|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ১... |
|
হেমলক |
‘হেমলক সোসাইটি’। তাঁর নতুন ছবির নাম। জীবনটাও সেই বিষে নীল।
সাফল্যও। সৃজিত মুখোপাধ্যায়। লিখছেন দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী |
গভীর রাত। লর্ডস বেকারির মোড়। দু’টো একটা দোকান আধখোলা।
রুটি তড়কা খাচ্ছেন এক যুবক। মধ্য-তিরিশ। এলোমেলো চুল। কাঁচাপাকা দাড়ি। স্বপ্নালু চোখ। খাওয়াতে মন নেই। নিয়মমাফিক আঙুল চলছে প্লেটে।
খাবার? না হেমলক?
যুবকটি সৃজিত মুখোপাধ্যায়। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সফল পরিচালক। রাত নিশুতে বাড়ি ফেরেন। বাড়িতে মা আছেন। আর আছে সৃজিতের রাত জাগা। বেড সাইড টেবিলের পাশে থাকে ‘কোড নেম গড’ বইটা। জীবনকে বোঝার চেষ্টায়? জীবন না কি হেমলক?
আসলে ‘হেমলক সোসাইটি’ নিয়ে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে এখন তাঁর মাথায়। ‘হেমলক সোসাইটি’। তাঁর নতুন ছবির নাম।
“কলকাতায় ২০০৯-য়ে একটা নাটক করেছিলাম। ‘চেকমেট’। সেখানে শেষে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার একটা ঘটনা ছিল। সেই থেকে মাথায় বিষ খাওয়া, বিষ খেয়ে কত রকমের আত্মহত্যা হয় এই ব্যাপারগুলো ঘুরছিল। এই নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে একটা অদ্ভুত ওয়েবসাইটের সন্ধান পেলাম। যেখানে কী ভাবে আত্মহত্যা করা যায় তার নানা রকম উপায় বলা আছে। দারুণ ইন্টারেস্টিং।”
সেখান থেকে রিসার্চ করতে করতে জানলেন আমেরিকার সান্টা মনিকায় ১৯৮০ সালে একটা সংস্থা খোলা হয় মানুষকে ইচ্ছামৃত্যুতে সাহায্য করতে। সংস্থার নাম ‘হেমলক সোসাইটি।’
কিন্তু এটা ছবির নাম? গড়পরতা বাঙালি জানে হেমলক কী?
“হেমলক হল সেই বিষ যেটা পান করে বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আমার তো নামটা খুব পছন্দ। রিসার্চ করে দেখলাম সারা পৃথিবী জুড়ে এ রকম গুচ্ছ গুচ্ছ সংস্থা আছে যারা ইচ্ছামৃত্যু বা ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’-এ সাহায্য করে থাকে। আমার ছবির একটা অনুপ্রেরণা এটা,” জানাচ্ছেন পরিচালক।
‘অটোগ্রাফ’ আর ‘২২শে শ্রাবণ’-এর পরের ছবি এটা! উত্তেজনার পারদ স্বভাবতই তুঙ্গে। সেই ছবি সম্পর্কে আরও তথ্য পেঁয়াজের খোসার মতো খুলতে থাকেন পরিচালক।
“আমার অন্য সোর্স একজন রক্তমাংসের মানুষ। যাঁর সঙ্গে আমার মাত্র মাস তিনেক আগে আলাপ হয়েছে।” তিনি নারী না পুরুষ? সৃজিত রহস্যের হাসি হাসছেন। ছবিটা কিন্তু তাঁকেই উৎসর্গ করা। পরমব্রতর চরিত্রটাও তাঁকে ভিত্তি করেই।
ছবির নামে চমক। স্টারকাস্টে?
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, কোয়েল মল্লিক, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে। ক্যামিও চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, ব্রাত্য বসু, বরুণ চন্দ, রাজ চক্রবর্তী। আর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্রে শিলাজিৎ। এই ছবিতে অনুপম রায়ের সুরে গানও গেয়েছেন তিনি। সৃজিতের ছবিতে এই প্রথম বার। প্রথম বার সৃজিতের জন্য প্লে-ব্যাক করেছেন লোপামুদ্রা মিত্রও।
কিন্তু তাঁর লাকি স্টার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ই তো নেই এ ছবিতে! ‘তিনে তিন-বুম্বাদাকে নিন....’কে যেন বলছিল সে দিন!
বিরক্ত সৃজিত। “একটা কথা বলি। বুম্বাদাকে ছাড়া এই প্রথম ছবি করছি বলে কোনও চাপ নেই আমার ওপর। ‘অটোগ্রাফ’ হিট করবে ভাবিনি। ‘২২শে শ্রাবণ’-এও এ রকম কোনও আশা ছিল না। গল্প বলতে চাই বলে ছবি করি। সেখানে তিন নম্বর ছবিটাও হিট করবে কি না ভাবছি না। তিনে তিন। না তিনে দুই। না চারে তিনএ ভাবে কাজ করা যায় না কি? আর বুম্বাদার সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক পরিচালক-অভিনেতার নয়। ‘হেমলক সোসাইটি’তে না থেকেও উনি আছেন। আমার সব কাজেই আছেন। ভীষণভাবে।”
কিন্তু মিডিয়া, অন্য নানা লোক এই উত্তরে সন্তুষ্ট হবে তো? আপনাকে নিয়েই বারবার এ রকম বিতর্ক হয় কেন? এত পরিচালক তো টালিগঞ্জে কাজ করে গেছেন বা করছেন...
প্রত্যাশা আর সাফল্যর চাপ। বিতর্ক। শরীরটা বিরক্তিতে মোচড়ান।
এ যেন সাফল্যের হেমলক। প্রত্যাশার হেমলক। বিতর্কের হেমলক।
সোজা হয়ে বসে উত্তর দিতে তৈরি হন। “দেখুন এটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। এর মানে কি এই যে আমাদের অর্থাৎ আমার এবং আমার টিমের কাজ-- গত দু’বছর ধরে আমরা যে রকম কাজ করছি সেটা কারও চক্ষুশূল হয়ে উঠছে? কারও কোনও অসুবিধে করছে? শুধু শোনা কথায় মানুষজনকে যে ভুল পথে চালিত করা হচ্ছে...এটা কারা করছেন, কেন করছেন... সত্যি বলছি আমি জানি না...। আর হ্যাঁ। নবারুণদা (ভট্টাচার্য)-র সঙ্গে ফোনে কথাও হয়েছে এর মধ্যে। ওঁকে গোটা গল্পটাই বলে দিয়েছি যাতে উনি বুঝতে পারেন বিতর্কটা কতটা অমূলক। আসলে যিনি ওঁকে আমার ছবি সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি আমার চিত্রনাট্যটা পড়েননি। জানেনই না আসলে কী আছে তাতে। ছবির গল্পের একটা আদল দু’লাইনে শুনে উনি নবারুণদাকে বলেছিলেন। নবারুণদা আমার গল্পটা শুনে বললেন, ‘তুই এ সব নিয়ে আর মাথাই ঘামাস না। ভাল করে ছবিটা বানা। আমার আশীর্বাদ রইল তোর সঙ্গে।’” |
|
পরমব্রত আর কোয়েল |
নবারুণ ভট্টাচার্য সত্যিই বলছেন, “এটা একটা ক্লোজ্ড চ্যাপ্টার। চাই না এ নিয়ে আর কোনও কথা হোক। সৃজিতের জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল।”
ঘুম সৃজিতের নেশা। অথচ রাতের পর রাত ঘুমোন না অনেক সময়ই। কাজের নেশায় ডুব দেন। রাত জেগে কাজ করা অবশ্য বরাবরের অভ্যেস। পড়াশোনাও করতেন রাত জেগে। ছবির কাজও করেন রাত জেগে। তা নিয়ে বিবাহিত পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কত ঝামেলা! তাঁদের বউরা রেগে কাঁই! চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক মারে যুবক-পরিচালকের। “এই টিমটাই আমার জীবন। সম্পাদক বোধাদিত্য (বন্দ্যোপাধ্যায়)। প্রধান সহকারী পরিচালক সৌম্যব্রত (রক্ষিত)। চিত্রগ্রাহক শমীক (হালদার)। আর অনুপম (রায়)সঙ্গীত পরিচালক। আমার জীবন এঁদের ঘিরেই।”
তবে যে কাগজে কাগজে এত জল্পনা তাঁর রমণীমোহনরূপ নিয়ে? ক্যাসেনোভা অ্যাটিটিউড নিয়ে? তিনি না কি আজ এই নারীর বাহুলগ্ন তো কাল অন্য নারী তাঁর বক্ষলগ্না?
উদাস হয়ে যান সৃজিত। কোনটা সত্যি? কোনটা না? ভাবেন হয়তো। আর ভাবেন, এই সব খবর পড়ে কোনও নারীই হয়তো তাঁর সঙ্গে গভীর সম্পর্কে যেতে চাইবে না। নিজের সাফল্যের জালে নিজেকে বন্দি মনে হয়। ইচ্ছে করে নতুন কেনা টয়োটা ইটিওস গাড়ি চালিয়ে অনেক দূরে কোথাও একা লংড্রাইভে চলে যেতে। গাড়িতে বাজবে ‘জানি দেখা হবে’, ‘অপরাজিতা তুমি’ আর ‘বেডরুম’। গত কয়েক মাস হিন্দি ছবির সিডি শোনেনইনি। এই সাফল্যের মাকড়সা জাল, বিতর্কের নাগপাশ আর ভাললাগে না! মাঝেমাঝে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বলেন, “এই ইন্ডাস্ট্রিতে থাকব না। চলে যাব।” কিন্তু হয় কই! ওই যে পর্দায় গল্প বলার তাড়না। হেমলক।
হঠাৎ মনে পড়ে বুম্বাদার সেই কথাটা, “এ বার তোর একটা বিয়ে দিতে হবে।”
চিলতে হাসেন সৃজিত। সত্যি! বিয়েটা করে ফেললে কেমন হয়? একাকীত্ব তো কাটে। তাঁর ভাবতে ভাল লাগে এই এত সাফল্য, বিতর্ক, প্রত্যাশার দেওয়াল পেরিয়ে একজন কেউ পাশে আছেন যিনি সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে না, ঋজুকে চেনেন। আসল ঋজুকে। ঋজু। তাঁর ডাক নাম।
সে নারী আসে না। অপেক্ষা।
নারী। হেমলক। |
|
|
|
|
|