একের পর এক অভিযোগ, কিন্তু কারও যেন হুঁশ নেই।
শুক্রবার সেনপাড়া গ্রামের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র শৌভিক মণ্ডল সাইকেলে স্কুলে যাওয়ার পথে পড়ে গেলে থুতনি কেটে যায়। আহত ছেলেকে নিয়ে কখনও ভ্যান রিকশায় কখনও পায়ে হেঁটে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে এসে আরও বড় বিপদে পড়তে হয় শৌভিকের মা মিঠু মণ্ডলকে। আধঘন্টা ধরে খোঁজাখুঁজির পরে যখন কর্তব্যরত চিকিসকের দেখা পান, তিনি তাঁকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন- ‘সেলাই করা তো আমার কাজ নয়, সেলাই তো করবেন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীরা’। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বিনা চিকিৎসায় পড়ে ছিল ওই ছাত্র। পরে স্থানীয় লোকজন বিক্ষোভ দেখালে ওই চিকিৎসকই শৌভিকের চিকিৎসা করেন। তারপরেই রবিবার চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে হাসপাতালের আর এক চিকিৎসক ঐন্দ্রিলা বসুর বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, আট মাসের অসুস্থ এক বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও প্রাথমিক চিকিৎসা করা তো দূরের কথা, বাচ্চাটিকে তিনি ছুঁয়েও দেখেননি। হাসপাতালে কোনও শিশু বিশেষজ্ঞ নেই বলে তিনি সেই বাচ্চাকে কোনও শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে বলেন।
ঘটনা হল, দু’ক্ষেত্রেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য কর্তারা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেই দায় সেরেছেন। সুদীপা মণ্ডল নামে ওই চিকিৎসককে শো কজও করা হয়। করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের সুপার বিধুভূষণ মাহাতো বলেন, ‘‘শুক্রবারের ঘটনায় সুদীপা মণ্ডলকে গত শনিবার শো কজের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিঠি পাওয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যেই ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে লিখিতভাবে ওই দিনের ঘটনার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। রবিবারের ঘটনায় ঐন্দ্রিলা বসুর বিরুদ্ধে একটা লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু করা হয়েছে।’’
কিন্তু কেবল তাতেই কি হাসপাতালের অসুখ সারবে? স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, পরপর যে অভিযোগগুলি উঠছে, তা আসলে রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। মূল রোগটি রয়েছে আরও গভীরে। তার কোনও চিকিৎসা হচ্ছে না। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অমিত হালদারও বলেন, ‘‘করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের এত অভিযোগ। কিন্তু জেলার অন্য কোনও হাসপাতাল থেকে এত অভিযোগ আসে না। ওখানে কিছু একটা সমস্যা চলছে। সেখান থেকেই এই ধরনের জটিলতাগুলো তৈরি হচ্ছে।” রোগটা কী? হাসপাতালের এক কর্তার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘‘এই হাসপাতালে কারও সঙ্গে কারোর কোনও সমন্বয় নেই। কিন্তু হাসপাতালের কাজটা তো আসলে একটা টিম ওয়ার্ক। সেটা না হওয়ার ফলে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটছে।’’ হাসপাতালসূত্রে জানা গিয়েছে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসক থাকার কথা ১১ জন। সেখানে রয়েছেন মাত্র ৭ জন। শিশু বিশেষজ্ঞ, সার্জেন, অ্যানাসথেটিস্ট, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। ফলে অন্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসক কম থাকায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব বেশি। তাই অনেক সময়েই ‘ছোটখাট’ কাজের দায়িত্ব নিতে চান না চিকিৎসকেরা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোজ একটা বড় ধাক্কা সামলান চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা। কিছু রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাঁরাই করে থাকেন। হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী বিশ্বনাথ কর্মকার বলেন, ‘‘ক্ষতস্থানে সেলাই করা, ব্যান্ডেজ করার মতো কাজ আমরাই করতাম। কাজগুলো করতে করতে আমরা ওগুলো কিছুটা রপ্তও করে ফেলেছি। কিন্তু আমাদের কোনও প্রশিক্ষণ নেই, অধিকারও নেই। তাই রোগীর কোনও ক্ষতি হয়ে গেলে, তিনি তো আর আমাদের ছেড়ে কথা বলবেন না। তখন আমরা বিপদে পড়ে যাব।’’
সম্প্রতি এই রকম একটি বিবাদের পরেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা এই ধরনের কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছেন। সুপার বিধুভূষণবাবু বলেন, ‘‘চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা আমাকেও এ রকম একটা সমস্যার কথা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন। আমরা আলোচনা করছি যাতে দ্রুত এই সমস্যাটা মিটে যায়।’’ জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, শুধু করিমপুর হাসপাতাল নয়, রাজ্যের বেশিরভাগ হাসপাতালেই সেলাই, ব্যান্ডেজ, ইনজেকসন দেওয়ার মত কাজগুলো করে থাকেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাই। তাঁরা না পারলে তখন চিকিৎসকেরা বিষয়টি দেখেন। এটাই দস্তুর। ফলে তাঁরা যদি এই ধরনের কাজগুলো না করেন, তা হলে হাসপাতালের বিশৃঙ্খলা হবেই। কারণ প্রয়োজনের তুলনায় সর্বত্রই চিকিৎসক ও কর্মী কম আছেন।
|