সবুজ বা সাদা, কোনও কার্ড নয়। নিলোফার রহমান শুক্রবার বেমালুম কার্ড ছাড়াই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তিনতলায় মহিলা বিভাগে ঢুকে পড়েছিলেন বলে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ মনে করছে। তদন্তকারীদের দাবি, শিশুচুরির অভিযোগে ধৃত মহিলাটিকে জেরা করে সোমবার এমনই ইঙ্গিত মিলেছে।
ঘটনা হল, নিলোফারের কথার সঙ্গে শিশুটির মা কানিজ বেগমের বক্তব্য মিলছে না। কানিজ বলছেন, শুক্রবার নিলোফারের হাতে তিনি সবুজ কার্ড দেখেছেন, তবে সেটা বাড়ির কারও দেওয়া নয়। কানিজের দাবি, হাসপাতাল থেকে দু’টো সাদা কার্ড দেওয়া হয়, যা শুধু তাঁর বাড়ির লোকই ব্যবহার করত।
দুই মহিলার পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে তদন্তকারীরা কিছুটা বিভ্রান্ত। যার নিরসনে তাঁরা কানিজ বেগমের আশপাশের শয্যার মহিলাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তাঁদের আবার দাবি, নিলোফারকে ওয়ার্ডে দেখলেও হাতে কোনও কার্ড দেখা যায়নি। এরই প্রেক্ষিতে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, কার্ড ছাড়াই নিলোফার ওয়ার্ডে ঢুকেছিলেন। কার্ড ছাড়া ওয়ার্ডে প্রবেশ এবং শিশুচুরির সঙ্গে কোনও চক্রের যোগসাজশের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
রবিবার সন্ধ্যায় বেনিয়াপুকুর থানার পুলিশ ব্রড স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটে নিঃসন্তান নিলোফার ও তার স্বামী শেখ রাজুর হেফাজত থেকে চুরি যাওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করে। ধৃত দম্পতিকে এ দিন শিয়ালদহ আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। |
আদালতে নিলোফার ও শেখ রাজু। নিজস্ব চিত্র |
নিলোফার যে ভাবেই ঢুকুন না কেন, প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান পরিকাঠামোয় সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে বহিরাগতদের ঢোকা বন্ধ করা সম্ভব কি? কারণ, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় প্রায় বিনামূল্যে। তার পিছনে রাজ্যকে প্রচুর ভর্তুকি গুনতে হয়। এমতাবস্থায় রোগীর নিরাপত্তার দায় নেওয়াটা সরকারের পক্ষে সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই সামনে এসেছে। রাজ্যের এক স্বাস্থ্যকর্তার মতে, বেসরকারি হাসপাতালে চার্জের মধ্যে রোগীর নিরাপত্তার খরচও ধরা হয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে যে টাকায় চিকিৎসা হয়, তাতে প্রতি রোগীর জন্য আলাদা করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অসম্ভব।
সরকারি হাসপাতালে বিপুল চাপের দরুণ রোগীর নিরাপত্তার ভার যে সরকার নিতে পারবে না, তা রবিবারই স্পষ্ট জানান স্বাস্থ্যকর্তারা। সোমবারও তাঁরা জানিয়েছেন, সরকারি পরিকাঠামোয় গরিবদের নিখরচায় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু নিরাপত্তা সম্পর্কে রোগীকেও সচেতন হতে হবে। আর রোগীর পরিজনকে হাসপাতালে থাকার জন্য যে গ্রিন কার্ড দেওয়া হয়, তা অপরিচিতের হাতে চলে গেলে ‘বিপদ’ আসতেই পারে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, “সব দায়িত্ব সরকারের পক্ষে নেওয়া কার্যত অসম্ভব।”
এ দিন বিভিন্ন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষও জানিয়েছেন, যে ভাবে ওয়ার্ডে রোগীর বাড়ির লোক ভিড় জমান, তাতে শুধু নিরাপত্তা নয়, চিকিৎসাতেও বিঘ্ন ঘটে। ন্যাশনালের সুপার পার্থ প্রধানের কথায়, “রোজ ওয়ার্ডে রাউন্ড দেওয়ার আগে বাড়ির লোককে কার্যত হাত জোড় করে অনুরোধ করেন ডাক্তারেরা। তাঁরা ঘর ছেড়ে না-বেরোলে রোগী দেখাই সম্ভব নয়।” এর উপরে ন্যাশনালে ওয়ার্ড থেকে হামেশা বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। এনআরএস থেকেও একই অভিযোগ মিলেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তাঁরা নিয়মে কিছু বদলের কথা ভাবছেন।
তবে নিলোফার ও কানিজ বেগম দু’জনেরই দাবি, তাঁরা কেউ কাউকে চিনতেন না। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তের ইঙ্গিতও তা-ই। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর মনে করছে, তাদের নিজস্ব প্রাথমিক তদন্ত-রিপোর্টই ঠিক। বস্তুত সেই তদন্তের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “ওটা ফ্যামিলির (পারিবারিক) ব্যাপার।” সুশান্তবাবু বলেন, “দু’দিন ধরে মা যদি কোনও অপরিচিতার হাতে সদ্যোজাতকে তুলে দেন, তা হলে হাসপাতালের গাফিলতিটা কোথায়?” কিন্তু কানিজ তো জানিয়েছেন, শুক্রবারই ওই অপরিচিতাকে তিনি প্রথম দেখেন। উপরন্তু দুই মহিলাই নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন। এ ক্ষেত্রে দফতরের বক্তব্য কী? সুশান্তবাবুর মন্তব্য, “যোগাযোগ মানে তো লিখিত ব্যাপার নয়! কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত, সেটাই বলা হচ্ছে।”
কেন সে দিন ন্যাশনালে গিয়েছিলেন নিলোফার? পুলিশের দাবি:শুক্রবার বান্ধবীকে দেখতে তিনি মহিলা বিভাগে গিয়েছিলেন বলে নিলোফার জেরায় জানিয়েছেন। যদিও সেই বান্ধবীর নাম, ঠিকানা, ওয়ার্ড কিছুই জানাতে পারেননি। তাই নিলোফারকে আরও জেরার প্রয়োজন রয়েছে বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন। |