সোমনাথ সরকার। বয়স ৫৭। মস্তিষ্কে আঘাত। অভিযোগ, ভর্তির জন্য শনিবার এসএসকেএমে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। হাসপাতাল জানাচ্ছে, তাদের কাছে এই ঘটনার কোনও রেকর্ড নেই।
অতসী বারুই। বয়স ৬৮। কোমরের হাড় ভেঙেছে। অভিযোগ, রবিবার দুপুরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে শয্যা না-পেয়ে ফিরে এসেছেন। মেডিক্যালের নথিতে অবশ্য এমন তথ্য নেই।
তিনু ঘোড়ই। বয়স ২৬। অভিযোগ, পেট ব্যথা, বমি নিয়ে সোমবার এনআরএসে গিয়ে বেড পাননি। হাসপাতালের খাতায় এ রকম কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
পাওয়ার কথাও নয়। কারণ, ‘নিয়ম’ যা-ই হোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী প্রত্যাখ্যানের কোনও রেকর্ড রাজ্যের প্রায় কোনও সরকারি হাসপাতালে রাখা হয় না। যদিও চিত্তরঞ্জন সেবাসদন থেকে প্রসূতি ফেরানোর অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে রবিবার স্বাস্থ্য-কর্তারা দাবি করেছেন, ঊষা তাঁতিকে ওই হাসপাতাল থেকে যে ফেরানো হয়নি, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত। কারণ, ফেরালে তার ‘রেকর্ড’ থাকত।
হাজারো রোগীর নিত্য অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য কথা বলছে। বলছে, সরকারি হাসপাতালে শয্যা না-পেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লিখিত ভাবে কিছু জানানো হয় না। শুধু মুখে বলে দেওয়া হয়, ‘এখানে বেড নেই, অন্য হাসপাতালে যান।’ বাড়ির লোকের চাপে কখনও যদিও বা হাসপাতালের কাগজে রোগী ‘রেফার’ করার কথা লেখা হয়, হাসপাতালের নিজস্ব রেকর্ডে রোগী ফেরতের কোনও তথ্যই রাখা হয় না। সরকারি ডাক্তারদের একটা বড় অংশও জানাচ্ছেন, শুধু অন্য হাসপাতাল থেকে ‘রেফারড’ রোগীদের ক্ষেত্রেই তাঁরা তথ্য লিখে রাখেন। ঊষাদেবী যে হেতু অন্য হাসপাতাল থেকে রেফারড হয়ে যাননি, তাই তাঁর রেকর্ডও চিত্তরঞ্জনে থাকার কথা নয় বলে এঁদের অভিমত।
তা হলে কীসের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য-কর্তাদের ওই দাবি?রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার বলেন, “সেই দাবি থেকে তো এখনও সরছি না। রোগী ফেরালে হাসপাতালে তার তথ্য থাকারই কথা। অন্যথা হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কড়া শাস্তি হবে।” পাশাপাশি সুশান্তবাবু এ-ও বলেন, “আমার মনে হয় না, অন্যথা কোথাও হয়।”
চিকিৎসকমহলের একাংশ অবশ্য স্বাস্থ্য-কর্তার এই দাবিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ দিন কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে প্রবীণ স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “এত বছর কাজ করেছি। কস্মিনকালেও দেখিনি, রোগী ফিরিয়ে দিয়ে হাসপাতাল নিজের খাতায় সে সব রেকর্ড রাখছে! এগুলো ডাহা মিথ্যে কথা।” এসএসকেএমের এক ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের বক্তব্য, “হামেশাই রোগী ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। জায়গা না-থাকলে আমরা প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দিই অন্য কোথাও যেতে। এ সব যদি লিখে রাখতে হয়, তা হলে তো দিনভর লেখালেখিই করতে হবে! রোগী দেখব কখন?” কলকাতা মেডিক্যালের এক তরুণ চিকিৎসক জানাচ্ছেন, কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে এক বারও তাঁকে রোগী ফেরতের হিসেব লিখতে হয়নি। কেউ তাঁকে এমন কোনও নিয়মের কথা জানানওনি।
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা অবশ্য বলছেন, “হাসপাতালে রোগী হয় ভর্তি হবে, নয়তো ফেরত পাঠানো হবে। মাঝামাঝি তো কিছু নেই! ভর্তি হলে সেটা যেমন লেখা হবে, ভর্তি না-হলেও তো লেখা থাকবে!” কিন্তু যখন সঙ্কটাপন্ন রোগীকে নিয়ে বাড়ির লোক টিকিট না-করিয়েই তড়িঘড়ি ইমার্জেন্সিতে ঢোকেন! এবং সেখান থেকে তাঁদের বলে দেওয়া হয়, ‘বেড নেই!’ ফিরে যাওয়া সেই রোগীদের তথ্যও কি হাসপাতাল লিখে রাখে?
এর কোনও উত্তর সুশান্তবাবুর কাছে মেলেনি। |