গাট্টু ও অ্যাসটেরিক্স
ফ্রেঞ্চকাট থেকে ফ্রেঞ্চটোস্ট। বড় জোর কলকাতায় কয়েক মিলিমিটারের চেয়ে কিছু বেশি বৃষ্টি হলে, ফ্রেঞ্চ লিভ। বাঙালির ফ্রেঞ্চ কানেকশন-এর ঝাঁঝ চন্দননগরে গিয়েই গঙ্গালাভ করত, যদি না গত শতকের বিশ দশকে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ সুদূর দাক্ষিণাত্যের পুদুচ্চেরিতে গিয়ে আশ্রমিক হতেন, যদি না ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠত ফরাস-প্রিয় বাঙালির জন্য এক মনোজ্ঞ ফরাসি ডেস্টিনেশন।
প্রোমেনাড-এর ব্যালকনিতে জিন উইথ লাইম-এ চুমুক দিতে দিতে অ্যাসটেরিক্স এ সব কথাই আবোলতাবোল ভাবছিল। গাট্টু কি ফিরল অরোভিল থেকে? সেই কোন সকালে সাইকেল চেপে রওনা দিয়েছে পুদুচ্চেরি থেকে চোদ্দো কিলোমিটার দূরে তামিলনাড়ুর ভিলুপুরম জেলায় শ্রীমতী মিরা আলফাঁসা বা মাদার-এর স্বপ্ন-উপনিবেশে। ১৯৬৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এই এক্সপেরিমেন্টাল টাউনশিপ-এর সূচনা। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট রজার অ্যাঙ্গার-এর পরিকল্পনায় তৈরি এই উপশহরে বিশ্বমানবতার জয়জয়কার। পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতির এখানে সম্বৎসর বসবাস। শহরের এপিসেন্টারে অরোভিল-এর প্রাণভোমরা মাতৃ-মন্দির। দূর থেকে দেখলে মন্দিরের সোনায় মোড়া ক্রিস্টাল ডোমকে সত্যি ভ্রমর বলেই ভ্রম হয়। এমন আশ্চর্য সেই শৈলী।
এ দিকে শীতের সকালে পুদুচ্চেরির আবহাওয়ায় রীতিমত কালীপুজোর রাতের মেজাজ। অনেক কষ্টে গাট্টুকে একটা উইন্ডচিটার পরানোর জন্য রাজি করা গিয়েছে। আজকালকার ছেলে তো, টি-শার্ট আর জিন্সেই বারো মাস ফ্যাশন প্যারেড করে। অ্যাকসেসরিজ বলতে আইপড। আধবুড়ো অ্যাসটেরিক্স-এর কথা, শীতবস্ত্রের মতোই, সে গায়ে মাখতে যাবে কোন দুঃখে?
আহা, পুদুচ্চেরির রাস্তায় তো খালি পায়ে হাঁটা যায়, এত পরিষ্কার! সিগারেটের শেষাংশ কোথায় ফেলবে, সেটা ঠিক করতেই অ্যাসটেরিক্সকে বেশ কয়েকশো পা হাঁটতে হল। দু’পাশে ছাইরঙা ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার্স। দেওয়ালে দেওয়ালে ফরাসি ও তামিলের যুগলবন্দিতে লেখা রাস্তার নাম। ঘরের কাছে চন্দননগরে কিন্তু এমন মিলমিশ রীতিমত দুষ্প্রাপ্য। উত্তাল সমুদ্র-শব্দ আর ক্রিসমাস ইভ-এর জনকল্লোল ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় একটা কাঠের বেঞ্চ খুঁজে পায় অ্যাসটেরিক্স। হাত-পা ছড়িয়ে বুকভরা শ্বাস নেয়। আড়মোড়া ভেঙে উল্টো দিকে তাকাতেই দেখে, ভাড়া করা হলুদ সাইকেলে চেপে গাট্টু আসছে। পাশের সাইকেলে এক শ্বেতাঙ্গিনী। ঠিক দেখছে তো অ্যাসটেরিক্স? সামান্য দু-পেগ জিনে এতটা ভুল তো সে করবে না! মালুম হল যখন, গাট্টু আর সেই মেয়েটি ওর পায়ের সামনে এসে ব্রেক কষল। ‘বাবা মিট ইমান্যুয়েল।’ অ্যাসটেরিক্স হাত বাড়াতে যেতেই দেখে মেয়েটি হাত জোড় করে নমস্কার করছে। যেন হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছে, সেই ভাবে অপ্রস্তুত হয়ে হাতটা গুটিয়ে নেয় সে। বোকা বোকা হাসিমুখে প্রতিনমস্কার জানায়। অ্যাসটেরিক্স-এর অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল, যখন সেই মেয়েটি ঝরঝরে বাংলায় বলে ওঠে, ‘আমাকে আপনি ইমনও বলতে পারেন।’ বেকায়দা বুঝে এ বার গাট্টু সিনে ঢোকে। বলে, ‘আসলে ও শ্রীঅরবিন্দকে নিয়ে রিসার্চ করছে। সেই জন্য বিপ্লবীর ভাষাটাও দিব্যি রপ্ত করে নিয়েছে’। অ্যাসটেরিক্স তো যারপরনাই মুগ্ধ। পুদুচ্চেরি আসা তার সার্থক। ইমন আর গাট্টুকে নিয়ে সে সাগরতীরের লা কাফে-তে আসে ও গরম গরম ফিল্টার কফির অর্ডার দেয়। ইমন বলতে থাকে, বিপ্লবী অরবিন্দকে নিয়ে ওর দুর্দান্ত সব ফাইন্ডিংস-এর কথা। ইংল্যান্ড-এর ম্যাঞ্চেস্টার-এ পড়াশোনা থেকে ১৯০৮ সালে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবাস ভায়া উত্তরপাড়ায় স্পিরিচুয়াল স্পিচ লাইফ ইন প্রিজন থেকে লাইফ ডিভাইন-এর ইতিবৃত্তে কখন যে ফুরিয়ে আসে ওদের দক্ষিণী কফি, বোঝাই যায় না।
ক্রিসমাসের আনন্দমাখা বুলেভার্ড-এ ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চার ভিড় ঠেলে ওরা পৌঁছয় অরবিন্দ আশ্রমে। ১৯২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীঅরবিন্দ। আজ অবাক লাগে ভাবতে, কিন্তু শুরুর সে দিন আশ্রমিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪। ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে শ্রীঅরবিন্দ নিজেকে যাবতীয় জনসংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মাদার-এর হাতে আশ্রমের দায়িত্ব তুলে দেন।
গাট্টুর কনুইয়ের খোঁচায় অ্যাসটেরিক্স আবিষ্কার করে ওর মোবাইল বাজছে। সাউন্ড অব সাইলেন্স-এর মধ্যে সেই শব্দ যে মারাত্মক বেসুরো, টের পায় সে। নিমেষে সুইচ অফ হয় ব্ল্যাকবেরি। এই জাগরণের দিনে যন্ত্রটির কুম্ভকর্ণের নিদ্রা হোক প্রার্থনা করে সে। ফুলে ফুলে ঢাকা শ্রীঅরবিন্দ-এর সমাধি ছুঁয়ে এক প্রান্তে বসে থাকে তারা। শব্দহীন, স্তোত্রহীন এই নির্ভাষ প্রণামে কী ফরাসি, কী তামিল, কী বাংলা পৃথিবীর সব ভাষাকেই তাদের অপ্রয়োজনীয় মনে হয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.