দ্রের মূর্তিতে মালা দিয়ে অনুষ্ঠান করা হবে।” শাসক শিবিরের বক্তব্য, মালা দেওয়ার ‘মাহেন্দ্রক্ষণ’ নিয়ে অহেতুক ‘জটিলতা’ তৈরি করছেন বামেরা। তাদের বক্তব্য, বাম জমানায় ফব যে হেতু সরকারেরই অংশ ছিল, তাই তাদের প্রভাবিত কেন্দ্রীয় নেতাজি জন্মোৎসব কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠান করা সহজতর ছিল। পরিস্থিতি পাল্টেছে। বাম জমানাতেও বিরোধীদের আলাদা আমন্ত্রণ জানানো হত না। তা হলে এখন বিরোধরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ‘অন্য রকম প্রত্যাশা’ কেন করছেন?
বস্তুত, নেতাজির জন্মদিন পালনের মতো আপাত-নিরীহ অনুষ্ঠান ঘিরে যে আবহ তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক কালে নজিরবিহীন। ঘটনাপ্রবাহে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের ভূমিকায় অত্যন্ত ‘ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত’ প্রবীণ বাম নেতা অশোকবাবু। মুখ্যমন্ত্রীকেই প্রধান বক্তা হওয়ার আবেদন জানিয়ে তিনি চিঠি পাঠান ১৮ জানুয়ারি। তার উত্তর আসেনি। নেতাজি-জয়ন্তী পালনকে ঘিরে ‘বিভ্রান্তি’ নিরসনের আর্জি জানিয়ে তিনি ফের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেন শনিবার। তার জবাব এসেছে রাজ্যের তথ্য অধিকর্তা উমাপদ চট্টোপাধ্যায় মারফত। ‘মর্মাহত’ অশোকবাবু বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধান বক্তা হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাজি জন্মোৎসব কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু এক আমলাকে দিয়ে চিঠির উত্তর দেওয়া হল! দেশপ্রেম দিবস পালন করা হবে কি না, তা নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী কিছু বললেন না। নেতাজির জন্মদিনে এর আগে ইন্দিরা গাঁধী থেকে জ্যোতি বসু পর্যন্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু এখন আবার সঙ্কীর্ণতা দেখা যাচ্ছে!” যে ভাবে ২৩ জানুয়ারির দু’দিন আগে মহাকরণে নেতাজির জন্মদিন পালন করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা (তিনি বলেছেন, মনীষীদের জন্মদিন যে কোনও দিন পালন করা যায়), তাতেও বর্ষীয়ান অশোকবাবু ‘স্তম্ভিত’!
মমতার নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার তথা শাসক শিবিরের সঙ্গে বিরোধীদের ‘সৌজন্যে’র যে বাতাবরণ প্রথম কয়েক মাসে তৈরি হয়েছিল, সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ঘটনার জেরে তা কাটতে শুরু করেছে। তবে মুখ্যমন্ত্রীর মাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন অশোকবাবু। মমতার মাতৃবিয়োগের পরে বিমানবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়িতেও যান। তার কয়েক দিনের মধ্যেই ফব-র রাজ্য দফতরে গিয়ে অশোকবাবুকে পাল্টা ‘কৃতজ্ঞতা’ জানিয়েছিলেন মমতা। বাম শরিকদের প্রতি মমতার মনোভাব যে তুলনায় ‘নরম’, তার ইঙ্গিতও এর আগে একাধিক বার মিলেছে। সেখানে নেতাজির জন্মদিনের মতো ‘অরাজনৈতিক’ প্রশ্নে এমন ‘তিক্ততা’র আবহ তৈরি হল কেন, তা নিয়ে ফব নেতৃত্ব যথেষ্টই বিস্মিত!
ফব-র অন্দরেই একাংশের মত, রাজ্য সরকারের মনোভাবের প্রতিবাদে রেড রোডের অনুষ্ঠানে না-যাওয়াই উচিত। ওই চত্বরে ফব-সহ বাম নেতারা থাকলে ও খোদ মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ডেকে পাঠালে তাঁরা ফেরাতে পারবেন না। তখন আগের সব ঘটনা আড়ালে চলে যাবে। ক’দিন আগেই রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ফব-র যুব সংগঠনের সমাবেশে যুব লিগের রাজ্য সম্পাদক অনির্বাণ চৌধুরী বলেন, “আগের সরকারের মতো এই সরকার নেতাজির জন্মদিন পালন করলে তাতে বাহবার কিছু নেই! কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাজি জন্মোৎসব কমিটির সঙ্গে এই সরকার আদৌ অনুষ্ঠান করতে আন্তরিক কি না, না-আঁচালে বিশ্বাস নেই!”
|