|
|
|
|
|
তুমি রবে নীরবে পিঠেপুলিতে মম |
জবুথবু শীতে, নারকেলের গন্ধটা পার হয়ে যায় সীমানা, সময়। দুনিয়াবাসী বাঙালি ডুব দেয়
দুধপুলির গভীরে। মেশে পাটিসাপটার ভাঁজে। পিৎজারা মুখ ঢাকে। শ্রাবণী রায় আকিলা |
বাঙালিদের নতুন নাম আর পরিচয় এখন গ্লোবাল বাঙালি। মধ্যবিত্ত রক্ষণশীলতা অনেক কমেছে। সাজপোশাকে নির্ভেজাল বাঙালি সিগনেচার স্টাইলের সংস্করণ হয়েছে। বেশ বয়স্ক শহুরে বাঙালি ভদ্রলোকেরা আজকাল শীতকাল এলে নিজেদের জটায়ুর মতো মাফলার, মাংকি ক্যাপে মুড়ে ফেলেন না। ঝরঝরে হুডি জ্যাকেটে বরং তাঁদের অনেক স্মার্ট দেখায়। বর্ষাকালেই বা ফুলপ্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে কে কবে শেষ মাছের বাজারে গেছে? বারমুডার তলা দিয়ে তিন দিনের রাস্তার জমা পচা জল কত যাবে যাক না। গৃহসজ্জাতেও সাত তলার বাঙালি গিন্নি অনেক কনটেম্পোরারি। উঠোনও নেই, আর তাতে গাঁদার গোড়ায় জল দেওয়ার ঝামেলাও নেই। তার বদলে বেডসাইড স্ট্যান্ড বা কফি টেবিলে যে আর্টিফিশিয়াল অর্কিড রাখতে হয় সে এখন হরিপদ কেরানির বউও জানে। কিন্তু বাঙালির খাদ্যাভ্যাস বদলাবে সাধ্য কার? হার্টের ধমকানিতে রবিবারের বাঁধা-ধরা খাসির মাংসটা না হয় একটু রদবদল করে চিকেন হয়েছে, বা জন্মদিনের লুচিটা মনমরা হয়ে ডালডার বদলে সাদা তেলে ভাসে। কিন্তু খাদ্যপ্রেমে আমবাঙালি এখনও রয়াল ও লয়াল। সে এখনও ঘরে-বাইরের হেঁসেলে ভজহরি মান্নাকেই খোঁজে।
এত কথা কেন? কারণ এখনও ঝমঝমিয়ে বর্ষা এলে পশ্চিমবঙ্গের জানলা দিয়ে ইলিশের ঝালঝোলের গন্ধ বেরোয়। আর গোটা শীতকালটা নাকে লেগে থাকে নারকোলের কোরা, পাক, পুরের জোরালো গন্ধ, যা নিজের অনিচ্ছাতেও জিভের ডগায় খানিক অপ্রস্তুত জল এনে ছাড়ে। দুর্গাপুজোর পর থেকেই নাড়ুর প্রয়োজনে একটু একটু করে নারকোলের সঙ্গে আমাদের সখ্য বাড়ে। তবে শীতকালের সঙ্গে নারকেলের, ফেলুদার সঙ্গে তোপসের সম্পর্ক। স্কুলে পড়াকালীন আমি নারকেলকে ভয় পেতাম খুব। সে আবার কেমন ব্যাপার? পিঠেপুলির পরবে নারকেলের মহিমার কথায় যাওয়ার আগে এই রহস্যটা একটু খুলেই বলি। দেশে প্রায় এক দশক থাকি না, বেড়াতে যাই গরমকালে, তাই ঠিক কী দামে কী নিয়মে এখনকার শীতের পশ্চিমবঙ্গে কতটা নারকেল বিক্রি হয় জানি না। হয়তো বা বিদেশের মতোই সিলড্ প্যাকেটে শুকনো বা ভিজে, সুইটেনড্ বা আনসুইটেনড্ কোরানো নারকেল পাওয়া যায়। আমার ছোটবেলার শীতের বাজার অবশ্য ‘অ্যাই, জোড়া কত করে’ দর কষাকষিতে গমগম করত। দশ টাকা জোড়া বললে পাঁচ টাকায় চারটে পাওয়া যাবে কি না জানতে চাওয়া হত, শেষ বারের মতো মরিয়া হয়ে। তবে আমার পরিবারের কোনও কুলের কোনও আত্মীয়স্বজন কখনও বাজারে গিয়ে নারকেল কেনেননি। কারণ আমার স্বর্গীয় দাদুর অঙ্কের অদ্ভুত মাথা। তাঁর কোনও ভাবে মনে হয়েছিল তাঁর এগারোটি সন্তানের জন্য ঠিকঠাক ও আজীবন সরবরাহের জন্য তিনটে বাগানে গোটা ছাপ্পান্ন নারকেল গাছ না পুঁতলেই নয়।
সেই কারণে জ্ঞান হয়ে থেকে মামার বাড়ির চার দিকে আন্দামানের মতো শুধুই নারকেল গাছ দেখেছি। সে বাড়িতে গরমের ছুটি পড়তে বসে অঙ্ক শেষ করতে পারিনি, ভাত খেয়ে সময়ে আঁচাতে পারিনি। সর্বদা কোনও না কোনও গাছ থেকে ঝড়ে বা হাওয়ায় এক বা একাধিক নারকেল পড়েছে বিকট আওয়াজ করে আর মামারা কেউ বা দিদা চিৎকার করে ‘অ্যা-ই-ই-ই কে রে বাগানে?’ বলে নিজেরা ছুটেছে বা হাতে ঝুড়ি ধরিয়ে দিয়ে আমাদের ছুটতে বলেছে। মামার বাড়ি মানেই নারকেলময়। আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে অবধারিত ভাবে রিটার্ন গিফট্ গোটা ছয়েক নারকেল। প্রতিটা ঘরের খাটের তলায় নারকেলের স্টোরেজ। আর খাটের তলা পিছু একটি করে দা। নারকেলের খোসা ব্যবহার করা হোত উঠোন-স্ক্র্যাবার হিসাবে। ‘গল্প হলেও সত্যি’। এক দিন ছোট মামার পাঁজরে টোল, কলপাড়ে ন’মাসি চিঁড়েচ্যাপ্টা। সব গাছ থেকে আচমকা নারকোল পড়ে। সব চেয়ে অসহ্য নারকোল পাড়ার দৃশ্য। একটি মানুষ দশ-বিশ টাকার আশায় প্রাণ হাতে করে স্পাইডারম্যানের মতো সটান গাছ বেয়ে ওপরে উঠে যাবে আমার সহ্য হত না। পরবর্তী দৃশ্যও কিছু সুখকর নয়। দা দিয়ে কোপ মেরে মেরে সর্বশক্তি দিয়ে সে নারকেলের ছাল ছাড়ানো হত। ধড়াম করে বাড়ি মেরে ফাটিয়ে হুমড়ি খেয়ে দেখা হত, জল আছে না নেই, মিষ্টি না বিস্বাদ, শাঁস পুরু না পাতলা। প্রাথমিক নিরীক্ষায় পাশ করা নারকেলগুলোকে নিয়ে দুপুরে তিন ঘণ্টা বসে পিঠ ব্যথা করে বাড়ির মহিলারা কুরুনি দিয়ে কুরিয়ে থালা থালা নারকেল কোরা এক জায়গায় করতেন নারকেলের পুর, পাক বানাবেন বলে।
তাই ছোটবেলায় পুলি, পাটিসাপটা খেতে গিয়ে আমার এই সব কথা মনে পড়ে আনন্দের চেয়ে অস্বস্তি বা ভয় হত বেশি। তা কোরানো নারকেল প্যাকেট করেই পাওয়া যাক, বা অনেক হুজ্জুতি করেই জোগাড় হোক, তা দিয়ে নারকেলের পাক-পুর বানানোর কড়া সুমিষ্ট গন্ধ যত ক্ষণ না গোটা বাড়ি, এমনকী, রান্নাঘরের গ্রিলের জানলা গলে পাড়ার সামনের খানিকটা মজিয়ে না দেয়, তত ক্ষণ যেন শীতের আমেজই আসে না। ছোটবেলায় সেই রসালো গন্ধের চার দিকে আমরা মাছির মতো ভনভন করতাম। সদ্য নামানো গুড়েলা নারকেলের অর্ধেক পুর পিঠের ভেতর যাওয়ার আগেই চুপিচুপি যেত আমার আর দিদির পেটে। এখনও হাতের সামনে পেলে ‘আমি তো এমনি এমনিই খাই’। নারকেল দিয়ে বানানো দুধপুলি, রসপুলি, পাটিসাপটা কিংবা রসে ভেজানো, দুধে চোবানো পাটিসাপটার উত্তরসূরি বা প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও দিন হবে না। আমেরিকায় বড় হতে থাকা বাচ্চারাও যে এ সব পেলে কত গোগ্রাসে খেতে পারে, তা নিজের ছেলেকে দিয়ে বুঝেছি।
আমাদের ছোটবেলায় আমাদের মায়েরা নন-স্টিক ফ্রায়িং প্যান-এর যুগ ও মুখ দেখেননি। তাই অনেক সময় তাঁদের পাটিসাপটা ওঠাতে হাবুডুবু খেতে হত। নিজের মা’কেই দেখেছি ভাল ভাবে অক্ষত অবস্থায় পাটিসাপটা ওঠাতে না পারলে কেঁদে ফেলতেন। বাবা আর আমরা দু’বোন মিলে ‘এই তো, কী সুন্দর হয়েছে স্বাদটা’ বলে সান্ত্বনা দিতাম। শীতের ঠিক সন্ধে হব হব সময়টায় আজও নারকোল ঠাসা ভাজাপুলির কোনও বিকল্প নেই। ছোটবেলায় বেশ কয়েক বার পর পর শীতে আদর্শ ছোটবেলার মতো ঠাকুরমা’র ঝুলি থেকে পেয়েছি চন্দ্রপুলি, সেদ্ধপুলি, গোকুল পিঠে। আমাদের পৌঁছনোর দিন চিঠিতে জেনে অক্লান্ত পরিশ্রমে রকমারি পাটিসাপটা, পুলি বানিয়ে রাখতেন। আমার পঁচানব্বই বছরের দিদা, যিনি এখনও নারকেলের নাড়ি টিপে বলে দিতে পারেন সেটা ভাল না খারাপ, এক কালে বড়দিনের ছুটিতে আমাদের করে খাইয়েছেন বিলুপ্তপ্রায় ঘোটা পিঠে, নারকেল, দুধ, চালগুঁড়ো দিয়ে বানানো আদোসা।
গ্লোবালই হই, বা সেকেলে বাঙালি আমরা যারা নারকোলের পুর ভরা পিঠে, পাটিসাপটায় ছোটবেলার হাতটা এক বার চ্যাটচেটে করে নিয়েছি, জেনেছি সেই পুর-পাকের জোরালো গন্ধের চৌম্বকীয় স্বাদ, তারা কোনও দিনই পিঠেপুলি খাওয়ার বাসনায় আকুল জিভটাকে পিৎজায় ভুলিয়ে রাখতে পারব না। জবুথবু শীত এলে পাটিসাপটা আমরা বানাবই। তার জন্য পঞ্চাশ বার মা’কে ফোন করব, দশ বার ইউ টিউব খুলব, চার বার বেলা দে’র রান্নার বই ঘাঁটব, বরের প্যাঁক খাব, ছেলেদের ‘মাম্মার বানানো ইয়াম্মি থিংস’ খাওয়ার আশায় ধৈর্য ধরে বসে থাকা মুখগুলো সহ্য করব, তবু পুলিপিঠে বানাব। পাকা হাতের মহিলারা শিকাগো, হিউস্টনে আয়োজন করে ফেলবেন, ‘পটলাক পার্টি অব পাটিসাপটা’। কিংবা গত বারের মতো এ বারেও হয়তো ঠিক পৌষ সংক্রান্তির দিন লন্ডন থেকে রাজীবদা ফোন করে জানতে চাইবেন, ‘কী গো? বানালে নাকি পিঠেটিঠে? আমি তো এই মাত্র একগাদা সাবাড় করে উঠলাম’। |
|
|
|
|
|