তৈরি হয়েইছিল সংশয়। দীর্ঘ দু’সপ্তাহের টানাপোড়েনের পরে সেটাই সত্যি হয়ে গেল।
শুক্রবার দুপুরে সলমন রুশদি আমেরিকা থেকে জানালেন, জয়পুর সাহিত্য উৎসবে তিনি আসবেন না। “মহারাষ্ট্র ও রাজস্থান থেকে গোয়েন্দা দফতর সূত্রে খবর পেয়েছি, আমাকে খতম করার জন্য মুম্বই থেকে অন্ধকার জগতের ভাড়াটে খুনিরা ইতিমধ্যে জয়পুর রওনা দিয়েছে।...এই পরিস্থিতিতে আমি ওখানে গেলে সেটা আমার পরিবারের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কাজ হবে। জয়পুরে আসা দর্শক এবং আমার বন্ধু লেখকদের প্রতিও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেওয়া হবে,” জানিয়েছেন তিনি।
অতএব? সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াতে পারলেও ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’-এর লেখক আসতে পারলেন না জন্মভূমি ভারতে।
হ্যাঁ, সারা দুনিয়া! খোমেইনির মৃত্যুর পর ইরানও আজকাল সেই পুরনো ফতোয়া নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। পাঁচ বছর আগে রুশদি এই জয়পুর উৎসবে এসেওছিলেন। তখনও মৌলবাদী সংগঠনগুলি পুরনো কাসুন্দি খুঁচিয়ে তোলেনি। দু’দশক আগের ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর পর রুশদি ইতিমধ্যে ‘দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট’, ‘শালিমার দ্য ক্লাউন’ অনেক কিছু লিখে ফেলেছেন। “চিনে অনেক গুজব ছড়ায় না? সলমনের ঘটনাটাও সে রকম হল। অন্য দেশ হলে ওকে রাস্তায় গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে অভ্যর্থনা জানানো হত,” বলছিলেন উইলিয়াম ডালরিম্পল।
কংগ্রেস তথা কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য বিষয়টির দায় নিজের কাঁধে নিচ্ছে না। দলের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি আজ বলেন, “আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধ। সরকার কোনও ভাবেই রুশদিকে আসতে নিষেধ করেনি।” রুশদিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতি সতর্ক নজর রাখা মানে রুশদিকে আসতে বাধা দেওয়া নয়, দাবি করেন অভিষেক। তাঁর বক্তব্য, রুশদি নিজে যদি বিপদের আশঙ্কায় ঝুঁকি নিতে না চান, সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত। তার দায় কোনও ভাবেই কংগ্রেস বা কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে চাপানো উচিত নয়।
রাজীব গাঁধীর আমলে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ ভারতে নিষিদ্ধ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেই উপন্যাসের পেপারব্যাক সংস্করণ এখন সারা দেশেই পাওয়া যায়। ইরানের ফতোয়ার শেষটিও সে রকম। ওয়াকিবহাল মহল জানে, খোমেইনির মৃত্যুর পর ইরানের সঙ্গে পশ্চিমী দেশগুলির একটা অলিখিত সমঝোতা হয়েছিল যে, ওই ফতোয়া নিয়ে তারা আর উচ্চবাচ্য করবে না। দুনিয়া সে ভাবেই চলছিল। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে হঠাৎ পুরনো কঙ্কালটি আলমারি থেকে বার করা হল। “লেখকের লেখা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে, কিন্তু এটা তো বিতর্ক নয়। এটা অন্য কিছু”, বলছিলেন সাহিত্য উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা সঞ্জয় রায়। উৎসব শুরুর আগে বৃহস্পতিবার রাতের পার্টিতে তিনি এবং উইলিয়াম ডালরিম্পল বেশ খোশমেজাজেই ছিলেন। “আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। ওঁর জন্য আমাদের আমন্ত্রণ রইলই,” বলছিলেন তাঁরা। সঞ্জয়রা যদিও জানতেন, রুশদি ২০ তারিখে আসছেন না। কিন্তু একেবারেই আসবেন না, সেটা বোধহয় ভাবেননি। শুক্রবার দুপুরে রুশদির বার্তা পেয়ে তাঁরাও বিষণ্ণ।
আর রুশদি নিজে? টুইটে লিখেছেন, জয়পুরে আসতে না পারায় দুঃখিত। “রাজস্থানের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আমি এত দিন জনসমক্ষে কিছু বলিনি,” শুক্রবার দুপুরের বার্তায় লিখেছেন। সিদ্ধান্তটা নিয়ে আসলে গত কয়েক দিন ধরেই মনে মনে নাড়াচাড়া করছিলেন। এর
মধ্যে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত নিজে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে দেখা করে বলে এসেছেন, রাজস্থানের মানুষ রুশদিকে চান না। রুশদির উপরে হামলা হতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথাও সরকারি তরফেই সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়েছিল। বৃহস্পতিবার হঠাৎ রুশদির ‘টুইট’ “সিমি বলছে, ও এক জন সলমনকেই পছন্দ করে, সে বলিউডের অভিনেতা (Simi said, the only salman she liked, worked in bollywood)।” কে সিমি? ‘স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্টস ইন ইন্ডিয়া’-কে ‘শি’ বানিয়ে সিমি গঢ়বালের অনুষঙ্গ এনে ফেলেছেন রুশদি!
সকালে দেখছিলাম, উৎসবস্থল ‘ডিগ্গি প্রাসাদ’-এ আসার রাস্তা পুলিশে ছয়লাপ। তিনটে মেটাল ডিটেক্টর বসানো দরজা, উপরন্তু প্রতিনিধিদের গলায় ঝোলানো রেজিস্ট্রেশন কার্ডের ছবি তুলছেন গোয়েন্দারা। “থ্রি-টিয়ার সিকিউরিটি,” বলছিলেন জয়পুরের পুলিশ কমিশনার ভগবানলাল সোনি। রুশদি আসবেন না জানানোয় তাঁরা আপাতত টেনশনমুক্ত।
উৎসব কি ম্লান হয়ে গেল কিছুটা? উত্তরে ডালরিম্পল (তিনিই উৎসবের ‘ডিরেক্টর’) বললেন, “২৫২ জন লেখক। শ্রীলঙ্কার মাইকেল ওনদাতজে, নাইজিরিয়ার বেন ওকরি সবাই এসেছেন। রুশদির না-আসা দুঃখের অবশ্যই। কিন্তু উৎসব ম্লান হবে না।” ঠিকই। এ দিনই তো কাশ্মীরের লেখক হরি কুঞ্জরু ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ থেকেই পাঠ করলেন! রুশদিকে টুইট-বার্তায় বার্তায় জানালেনও তা। রুশদি বললেন, “ধন্যবাদ!” ফলে রুশদি না থেকেও আছেন। টিভি শো-র শু্যটিং করতে জয়পুরে এসেছেন ওপরা উইনফ্রে, রবিবার সাহিত্য উৎসবেও আসবেন। আসবেন ফতিমা ভুট্টো। এসে গিয়েছেন গুলজার, গিরিশ কারনাড। ঘুরে বেড়াচ্ছেন ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার সম্পাদক ডেভিড রেমনিক।
এবং ব্যক্তিগত আড্ডায় এঁরা সকলেই একটা বিষয়ে একমত। রুশদির আসতে না-পারাটা জয়পুর সাহিত্য উৎসব নয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতা! |