|
|
|
|
টলিউডেও মা-মাটি-মানুষের সঙ্গে, বার্তা মমতার |
গৌতম ভট্টাচার্য |
রাত সওয়া ন’টা। সাদা শার্টের নায়ককে দেখা গেল হাসিমুখে মুখ্যমন্ত্রীর দিকে এগোচ্ছেন।
নায়িকা একটু পেছনে। সবাইকে বলছেন ‘‘প্লিজ, প্রার্থনা করুন আমাদের জন্য। খুব ঘাবড়ে আছি।’’
প্রযোজকও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে টেনশন তাঁকে চেপে রেখেছে।
মনে হবে, এঁরা অবশ্যই দেব। শুভশ্রী। আর ‘খোকাবাবু’ নামে যে ছবি দেখতে বৃহস্পতিবার রাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির হয়েছিলেন, তার প্রযোজক অশোক ধানুকা।
আসলে এঁরা জিৎ। কোয়েল। আর ধানুকার প্রবল প্রতিপক্ষ ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের শ্রীকান্ত মোহতা।
বৃহস্পতিবার রাত সওয়া ন’টায় তাঁরা সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। নবীনা সিনেমা পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে, তা নিয়ে ততক্ষণে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। নবীনাতে যে রাত সাড়ে ন’টায় এঁদেরই ‘১০০% লভ’-এর প্রাইভেট শো। সেখানে তাঁরাই কিছু লোককে নেমন্তন্ন করেছেন। অথচ শো-এর ১৫ মিনিট আগেও নিজেরা বসে আছেন প্রতিপক্ষের নেমন্তন্নে!
পশ্চিমবঙ্গের ফিল্ম ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা অনেক কিছু করেছেন যা বেনজির। তালিকায় আরও একটা ‘প্রথম’ সংযোজিত হল বৃহস্পতিবার। বিশেষ কোনও নায়কের ছবির পর মুখ্যমন্ত্রী সকলকে চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, এমন কখনও হয়নি। পূর্বতন কোনও মুখ্যমন্ত্রী টালিগঞ্জের বাণিজ্যিক ঝাঁপি থেকে উৎপন্ন ছবির বিশেষ প্রদর্শনীতে হাজির থেকেছেন বলে কেউ মনে করতে পারলেন না। হায়দরাবাদ থেকে ফোনে প্রসেনজিৎ বললেন, “আসার খুব ইচ্ছে ছিল। শুটিং এমন আটকে দিল যে পারলাম না।” ঋতুপর্ণাও আগরতলা থেকে ফ্লাইট দেরিতে নামায় আসতে পারেননি। কিন্তু শীর্ষস্থানীয়দের মনোভাবে বোঝা গেল, টালিগঞ্জ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অবিভক্ত ভাবেই রয়েছে।
আগের মুখ্যমন্ত্রীরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ‘ভুবন সোম’ থেকে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’। ‘সোনার কেল্লা’ থেকে ‘মনের মানুষ’। ‘খোকাবাবু’ আধ ঘণ্টারও বেশি হয়ে যাওয়ার পর মমতা যখন হলে ঢুকলেন, তীব্র শোরগোল পড়ে গেল। একাধিক টিভি ক্যামেরাম্যান আর ফটোগ্রাফার, এত আলো আর ভিড়, মনে হচ্ছিল সমান্তরাল ভাবে আরও একটা সিনেমা শু্যট হচ্ছে। হলকর্মীরা অবশ্য বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাঁদের দ্রুত বের করে দিলেন। মমতা অন্তত হলে গিয়ে তাঁর প্রথম বাণিজ্যিক ছবি দেখতে বসলেন শান্ত মনে। |
|
|
তিনি মেলালেন। মমতার চা-চক্রে হাজির প্রযোজকদের সব শিবিরই।
উপস্থিত ছিলেন দেব (বাঁ দিকে) এবং জিৎ, জনপ্রিয় দুই নায়কই। নিজস্ব চিত্র |
বাণিজ্যিক ছবি মানে অনিবার্য ভাবে কিছুটা ‘লাউড’ অভিনয়। নাচ-গান। ফাইটিং। ‘খোকাবাবু’তে সে সবের বাহার অপর্যাপ্ত। দেব যখন তাঁর ১৭৭তম মারপিটটা করছেন, ফিসফাস চলছিল, দিদি কি ফাইটিং পছন্দ করেন? এক জন বললেন, ‘‘একটুও করেন না শুনেছি।’’ আর এক জন বললেন, ‘‘না না। উনি বুঝতেই পারবেন। কিছু মনে করবেন না।’’ যাঁরা বলাবলি করছেন সবাই টালিগঞ্জেরই শিল্পী বা পরিচালক। পর্দায় একটু পরেই শুভশ্রীকে দেব বললেন, ‘এই, দাও না গো গালে একটা। তাড়াতাড়ি দাও।’ ঝটিতি আতঙ্কিত নায়িকা, ‘‘কেলেঙ্কারি করেছে। দিদি ঢুকতেই এ সব শুরু হল!’’ পেছন ফিরে তখন সবাই দেখছেন, দেবের পাশে বসে মমতা কী করছেন। রিপোর্ট এল, দিদি এসএমএস করছেন। কিছু পরে নায়ক-নায়িকা চলে গেল সুইৎজারল্যান্ডে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দর্শকাসনে তখন দেবশ্রী, রচনা, জুন, প্রভাত রায়, গোটা টিম-সহ রাজ চক্রবর্তী, হরনাথ, কোয়েল, আবির, রিমঝিম মিত্র, সৌমিলি, শুভাশিস, যোগেন চৌধুরী, দীপঙ্কর ও দোলন, রজতাভ, জয় গোস্বামী, মমতাশঙ্কর, গৌতম ঘোষ, সস্ত্রীক সন্দীপ রায়, বিভাস চক্রবর্তী, ‘ভূমি’র সৌমিত্র, শান্তনু রায়চৌধুরী। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী, মানালি-সপ্তকরা এলেন পরে। ছিলেন জনা চারেক মন্ত্রী। কলকাতা পুলিশের নগরপাল থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় অফিসাররা।
শুক্রবার দেব জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজ নিয়েছেন বাইরের ক’টা লোকেশনে শু্যটিং হয়েছে। প্যারিস, জুরিখ আর হায়দরাবাদ শুনে বলেছেন, “কিছুদিন পরে আর তোমাদের হায়দরাবাদ যেতে হবে না। এখানে ফিল্মসিটি বানিয়ে দিচ্ছি। কলকাতাটাকেই এমন সুন্দর করে দেবো যে, প্যারিস-ট্যারিস না গিয়ে এখানেই শু্যটিং করতে পারবে।” দেব স্বীকার করলেন, ওই চুমু-পর্বে “লজ্জায় নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভয় হচ্ছিল উনি কী না কী ভাববেন।” ২৪ ঘণ্টা পরেও মনে হল, দেব নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। “দিদি উঠে একটু ঘুরে আসতে পারতেন। কিন্তু উনি পুরোটা শুধু বসে দেখলেনই না। কত প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘তোমাকে তো ইন্টারন্যাশনাল হিরোর মতো দেখতে লাগছে। তোমাদের এই সব ছবি মুম্বই নিয়ে যাওয়া উচিত।”
অতঃপর? কয়েক কোটি টাকার ‘খোকাবাবু’ দারুণ প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করে লক্ষ্যমাত্রার সামান্য কমে থমকে আছে এই বাজারি বিশ্লেষণকে উড়িয়ে দিচ্ছেন অশোক ধানুকা। বলছেন, “উল্টে অনেক রেকর্ড আমরা গড়েছি।” তা হলে যে ইন্ডাস্ট্রি বলছে? বৃহস্পতিবার রাতে ‘শত্রুশিবির’কে যতই আতিথেয়তা করুন না কেন, ধানুকার একটাই ব্যাখ্যা “সব বিরোধী প্রচার।” এ দিন ‘পাগলু টু’ শু্যটিং শুরুর ফাঁকে দেব অবশ্য স্বীকার করলেন, কয়েকটা ‘চেন উইক’ আছে। তাই প্রত্যাশার থেকে ‘টেন পার্সেন্ট’ কম হয়েছে। এর পরেই দ্রুত আশাবাদী তিনি, “এত মানুষ দিদিকে ভালবাসেন। ওঁরা নিশ্চয়ই দিদির এতক্ষণ বসে দেখা ছবিকে অন্য চোখে দেখবেন।”
টালিগঞ্জের অন্যান্য শিবিরে কিন্তু জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে যে, দিদি দেবকে ভালবাসেন বলে নিজে থেকে চলে গেলেন। এ বার তো অন্যরাও তাঁকে ডাকতে চাইবে। তখন কী করবেন? পার্টিতে বসেই নিজের নতুন বইয়ের প্রুফ দেখতে ব্যস্ত মমতাকে দেখে মনে হল না, সে সব নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা আছে তাঁর। বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে তাঁর মুখে ছুটকো বিদ্রুপও কেউ শুনল না। এসআরএফটিআই আগের দিন থেকে প্রতিবাদী পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। নীরব অবরোধকারীরাও ছিলেন। সে সব অগ্রাহ্য করে মমতা ঢোকেন সাড়ে সাতটা নাগাদ। বেরোন চার ঘণ্টা বাদে। দেব বলছিলেন, “রাত সাড়ে এগারোটা অবধি উনি থাকলেন ভাবতেই পারিনি। আর বেশ এনজয় করেই থাকলেন।”
পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী হলে? বাইপাস উজিয়ে দেবের ছবি দেখতে আসা দূরে থাক। হয়তো দু’জনের সাক্ষাৎই হত না। মমতার সফর ইঙ্গিত দিল, ‘টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির মা-মাটি-মানুষের ধারার সঙ্গেও আমি আছি। সে লোকে তাকে যে চোখেই দেখুক।’
বলা হয়নি, বইমেলায় মমতার নতুন বইয়ের নাম ‘পরিবর্তন’। |
|
|
|
|
|