এই সেই ‘খেতড়ি হাউস’?
সদর দরজা খোলা, ভিতরের মাঠে ছাইগাদায় চরে বেড়াচ্ছে এক পাল শুয়োর। সামনে তালাবন্ধ প্রাসাদ। পাশের ছোট একতলা বাড়ি থেকে কেয়ারটেকার বেরিয়ে এসেছেন, “এই পোড়োবাড়িটা দেখতে এলেন?” ‘খেতড়ি হাউস’-এর অবস্থা এখন এ রকমই। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত চাঁদপোল এলাকা। পুরনো মহল্লা, ঘিঞ্জি গলি, বাজার। সেখানেই এই বাংলোবাড়ি। ১৮৯১ সালের জুনে রাজা অজিত সিংহের সঙ্গে প্রথম বার মাউন্ট আবু থেকে খেতড়ি যাওয়ার পথে এবং ১৮৯৩ সালে খেতড়ি থেকে মুম্বই যাওয়ার পথে এখানেই উঠেছিলেন বিবেকানন্দ। মুম্বই থেকেই তিনি শিকাগো যাওয়ার জাহাজ ধরবেন। কিন্তু খেতড়িতে রেললাইন ছিল না বলে জয়পুরে এসে মুম্বইগামী ট্রেন! পরে ১৮৯৭ সালে খেতড়ি যাওয়ার জন্যও এই বাংলোয় উঠেছিলেন। সে বার তিনি রসিকতাও করেছিলেন, “আহা, এখানে এক দিন সামান্য ফকিরের বেশে এসেছিলাম! রাজার পাচক মুখঝামটা দিয়ে দিনান্তে চারটি খেতে দিত। এখন পালকের গদি, সেবার জন্য কত লোক!”
খেতড়ি তখন জয়পুর-রাজের সবচেয়ে বড় তালুক। আলোয়ার, বিকানের বা জোধপুর স্বতন্ত্র রাজ্য। কিন্তু সূর্যবংশীয় ঐতিহ্য মেনে জয়পুররাজ-ই ক্ষত্রিয়প্রধান। ক্ষত্রিয় নিয়ম, দৌহিত্র পাবে না সিংহাসন। পুত্রসন্তান না থাকলে গোষ্ঠী থেকে দত্তক নিতে হবে। খেতড়িরাজ অজিত সিংহের দুই কন্যা ছিল। বিবেকানন্দ প্রথম বার খেতড়ি যাওয়ার পর গুরুর কাছে রাজার একটিই প্রার্থনা। এ বার যেন ছেলে হয়। সেই পুত্র জয়সিংহ মাত্র ১৯ বছর বয়সে মারা যান। |
জয়পুরে খেতড়িরাজের বাংলো থাকার পিছনে অবশ্য ক্ষাত্রগৌরবের বংশগত কারণটিই সব নয়। ছিল রাজনৈতিক কারণও! জয়পুর-রাজের সবচেয়ে বড় তালুক হওয়ায় ইংরেজরা এটিকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিত। আজও খেতড়ি রামকৃষ্ণ মিশনের ‘ফতেহ বিলাস’ প্রাসাদে ফলক ‘১৮৬৬ সালে হিজ রয়াল হাইনেস ফতেহ সিংহ বাহাদুরের এই প্রাসাদ তৈরি সম্পূর্ণ হল। মহারাজের সম্মাননীয় বন্ধু জয়পুরের রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন ডব্লিউ এইচ বেননের ইচ্ছায় প্রাসাদের নাম ‘ফতেহ বিলাস’ রাখা হল।’ এই ফতেহ সিংহ অজিত সিংহের পিতা। জয়পুরের ইংরেজ রেসিডেন্ট তাঁর এতটাই বন্ধু যে, জয়পুর রাজ্যের অধীনস্থ ‘কাঠপুতলি’ জায়গাটি তাঁকে উপহার দেওয়া হয়। ফলে জয়পুর-খেতড়ি মনোমালিন্য ছিল। জয়পুরের ‘বড় রাজা’র সঙ্গে পাল্লা দিতে ১৮৯৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার জুবিলি উৎসবে অজিত সিংহ-ও লন্ডন গিয়েছিলেন। তার চার বছর পর, ১৯০১-এ আগরার এক মিনার থেকে পড়ে মারা যান তিনি। কেউ বলেন, দুর্ঘটনা। কেউ বলেন, আত্মহত্যা।
সবই ইতিহাস। তবু বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে জয়পুরই সবচেয়ে বেশি ইতিহাস-বিস্মৃত। খেতড়িরাজের সঙ্গে আলাপের আগেও ১৮৯১ সালে তিনি আলোয়ার থেকে ট্রেনে জয়পুর এসেছিলেন। সে বারেই ভক্তরা একটি ছবি উঠিয়েছিলেন তাঁর। পরিব্রাজক বিবেকানন্দের প্রথম ছবি! উঠেছিলেন জয়পুররাজের প্রধানমন্ত্রী সংসারচন্দ্র সেনের বাড়িতে। সংসারবাবুর নাতনি জ্যোতিমর্য়ী দেবী পরে বাংলা সাহিত্যের নাম করা লেখিকা। তিনি লিখেছেন, সেই বাড়ির বৈঠকখানায় সন্ন্যাসী গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটকের ‘জুড়াইতে চাই, কোথায় যে জুড়াই’ গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন। সেই বাড়ি আজ আর নেই!
ব্যক্তি নরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বিবেকানন্দ’ হয়ে ওঠার পিছনে রাজপুতানার প্রভাব কম নয়। সিমলে পাড়ার নরেন্দ্রনাথ ছাত্রজীবন থেকে গিবনের ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার’ পড়েন, গুরুভাইদের টডের রাজপুত-ইতিহাস পাঠ করে শোনান। ১৮৯৫ সালে আমেরিকা থেকে খেতড়িরাজ অজিত সিংহকে বিবেকানন্দের চিঠি, ‘রাজপুত আপনারা প্রাচীন ভারতের গৌরবস্বরূপ। আপনাদের অবনতি থেকেই জাতীয় অবনতি আরম্ভ হল।....আপনি সেই ক্ষত্রিয় জাতির বংশধর, যাঁরা সনাতন ধর্মের জীবন্ত স্তম্ভস্বরূপ।’
খেতড়ি শহরের পুরনো এক বাড়িতে বৃদ্ধ শিবকুমার শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা। “নারায়ণদাস শাস্ত্রী আমার ঠাকুর্দার বাবা, বিবেকানন্দজী এই বাড়িতেই পড়তে আসতেন,” বললেন তিনি। প্রথম বার খেতড়িতে থাকার সময় নারায়ণদাসের কাছে পাণিনির ব্যাকরণ পড়েছিলেন বিবেকানন্দ। পণ্ডিত সুন্দরলাল ওঝার কাছে যজুর্বেদ। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী তাঁর ‘ইউরোপ রিকনসিডার্ড’ গ্রন্থে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ কবির, দাদূর মতো মধ্যযুগীয় সমন্বয়বাদ। সেই মতের সন্তান বিবেকানন্দ কেন অদ্বৈত বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন? তপনবাবুর সিদ্ধান্ত ছিল, বিবেকানন্দের পরিব্রাজক পর্বটি তাই খুঁটিয়ে দেখা দরকার। খেতড়িতে বিবেকানন্দের পাণিনি এবং যজুর্বেদ অধ্যয়নই বুঝিয়ে দেয়, বাঙালি ঐতিহ্য থেকে তিনি কোথায় আলাদা! বিবেকানন্দের আগে বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের সম্প্রদায়গত ঐতিহ্য ছিল। ঈশ্বর সাকার না নিরাকার তা নিয়ে হিন্দু-ব্রাহ্ম তর্ক ছিল। কিন্তু বৈদান্তিক সন্ন্যাসী? বিবেকানন্দই প্রথম বৈদান্তিক সন্ন্যাসের সর্বভারতীয় মানচিত্রে উনিশ শতকের বাংলাকে নিয়ে এলেন।
বেলুড় মঠের প্রতিষ্ঠাতাকে তাই আজও রাজস্থান, হরিয়ানার সন্ন্যাসীরা দেখেন অন্য চোখে। বওয়াইয়ের রাস্তায় প্রায় জনশূন্য এক মন্দির। এটি বাবা সুন্দরদাসজির সাধনস্থল। সপ্তদশ শতকে বিকানের রাজপরিবারের সুন্দরমল সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। “বিবেকানন্দজি কেন এ দিকে এসেছিলেন জানেন? এই আরাবল্লী পাহাড় হিমালয়ের থেকেও প্রাচীন, সাধু-মহাত্মাদের আবাস। আরাবল্লীর আধ্যাত্মিক শক্তি-ই ওঁকে এই অঞ্চলে টেনে এনেছিল।” বললেন
এক গেরুয়াধারী।
আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য আছে, আছে বাংলা-রাজস্থান অর্থনৈতিক সম্পর্কের ঐতিহ্য। খেতড়ি রামকৃষ্ণ মিশনের বোর্ডে বিবেকানন্দ-সম্পর্কিত কিছু চিঠি সাঁটা। বেশির ভাগই বিবেকানন্দের মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের সই-করা মানি রিসিট। বিবেকানন্দের পরিবারকে মাসিক একশো টাকা পাঠাতেন খেতড়ির রাজা। দেওয়ান জগমোহনলালকে মহেন্দ্রনাথের চিঠি, ‘আপনার অনুগ্রহপত্র ও ৫০ টাকা পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি।’ খেতড়ি থেকে কলকাতায় টাকা আসত অদ্ভুত ভাবে। মহেন্দ্রনাথকে জগমোহন লিখছেন, ‘মহারাজের ইচ্ছা অনুযায়ী v/41/62743 নম্বরের একশো টাকার কারেন্সি নোটের অর্ধাংশ পাঠালাম। আপনার চিঠি পেলে বাকি অর্র্ধাংশ পাঠাব।’ ‘রাজস্থান-বাংলা মৈত্রী পরিষদ’-এর অধ্যক্ষ শিশির বাজোরিয়া বলেন, “শেখাবতী, বিকানের, মারওয়াড় থেকে রাজস্থানিরা সেই সময় কলকাতায় আসছেন। তাঁদের পরিবার থাকছেন রাজস্থানে। সেখানেও এই ভাবে টাকা আদানপ্রদান হত।” রাজস্থানের লোকেরা তখন থেকেই বড়বাজার এলাকার বাসিন্দা। শেষ বয়সে জগমোহনের আর্থিক অবস্থা খারাপ, কিছু দিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছেন কটন স্ট্রিটে। মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, অন্য রাজস্থানীরা তখন জগমোহনকে বেশ কটুকাটব্য করতেন। খেতড়িরাজ অজিত সিংহ এবং তাঁর গুরু বিবেকানন্দ তখন আর পৃথিবীতে নেই। ১৯০১ সালে অজিত সিংহের মৃত্যুর দিন বিবেকানন্দ হিমালয়ের মায়াবতীতে। পরের বছরই তিনি দেহ রাখেন। গুরুশিষ্যে অদ্ভুত সংযোগ!
সার্ধশতবর্ষে খেতড়ি রামকৃষ্ণ মিশনের ‘ফতেহ বিলাস’ সংস্কার সেই সংযোগকেই তুলে ধরতে চাইছে। “সংস্কারের পর আশ্রমের নতুন প্রবেশপথ হবে রাজপ্রাসাদের আদলে। দু’ দিকে দু’টি ছত্রী। একটিতে সন্ন্যাসীর কমণ্ডলু ও দণ্ড। অন্যটিতে রাজদণ্ড।” বলছিলেন খেতড়ি মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী আত্মনিষ্ঠানন্দ।
নৃপতি ও সন্ন্যাসী এ বার রয়ে যাবেন পাশাপাশি!
|