রবিবাসরীয় গল্প
পাঠক প্রতিযোগিতা ‘পরিবর্তন’-এর গল্প
আজ চতুর্থ সূত্রের গল্প
কোর কমিটি
শোক বন্দ্যোপাধ্যায় কল্যাণ গুপ্তকে ফোন করে বললেন, তা হলে তোমাকে কোন কমিটিতে নিল?
কল্যাণ একটু থামল। মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া বের করে কথা বলতে গিয়ে বিষম খেল। দম আটকানো একটা কাশি যেন ফেটে পড়তে চাইছে। সম্ভবত কিছুটা ধোঁয়া শ্বাসনালীতে আটকে গিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটু কষ্ট করেই উত্তর দেয় কল্যাণ, ‘না, এখনও তেমন কোনও খবর নেই।’
সে কী! বাজারে তো খবর তুমি কোনও না কোনও কমিটিতে থাকছ!
কল্যাণ এ বার যেন একটু উৎসাহিত হয়। জানলার কাছে ফোনটা নিয়ে এসে দাঁড়ায়। আকাশে মেঘ। ক’দিন ধরেই টানা বৃষ্টি চলছে। নিম্নচাপ। একটা কাক ভিজে একসা হয়ে ডানা দুটো যতটা সম্ভব গুটিয়ে রাখা যায় সে ভাবে গুটিসুটি মেরে একটা সবুজ জামরুলের ডালে বসে ক্ষীণ কণ্ঠে ‘কা কা’ করে দু’বার ডেকে উঠল। কল্যাণের চোখের লেন্সে কিন্তু মেঘলা আকাশটা তেমন ভাবে ধরা পড়ছে না। সামান্য রোদ্দুরের ঝিলিক। কমিটি! আবার জিজ্ঞাসা করে কল্যাণ, ‘কে বলল আপনাকে অশোকদা?’
সোর্সটা জানতে চেয়ো না।
এই অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। রিটায়ার করেছেন প্রায় বছর পাঁচেক হল। সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু রাজনীতির অন্দরমহলের খোঁজখবর রাখেন। রাজনীতি করা মানুষজনের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক। খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। শব্দ চয়নের মধ্যে কবিতা নেই, কিন্তু কাব্যভিত্তিক বাস্তবতা আছে। কবি সম্মেলন, থিয়েটার উৎসব, রাজনৈতিক কনভেনশন সব জায়গা থেকেই ডাক আসে। কোনও কিছুতেই নেই অথচ সর্বত্র আছি এটা একটা বিরল প্রতিভা, এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। কল্যাণ যেন মোবাইলের কাচটার মধ্যে অশোকদার দাঁত চাপা মুচকি হাসিটা দেখতে পেল।
আপনি কিছু শুনেছেন?
না।
জানেন, বলছেন না। আমি তো কাউকে বলছি না!
জানলে বলতাম। খবরটা ভাসছে তাই মনে হল তোমাকেই জিজ্ঞেস করি।
কল্যাণ এ বার একটু স্তিমিত। এত কাজ করার পরেও সামান্য স্বীকৃতির লোভ কি ওকে পেয়ে বসেছে? একটু যেন অহঙ্কারে লাগে কল্যাণের। কিন্তু ক্ষমতার লোভ মানুষকে মাতাল করে দেয়। মহুয়ার নেশা থেকেও তীব্র যেন এই লোভের মাদকতা। একে জয় করা কঠিন। ও সব মহামানবেরা পারেন। কল্যাণ তো সাধারণ স্তরের এক মানুষ। বলে ওঠে কল্যাণ, ‘আমিও শুনেছি, কোনও না কোনও কমিটিতে হয়তো রাখবে। রাখা তো উচিত। আমার তো সে যোগ্যতা আছে। ডি লিট, চব্বিশটা আন্তর্জাতিক মানের বই, কুড়ি জন ডক্টরেটের গাইড, বিদেশেও...’
হঠাৎ একটা বাজ পড়ে। সেই বাজের শব্দকে ছাড়িয়ে যায় অশোকদার হাসির উচ্চগ্রামের রাগহীন তাল। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় কল্যাণের। লজ্জায়, অপমানে, কুণ্ঠায় কেমন যেন ঝিম মেরে যায় কল্যাণ। আলগোছে বলে, ‘ও ভাবে হাসছেন যে! আমি কি কিছু ভুল বললাম? বাড়িয়ে তো বলিনি কিছু। নিজের কথা এত নগ্ন ভাবে বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি। কিন্তু যা বলেছি তা তো মিথ্যে নয়। সত্যি, সত্যি!’
অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় আর হাসছেন না। রেশটুকুও নেই। এ বার নিরাবরণ গদ্য। মেঘে মেঘে ভেসে এল অশোকদার ভারী কণ্ঠের এক অমোঘ বিদ্যুৎবাণী ‘পরিবর্তনের আগে যারা ছিল তখনও তোমার এ সব কিছুই ছিল। যোগ্যতা, মননের সুন্দর প্রকাশ, একটা সেকেলে অথচ গ্রহণযোগ্য নৈতিক শৃঙ্খলা সবই ছিল। তখন হয়নি কেন কল্যাণ? কমিটির কথা বাদ দাও, বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তো তোমাকে ডাকা হত না! অথচ মানুষ হিসেবেও তো তুমি হার্মফুল নও। তা হলে?’
অশোকদা যেন ক্লাসে পড়াচ্ছেন। সামনে যেন বসে আছে ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার কিংবা থার্ড ইয়ারের ছাত্রছাত্রী। অশোকদা হয়তো ভুলে গেছেন তিনি কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র প্রফেসরের সঙ্গে। এটুকু অ্যালাউ করল কল্যাণ। অশোকদা বলে চলেছেন, ‘তুমি কি মনে করো সবাই তোমার ওপর জেলাস তাই তোমাকে ইগনোর করে, তোমাকে এড়িয়ে চলে? নো, দ্যাটস নট ট্রু। আসলে তোমার পলিটিকাল সোশালাইজেশনটাই হয়নি। এই পৃথিবীতে দুটো পরস্পরবিরোধী শব্দ আছে। প্রথমটা হল ‘কনফিউশন’, আর দ্বিতীয়টা হল ‘কনফেশন’। যারা কনফিউশন শব্দটিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটে তাদের কিছু হয়, আর যারা ‘কনফেশন’-এ বিশ্বাসী তাদের অবস্থাটা অনেকটা সক্রেটিসের মতো। সব কিছু ভাল করার পরেও বিষ পান করতে হয়। অন্তত অশোকদা ওকে রেকগনাইজ করেন এটুকু ভেবেই যেন ভাল লাগে কল্যাণের। তাই বাচ্চা ছেলের মতো কল্যাণ বলে ওঠে, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন অশোকদা। আমিও যে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি, তা কিন্তু নয়। তবে খুব রাগ হয়, যখন মনে হয় যোগ্যতা, মেধা, মনন, ভাবনার ব্যাপ্তির থেকে সত্য হয়ে ওঠে পার্টির একটা কার্ড। ওই কার্ডটাই যেন যোগ্যতার একমাত্র পরিমাপ যন্ত্র, সূচক! ‘হ্যালো! হ্যালো!’

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.