রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
মালকোষ, আশাবরী, ইমন, তোড়ি
ছরের এই একটা সময় কলকাতার হাওয়ায় গমক তান ভেসে আসে, টপ্পার দানার মতো শিশির লেগে থাকে রাস্তার পাশের একচিলতে ঘাসে। কলকাতায় শীত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঋতু। একমাত্র।
এই শহর আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বহু দিন অঙ্গাঙ্গি। কলকাতারই কোনও এক আসরে নাকি জোড়া তানপুরার সঙ্গে আবদুল করিম খান সাহেবের সুর এমন মিলে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল ওস্তাদ বুঝি শুধু হাঁ করে আছেন! আসর অবশ্য ভেঙে পড়েছিল তারিফে, সাধুবাদে। কলকাতার রাস্তাতেই সদম্ভে ঘুরে বেড়াত গওহর জানের ছয় ঘোড়ার গাড়ি লাটসাহেবের বারণকে অগ্রাহ্য করেই। কীসের সাক্ষী নয় কলকাতা? মৌজুদ্দিনের সব হিসেবভাঙা গানের তুবড়ি, কালে খান সাহেবের কোমল রেখাব আশাবরী, আমীর খানের শেষ আসর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কলকাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কম মেশেনি।
আর তার গল্প! ওস্তাদের খামখেয়ালি, শ্রোতার উচ্ছ্বাস এক একটা আসর কিংবদন্তির কম নয়। সেতারি মণিলাল নাগের ঝুলিতে এমন আসরের গল্প স্বভাবতই অনেক। বিষ্ণুপুর ঘরানার পণ্ডিত গোকুল নাগের পুত্র মণিলাল প্রায় প্রাক-কৈশোর থেকে মঞ্চে বাজাচ্ছেন দেশ জুড়ে। প্রায় ছ’দশক হয়ে গেল তাঁর মঞ্চ জীবনের। এক বিকেলে তাঁর কাছে পৌঁছনো গেল। পুরনো আসরের কথা উঠতেই তাঁর মুখে হাসি। বললেন, সে এক একখানা কাণ্ড হত বটে। এক বার আলাউদ্দিন খান সাহেব বাজাচ্ছেন, তবলায় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। খানসাহেব এমনই ঝামেলা আরম্ভ করলেন, জ্ঞানবাবুর মেজাজ সপ্তমে। আলাউদ্দিন খান সাহেব অবশ্য এই কাণ্ডটি প্রায়ই করতেন। কিন্তু সে দিন ঝামেলা থামল না। আসর শেষ করেই জ্ঞানবাবু উকিলের কাছে ছুটেছিলেন, খানসাহেবের নামে মামলা ঠুকবেন বলে। সে এক কীর্তি। বহু কষ্টে তাঁকে নিরস্ত করা গেল!
এই গল্পটা শুনেই আলাউদ্দিন খান সাহেবের আর এক আসরের গল্প মনে পড়ে গেল। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কুদ্রত রঙ্গবিরঙ্গী’-তে আছে। সে আসরে তবলায় আল্লারাখা খান। আলাউদ্দিন খান সাহেব তখন দেশের সর্বমান্য ওস্তাদ, আর আল্লারাখা খান উঠতি তবলিয়া। আসরের প্রায় গোড়া থেকেই তবলার সঙ্গত পছন্দ হচ্ছিল না ওস্তাদের। লয় ঠিক হচ্ছে না। টুকটাক ধমক, গালিগালাজ চলছিলই। এক সময় উঠে আল্লারাখার গালে সোজা এক চড় কষিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন খান। আসর সচকিত। কিন্তু আল্লারাখা নিজের কান মুলে ‘গলতি মাফ করনা উস্তাদ’ বলে ফের ঠেকা ধরলেন। এই ছিল তহজিব, শিষ্টতা। পরে এই গল্প শুনেই নাকি আমীর খান সাহেব বলেছিলেন, আলাউদ্দিন খান খুব বড় ওস্তাদ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর লয়ে নাকি খামতি ছিল!
কথার সুর ধরে নিলেন মণিলাল। বললেন, বাজিয়েছি তো অনেক তবলচির সঙ্গেই। কে ভাল, কে মন্দ সেই মাপ করি না। কিন্তু, উপস্থিত বুদ্ধির কথা যদি হয়, কেরামতুল্লা খান সাহেবের কোনও জবাব নেই। এক বার শ্রীরামপুরে এক আসরে বাজাচ্ছি, খান সাহেব তবলায়। সওয়াল-জবাব চলছে। কী মনে করে আমি তরফের তারগুলো এক বার বাজালাম, কির্ কির্ করে শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে খান সাহেব তবলায় হাতুড়ি দিয়ে আওয়াজ তুললেন। হেসে বললেন, জবাব ঠিক হুয়া না? পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পড়ে মণিলালের মুখে। স্মৃতি হাতড়ান তিনি। বলেন, আশ্চর্য দিলদার ছিলেন কেরামতুল্লা খান সাহেব। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর এ গ্রেড তবলচি, অথচ মাটির মানুষ। আমার তখন কতই বা বয়েস! রেডিয়োয় অডিশন দিতে গেছি। তখনও গার্স্টিন প্লেসে অফিস। সেতার বগলে ঢুকছি, দেখি খান সাহেব বেরোচ্ছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ক্যা বাত হ্যায়, ইঁহা কুছ কাম হ্যায় ক্যা? বললুম, অডিশন দিতে এসেছি। খান সাহেব আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেলেন ভিতরে। অডিশনের ঘরে পৌঁছে নিজে তবলা নিয়ে বসলেন। ভেবে দেখুন কাণ্ড তিনি স্বয়ং কেরামতুল্লা খান, আর আমার মতো এক নাবালকের অডিশনে নিজে বসে পড়লেন তবলায়। এ জিনিস আর হবে না। আর এক বার, আলি আকবর খান সাহেব বাজাচ্ছেন। তবলায় কে ছিলেন, খেয়াল নেই। এখন তো অর্ধেক নাম মনেও থাকে না। যা হোক, সওয়াল জবাব চলছে। বাজাতে বাজাতে সরোদের তার ছিঁড়ল খান সাহেবের। তবলিয়াও তেমনই রসিক। মুহূর্তে হাতুড়ি দিয়ে তবলা ফাঁসিয়ে দিলেন। যেমন সওয়াল, তেমন জবাব।
তবে, সব গল্পেরই এমন মিষ্টি শেষ থাকে না। সেতারি ইমদাদ খান আর তবলচি প্রসন্ন বণিকের কথা মনে পড়বেই। মহিষাদলের রাজা দেবপ্রসাদ গর্গ লিখেছেন সেই মহাযুদ্ধের গল্প। ইমদাদ খান ছিলেন তবলিয়াদের যম, সকলেই তাঁকে ভয় করত। তবলিয়া অচেনা হলে খান সাহেবের বাঁধা নির্দেশ ছিল, খালি শুদ্ধ ঠেকা দিয়ে যেতে হবে। তারই মধ্যে এমন সব অদ্ভুত জায়গায় স্ট্রোকে জোর দিতেন যে তবলিয়ারা শুদ্ধ ঠেকাতেই গোলমাল করে ফেলতেন। এহেন ইমদাদ খান সাহেবের সঙ্গে সে বার বাজাতে বসেছেন প্রসন্ন বণিক। তাঁরও মেজাজ খাঞ্জা খানের মতোই। আসর আরম্ভ হল। সুরবাহারে আলাপ বাজাবার পর সেতার তুলেই খান সাহেব বণিক মশাইকে বললেন, ‘একটা মোমবাতি পুড়তে যত সময় লাগে, তত ক্ষণ তোড়া না বাজালে আসর জমে না।’ বণিকের উত্তর ‘যত ক্ষণ তোড়া বাজবে, আমার ঠেকাও চলবে।’ খান সাহেবের সঙ্গে বাজাচ্ছিলেন তাঁর পুত্র ওয়াহিদ খান। দু’জনেই একের পর এক তোড়া বাজিয়ে চলেছেন। তবলাও চলছে সমান তালে। আসর আগুন।
এমন সময় খান সাহেব ঝালার কাজ শুরু করলেন, আর প্রসন্ন বণিকও উপজ আরম্ভ করলেন। খান সাহেব হাঁকলেন, ঠেকা! বণিকমশাই ফিরে গেলেন ঠেকায়। ইমদাদ খান ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলেন, বাবুকো ইতনাহিমে পসিনা আগয়া, তাজ্জব! খান সাহেব তখন তোড়ার অর্ধেক লয়ে ঝালা বাজাচ্ছিলেন। বণিকমশাই সেই লয়ের উপজ আরম্ভ করলেন। খান সাহেব ফের হাঁকলেন, ঠেকা। বণিকমশাইয়ের পাল্টা হাঁক, তোড়া! খান সাহেব নিরুপায় হয়ে তোড়ায় ফিরলেন। বণিকমশাইও শুদ্ধ ঠেকায় ফিরলেন। কিন্তু, সেতার বাজনায় ঝালা বাজাতেই হবে। আবার, ঝালা ধরলেই বণিক উপজ বাজাবেন, তাতে ‘শম্’ হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। বাপ-বেটায় পালা করে ঝালা বাজাতে লাগলেন এক জন বাজান, অন্য জন হাতে তাল রাখেন। কিন্তু ওয়াহিদ খান তখনও নিতান্তই বাচ্চা। তার দম ফুরিয়ে এল। বাধ্যত খান সাহেবকে তোড়ায় ফিরতে হল। দম যখন একেবারে ফুরিয়ে এসেছে, তখনই বজ্রপাত। বণিকমশাই বলে উঠলেন, তুম বেটা লেটে বাজাতা কিউ? মুঝসে লড়না হ্যায় তো বেটাকো বন্ধ করওয়া দো, ইয়াতো মুঝে ফওরন এক বেটা লা দো, মোমবাত্তি আধিভি গলি নহি!
এই লড়াই শেষ পর্যন্ত চললে কোথায় গিয়ে থামত, কে জানে! তবে, লড়াই শেষ হয়নি। দুই যুযুধানের মাঝখানে এসে দাঁড়ান গওহর জান। আসর মাঝপথেই বন্ধ করিয়ে নিজে গাইতে বসে যান।
তবে, লড়াই-ঝগড়ায় গওহর কিছু কম যেতেন না। তাঁর অবশ্য ঝগড়া নয়, মানুষকে অপমান করেই আনন্দ। অমিয়নাথ সান্যাল মশাই তাঁর ‘স্মৃতির অতলে’ বইয়ে ফৈয়জ খানের প্রসঙ্গে আগ্রাওয়ালি মালকাজানের সঙ্গে গওহরের অভব্যতার গল্প লিখেছেন। বাঙালির দুর্ভাগ্য, এমন চমৎকার একটি বই, যা এখনও দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, সেটা বেশির ভাগ মানুষই পড়ে উঠতে পারলেন না। কিন্তু, গওহরের একটা অন্য গল্প বলি। কলকাতার কোনও এক আসরে তাঁর আগে গান গেয়েছিলেন বেনজির বাই নামে এক তবায়েফ। অসাধারণ সুন্দরী, কিন্তু অতি সাধারণ মানের গায়িকা। তাঁর ধ্রুপদ, ধামার শুনে গওহর বলেছিলেন, ‘বহেন, তুম পালংপর বড়ি অচ্ছি সজোগি মগর অ্যায়সে ম্যাহ্ফিলমে বৈঠনেকা হায়সিয়ৎ তুমহারি নহি হ্যায়। খাটে তোমায় খুবই মানাবে, কিন্তু এমন আসরে গান গাওয়ার যোগ্যতা তোমার নেই।
এই অপমানে মন ভাঙাই স্বাভাবিক। বেনজির হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ট্রেন ধরে সটান দ্বারভাঙায় পৌঁছলেন। তিনি দ্বারভাঙার মহারাজের কাছেই থাকতেন। পর দিন সকালে, হাড় কাঁপানো শীতের ভোরে ওস্তাদ আজিম বক্শের দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি। ওস্তাদ দ্বারভাঙার মহারাজার গুরু। খুবই বুড়ো। বেনজিরকে দেখে তিনি অবাক। বেনজির কাঁদতে কাঁদতেই ওস্তাদের পায়ের কাছে নিজের গয়নার পুঁটুলি রেখে বললেন, আমার যা আছে, সব আপনার, কিন্তু আমায় এমন তালিম দিন যেন কলকাতার সব রহিসের সামনে গওহরের মুখে চুনকালি মাখিয়ে আসতে পারি। ওস্তাদ প্রথমে রাজি হলেন না। বেনজিরের বিস্তর সাধ্যসাধনার পর বললেন, তা চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু, বছর পাঁচেক খাটতে পারবে তো বাছা? বেনজির এক কথায় রাজি।
পাঁচ বছর কাটল। গওহর কতকাতার এক ধনীর মুজরোয় গিয়ে শুনলেন, তাঁর আগে গাইবেন দ্বারভাঙার বেনজির বাই। নাম শুনে গওহর তাঁকে চিনতেও পারলেন না। তিনি গওহর জান, গোটা দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের নয়নের মণি, তাঁর বয়ে গিয়েছে এক হেঁজিপেঁজি তবায়েফের কথা মনে রাখতে। আর, মুখের ওপর অপমান তিনি প্রায় সবাইকেই করতেন, কাজেই সেই কারণেও বেনজিরকে মনে রাখার কথা নয়। যা-ই হোক, জোড়া তানপুরা নিয়ে বেনজির যা গাইলেন, তেমন সুশ্রাব্য আলাপ ও ধ্রুপদ কেউ কখনও শোনেনি। তাঁর গান শুরু হল শুদ্ধ কল্যাণের আলাপ ও ধ্রুপদ দিয়ে আর ওই রকম চমৎকার সুরের খেলা, শ্রুতির প্রয়োগ ও মীড় সুতের লাগডাঁটে গুণিজনরা চমকে চমকে উঠলেন। তার পর রাগ আর তাল বদলে বেনজির বাই বেহাগে ধামার ধরলেন, বোল বাট ছন্দের কাজ হচ্ছে, আসরসুদ্ধ লোক হাতে তাল রাখছে, গওহরও দুলে দুলে মাথা নাড়ছেন। এমন ঘন ঘন তারিফের মাঝখানে বেনজির বাই বলে বসলেন, বহেন, আ যাও না অব ময়দানমে, হিম্মৎ হো তো বয়েঠকে মেরে সাথ গাও। গওহরের গোটা জীবনে তাঁকে এমন সরাসরি চ্যালেঞ্জ খুব বেশি লোক করেননি। আর এ এমনই চ্যালেঞ্জ, যাকে জেতার মতো অস্ত্র স্বয়ং গওহরের তূণেও ছিল না।
কিন্তু, যে যুদ্ধ অস্ত্রে জেতার উপায় থাকে না, বুদ্ধি তাকে এড়িয়ে যেতে পারে। আর যা-ই হোক, বুদ্ধি, বাকচাতুর্যে গওহরের সমান তবায়েফ দেখতে আজও বাকি আছে। গওহর বেনজিরের চ্যালেঞ্জের উত্তরে বললেন, ‘বহেন হিন্দুস্থানে এখন কোনও মেয়েমানুষ নেই যে তোমার সঙ্গে বসে ধ্রুপদ ধামার গায়। আমরা তো সামান্য মানুষ ঠুংরি দাদরা গজল গাই, সে সব তো তুমি গাও না, দিল-এ চোট পেলে সে সব গান অন্তর থেকে বের হয়। সে এ সব তালিমের মুখস্থ গান নয়।’ পরাজয় স্বীকার করে নিয়েও প্রতিপক্ষকে খানিক অপমান করে যাওয়া, গওহরের আমলে যত দেখেছে কলকাতা, তার আগেও নয়, পরেও নয়।
মণিলাল ক্রমেই ডুব দিচ্ছিলেন স্মৃতির অতলে। তুলে আনছিলেন এক একটা আসরের স্মৃতি। খানিক দুষ্টু বুদ্ধি খেলল মাথায়। বললাম, ভাল আসরের কথা তো অনেক হল। কিন্তু, অতি মদ্যপানের ফলে ওস্তাদ আসর গুবলেট করে ফেলেছেন, এমন অভিজ্ঞতাও কি হয়নি? মণিলাল হাসলেন। বললেন, সে আর হয়নি? গোপাল মিশ্রর কথা জানো তো? এক সময় দেশের সবচেয়ে নামডাকওয়ালা সারেঙ্গিয়া ছিলেন। মদ্যপানের মাত্রা মাঝেমধ্যেই একটু বেড়ে যেত, মঞ্চে বেসামালও হয়ে পড়তেন। তবে, এক বার একেবারে কেলোর কীর্তি। দেখি, বাজাতে বাজাতে হঠাৎ সারেঙ্গি নামিয়ে, তার ওপর মাথা রেখে মঞ্চেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। টেনে আর তোলা যায় না। মণিলালের কথা শুনে মনে পড়ল, এক বার কুমারপ্রসাদবাবু মহাজাতি সদনে দরবারি গাইছিলেন। সারেঙ্গিতে গোপাল মিশ্র। তা, তাঁর কী মনে হয়েছিল কে জানে, তিনি প্রথম পনেরো বিশ মিনিট আশাবরী বাজিয়েছিলেন দরবারির আলাপের সঙ্গে।
জানতে চাইলাম, ভীমসেন জোশীর কোনও গল্প নেই? শীলা দারের একটা লেখায় পড়েছিলাম, জলন্ধরের হরবল্লভ ফেস্টিভ্যালে যোশীজি একটু অধিক মাত্রায় পান করে সেতারি রইস খানের আসরের বারোটা বাজিয়েছিলেন। তার পর, নিজে গাইতে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মঞ্চের ওপর। তাঁকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। স্ত্রী বৎসলা বললেন, কল চালিয়ে তার তলায় পণ্ডিতজির মাথাটা রাখতে। জানুয়ারির হাড় হিম করা ঠান্ডায় সে ভাবেই রাখা হল তাঁকে। ঘণ্টাখানেক বাদে হুঁশ ফিরল তাঁর। ফের মঞ্চে উঠলেন। একটা মিনিট দশেকের আভং, মানে মরাঠি ভক্তিসঙ্গীত গেয়েই উঠে পড়লেন। ভীমসেন যোশী ছিলেন হরবল্লভের মহানায়ক তাঁর ভক্তের সংখ্যা, অন্য সবার ভক্তের সংখ্যার যোগফলেরও ঢের বেশি। ফলে, আসরে প্রায় কান্নাকাটি। এক জন মাতব্বর গোছের মানুষ এগিয়ে এলেন। যোশীজির সামনে হাত জোড় করে বললেন, পণ্ডিতজি, গুস্তাখি মাফ করবেন, কিন্তু শুধু একটা আভং শুনে তো আমাদের মন ভরে না। আমাদের কি কোনও অপরাধ হল যে আপনি আজ গাইলেনই না? ভীমসেন প্রশ্ন শুনে স্তম্ভিত। অবাক গলায় বললেন, সে কী? এই যে দু’ঘণ্টা ধরে মালকোষ গাইলাম, আপনি তখন ছিলেন কোথায়?
গল্প শুনে মণিলাল বললেন, তা হলে শোনো। মহাজাতি সদনে যোশীজি এসেছেন। ডাক্তারের আদেশে তাঁর তখন মদ্যপান সম্পূর্ণ বারণ। স্ত্রী ঘোর নজরে রেখেছেন। এ দিকে ফড়ের তো অভাব নেই। এক ব্যাটা বার বার এসে ওস্তাদকে ডাব খাইয়ে যাচ্ছিল। তার ভিতরে একেবারে নির্জলা হুইস্কি। ফল যা হওয়ার তা-ই হল। মঞ্চে ওঠার আগেই টলোমলো অবস্থা। গাইতে আরম্ভ করার পর থেকেই একটু একটু করে ঘুরে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ একটা তান মারতে গিয়ে সম্পূর্ণ ঘুরে গেলেন। আসরের দিকে পিঠ, মুখ মঞ্চের দেওয়ালের দিকে। এবং, তার পরই পণ্ডিতজির হুঙ্কার, আরে পর্দা হঠাও! পড়িমরি ছুটে দু’জন পণ্ডিতজিকে ধরে ফের আসরের দিকে মুখ করে বসিয়ে দিল।
আসরকে কী করে নিজের ট্যাঁকে পুরে রাখতে হয়, সে বোধ হয় সবচেয়ে ভাল জানতেন ওস্তাদ ফৈয়জ খান সাহেব। তা যে কোনও আসর হোক সঙ্গীতবোদ্ধার রহিসি জলসা বা জাঠ কৃষকদের হট্টমেলা। ১৯৪৪ সালে এক বার উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলায় ওয়ার ফান্ডের টাকা তোলার জন্য উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর বসিয়েছিলেন কানপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। আরও অনেকের সঙ্গে ফৈয়জ খানও আমন্ত্রিত। শ্রোতাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েক জন রসিক, আর বাকিরা হয় আর্মির জওয়ান, নয় হাতে সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা লাঠি নিয়ে ঘোরা জাঠ কিষান। আসরের গোড়া থেকেই একেবারে কেলেঙ্কারি। শ্রোতাদের হট্টগোলে, টিকটিরিতে কেউই আর গানবাজনা শেষ করতে পারেন না। চাষাদের ভারী বয়ে গিয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রস আস্বাদন করতে।
কারও হাতেই যখন আসর জমল না, তখন মঞ্চে এলেন ফৈয়জ খান সাহেব। পুরিয়া ধরলেন। নিখাদে একটি মোচড় দিয়ে মন্দ্র সপ্তকের তীব্র মধ্যমে চলে গেলেন, তার পর একটি হিক্কা সমেত বিরাট মীড় দিয়ে আবার ষড়জে ফিরে এলেন, সঙ্গে কোমল রেখাবের আভাসমাত্র। যে কোনও শীলিত আসরে পুরিয়ার এমন উন্মোচনে তারিফের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু, এ অন্য আসর। সামনে বসা বিপুলদেহী জাঠ হাতের লাঠিটি নাচিয়ে বলে উঠলেন, ই কা হোবৎ হৈ খান সাহেব, পেট গুররাওৎ হৈ ক্যা? পেট গুড়গুড় করছে বুঝি? অন্য কেউ হলে সম্ভবত তখনই রণে ভঙ্গ দিতেন, কিন্তু ফৈয়জ খান অন্য ধাতুতে তৈরি। তিনি বললেন, আমি উন্নাও জেলার মেহমানদারির অনেক প্রশংসা শুনেছি। আজ আমি আপনাদের অতিথি। আমায় প্রথমে একটু হরি ওম্ অনন্তনারায়ণ গেয়ে ভগবানের আরাধনা করে নিতে দিন, তার পর আপনাদের মনপসন্দ গানও শোনাবো।
কোন মন্ত্রে কে জানে, আসর একেবারে কোলাহলহীন হয়ে গেল। মিনিট চল্লিশেক পুরিয়া গেয়ে খান সাহেব দেহাতি ধুনে ধরলেন ‘ডোলিয়া লেইকে আইবে সইয়াঁ, আইবে তো যাইবে না।’ কাহারবা তাল। তারই মধ্যে ছোট ছোট কাজ, মীড় ফিরৎ পুকার, সবই আছে কিন্তু দেহাতি গান। পুরো আসর খান সাহেবের গানের তালে তালে দুলছে। গান শেষ হওয়ার পর জওয়ানরা এসে তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলেন শ’খানেক জাঠ কিষান, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে যাঁদের প্রথম মুলাকাতই হল সে দিন। ট্রেন ছাড়ার পর এক জন খান সাহেবকে বলেছিলেন, আপনি জাদু জানেন। নয়তো এই হদ্দ গাঁইয়াদের তারিফ নিয়ে যাচ্ছেন ভারতের সেরা ধ্রুপদ-ধামারি খেয়ালিয়া ফৈয়জ খান, এ কল্পনা করা যায় না। খান সাহেব উত্তরে বলেছিলেন, এদের ছোট করো না। প্রত্যেকের মধ্যে গান আছে, সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাতালা দিয়েছেন। এদের আশীর্বাদও তো চাই।
এই ভাবে ভাবতে জানতেন বলেই হয়তো আল্লামিয়াও ফৈয়জ খানের ওপরে তাঁর খাস রহমত রেখেছিলেন। সে গল্প তাঁর পঞ্চতন্ত্রে লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা আলি। ফৈয়জ খান যখন বরোদার সভাগায়ক, মুজতবা আলিও তখন বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক রাত্রে আলি সাহেবের বাড়িতে আসর বসেছে, এক অতিথির সম্মানে। গায়ক খান সাহেব। সে দিন বডোদরায় ভয়ঙ্কর গরম, রাতদুপুরেও প্রায় গায়ে ফোস্কা পড়ছিল। বৃষ্টি নামতে তখনও মাসদুয়েক বাকি।
খান সাহেব গাইতে বসে বললেন, আদেশ করুন, কী গাইব? অতিথি অনেক চাপাচাপির পর ক্ষীণকণ্ঠে তাঁর ফরমায়েশ জানালেন মেঘমল্লার। খান সাহেব গাইতে আরম্ভ করলেন। মুজতবা আলি লিখছেন, ‘যেন তিনি তাঁর সমস্ত সাধনা, সমস্ত ঘরানা, সমস্ত সৃজনীশক্তি, বিধিদত্ত গুরুদত্ত সর্ব কলাকৌশল সেই সঙ্গীত সম্মোহন ইন্দ্রজালে ঢেলে দিলেন। আমরা নির্বাক্ নিষ্পন্দ হয়ে যেন সর্বলোমকূপ দিয়ে সে মাধুরী শোষণ করছি।’
এমন সময় বাইরে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টি দেখে স্বভাবতই সবাই উচ্ছ্বসিত, খান সাহেবকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত। খান সাহেব কিন্তু গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। তার পর ভোর রাতে যখন ভৈরবী গেয়ে আসর শেষ হল, একে একে সবাই বিদায় নিলেন, তখন খান সাহেব মুজতবা আলির কাছে বিদায় নিতে এলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা সৈয়দ সাহেব, লোকে আমাকে এই রকম লজ্জা দেয় কেন বলুন তো? আমি কি গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারি?
মুজতবা আলির উত্তরটি অবিস্মরণীয়। তিনি বলেছিলেন, সে জানেন আল্লা। আমি শুধু জানি, অন্তত আজ রাতে তিনি আপনার সম্মান রাখতে চেয়েছিলেন।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.