সুন্দরবন এলাকার নদীর জলে ভেসে চলেছে পাহাড়ের মতো মস্ত একটা লোহার চৌকো বস্তু। জোয়ার-ভাঁটায় এ পার থেকে ও পারে। এক নদীর সীমানা ছাড়িয়ে অন্য নদীতে। তাকে আটকাতে না পারলে নৌকা, ভুটভুটি, স্পিড বোট কিংবা লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে যে কোনও মূহূর্তে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অথচ প্রশাসনের সর্বত্র জানিয়েও তিন দিন হয়ে গেল, এখনও আটকানো গেল না বস্তুটিকে। বস্তুটি আসলে একটি ভাসমান জেটি। গত মঙ্গলবার হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলিতে সেটি উল্টে যায়। ভেঙে পড়ে তার উপরে থাকা আস্ত একটি পল্টুন সেতু। জেটিটি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেতে থাকে কখনও সামনে, কখনও পিছন। শুক্রবার সেটিকে রায়মঙ্গল নদীতে হাটগাছা গ্রামের কাছে দেখা যায়।
ঘটনাটি ‘যথেষ্ট উদ্বেগের’ জানিয়ে বসিরহাটের মহকুমাশাসক অনামিকা মজুমদার বলেন, “নদীতে জোয়ার-ভাঁটায় যে ভাবে জেটিটি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাতে যাত্রীনৌকা, স্পিডবোট বা অন্য কোনও জলযানের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জেটিটি আটকাতে রাজ্য পরিবহণ পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগমকে (ডব্লিউবিটিআইডিসি) বলা হয়েছে।” |
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, মেরামতির অভাবে বেশ কিছু দিন থেকেই লেবুখালি ও দুলদুলির মধ্যে সাহেবখালি নদীর এক পারের ভাসমান জেটিটি (ভেসেল) ফুটে হয়ে তাতে জল ঢুকছিল। এ দিন প্রচণ্ড শব্দে ভেসেলটি উল্টে যায়। ভেসেল এবং নদীপাড়ের সঙ্গে যুক্ত পল্টুন সেতুটি ভেঙে পড়ে। ঘটনার সময় সেতুর উপরে কেউ না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সেতু হবে না কী বার্জ চলবে, তা নিয়ে দীর্ঘ টালবাহানা হয়। বাম জমানায় দু’বার শিলান্যাস করা হলেও সেতুটি হয়নি। শেষে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসমান জেটি করে বার্জার চলাচল শুরু হয়। কিন্তু কয়েক দিন চলার পরে কোনও অজ্ঞাত কারণে বার্জ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকেই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুলদুলি পারের ভাসমান জেটি ফুটো হয়ে যায়। এ দিন জেটি উল্টে পল্টুন সেতু ভেঙে পড়ার পরেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। দ্রুত জেটি এবং পল্টুন সেতু মেরামতের কথা বলা হলেও তা না হওয়ায় জলের চাপে চেন ছিঁড়ে জেটি নদীতে ভেসে যায়।
বুধবার সন্দেশখালির জেলিয়াখালিতে বালিয়া নদীর উপরে সেতুর শিলান্যাস করতে এসে হিঙ্গলগঞ্জে জেটি উল্টে পল্টুন সেতু ভাঙার খবর পেয়ে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলাশাসক এবং মহকুমাশাসককে বলেন। এর পরেও ভেসে যাওয়া জেটি আটকানো না হওয়ায় বড় রকমের বিপদের আশঙ্কায় চিন্তিত সুন্দরবন এলাকার মানুষ।
সুন্দরবন এলাকার নদীগুলিতে প্রচুর পরিমাণে যাত্রীনৌকো চলে। যন্ত্রচালিত ভুটভুটিতে মালপত্র পরিবহণ ও যাত্রী পারাপার করা হয়। মৎস্যজীবীদের নৌকো এবং ভ্রমণে আসা মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করেন। টহলের কাজে ব্যবহার করা হয় সীমান্তরক্ষদের স্পিডবোট এবং পুলিশের লঞ্চ। এ ছাড়াও, রায়মঙ্গল নদী দিয়ে হেমনগর হয়ে বাংলাদেশি জাহাজ পণ্য নিয়ে যাতায়াত করে। এগুলোর কোনও একটির সঙ্গে জেটিটির ধাক্কা লাগলে বড় রকমের দুর্ঘটনা হতে পারে বলে প্রশাসনের আশঙ্কা। লম্বায় প্রায় ১০০ ফুট এবং চওড়ায় ৫০ ফুট লোহার জেটিটির মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা।জেটির মধ্যে জল ঢুকে থাকায় জলের উপর সামান্য অংশই ভেসে থাকছে। তার উপর, কুয়াশার জন্য জেটিটি সবসময় দেখাও যাচ্ছে না। বিএসএফের এক অফিসার বলেন, “বিপদের আশঙ্কায় স্পিডবোট জোরে চালানো যাচ্ছে না।” মাঝিদের কথায়, “ভয়ে বিকেলের পর নৌকো নামানোর সাহস হচ্ছে না।”
হিঙ্গলগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আবুবক্কর গাজি বলেন, “প্রশাসন তড়িঘড়ি ব্যবস্থা না নেওয়াতেই পল্টুন সেতু ভেঙে পড়েছে। জেটিটি বিপজ্জনক ভাবে নদীতে ভেসে বেড়ালেও প্রশাসন গুরুত্ব দিচ্ছে না।” হেমনগর উপকূলবর্তী থানার ওসি অলকেশ বালা এবং হিঙ্গলগঞ্জ থানার ওসি পার্থ সিকদার বলেন, “সন্ধ্যায় জলযান চালানো বন্ধ রাখতে আবেদন জানানো হচ্ছে।” |