‘চাষি নন’ দাবি মমতার, পাল্টা সূর্যকান্তের
সলের দাম না পেয়ে রাজ্য জুড়ে একের পর এক চাষির আত্মহত্যার অভিযোগ উঠলেও এঁদের সকলকে ‘কৃষক’ বলে মানতেই রাজি নন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঋণের জালে জড়িয়ে কেউ আত্মঘাতী হয়েছেন, এমন কথাও তাঁর সরকার মানতে নারাজ।
গত তিন মাস ধরেই বিক্ষিপ্ত ভাবে চাষির আত্মহত্যার অভিযোগ উঠছিল। কিন্তু শুক্রবার মালদহের হবিবপুর, শনিবার বর্ধমানের পূর্বস্থলী এবং রবিবার কালনা পরপর তিন চাষির আত্মহত্যা নিয়ে শোরগোল শুরু হওয়ায় সরকার চাপে পড়ে গিয়েছে। বিরোধীরাও মুখ্যমন্ত্রীকে ফের তীব্র আক্রমণ করেছেন।
সোমবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, “আমরা বেশ কিছু তদন্ত করেছি। দেখা গিয়েছে, এঁদের অনেকেই কৃষক নন। শেষ ঘটনাটা যেমন, আদৌ কৃষক নন। জমিও নেই।” বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রী বললেন, এঁরা কৃষক নন। ভাল করে খবর নিতে বলেছেন। আমি ওঁকে বলছি, ভাল করে খবর নিন! এঁরাই মা-মাটি-মানুষের স্লোগান দিয়ে সরকার চালান। অথচ বুঝতে পারছেন না, কৃষক কারা!”
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সরাসরি কোনও ‘আত্মঘাতী’ চাষির নাম করেননি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ‘শেষ’ যে তিনটি আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যমের কাছে এসেছে, তিনটি ক্ষেত্রেই চাষির নিজের জমি ছিল।
কালনার ঘনশ্যামপুরে মৃত রবীন্দ্রনাথ পাত্রের পরিবার সূত্রে জানা যায়, তাঁরা দুই ভাই। তাঁর দাদা শম্ভু পাত্র চাষ করেন না, ভাড়াগাড়ি চালান। বাবা ভূপেন্দ্রনাথ পাত্রের নামে পাট্টা পাওয়া পাঁচ কাঠা জমিতে তিনি একাই আলুচাষ করেছিলেন। ঘনশ্যামপুর সমবায় সমিতির ম্যানেজার অজিত পান বলেন, “বাবার নামে থাকা ৮ শতক (প্রায় পাঁচ কাঠা) জমিতেই উনি চাষ করতেন। এই মরসুমে চাষের জন্য আমাদের থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ঋণও নিয়েছিলেন।”
পূর্বস্থলীর চণ্ডীপুর গ্রামে মৃত তাপস মাঝির পরিবারের বক্তব্য, নিজের এক বিঘা জমি ছাড়াও অন্যের জমিতে তিনি ভাগচাষ করতেন। ঋণ শোধ করার জন্য কিছু পাওনাদার তাঁকে চাপ দিচ্ছিল। হবিবপুরে মৃত হরিদাস রত্নের নিজের নামে ১২ বিঘা এবং স্ত্রী-পুত্রের নামে ৮ বিঘা জমি ছিল। ট্রাক্টর কিনতে গিয়ে তিনি ঋণের জালে জড়িয়েছিলেন। ধান উঠলে ঋণ শোধ করবেন ভাবলেও দাম পড়ে যাওয়ায় তা পেরে ওঠেননি বলে পরিবারের আক্ষেপ।
কিন্তু ঋণের জালে জড়িয়ে চাষির আত্মহত্যার অভিযোগ কার্যত উড়িয়ে দিয়ে মহাকরণে কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এ দিন দাবি করেন, “এ ধরনের খবর সংবাদপত্রে দেখেছি। কিন্তু সরকারের কাছে ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যার কোনও খবর নেই। তবে সব মৃত্যুই দুঃখের। তদন্ত হওয়া উচিত।” মুখ্যমন্ত্রী আবার বলেন, “অনেকেই ঋণ নিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো সব পুরনো ঋণ।”
বস্তুত প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘ব্যক্তিগত’ কারণে চাষিরা আত্মঘাতী হয়েছেন বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে রাজ্য প্রশাসন। কালনার রবীন্দ্রনাথ পাত্র চোলাই ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তাঁর গ্রামের জগবন্ধু ঘোষ, কাশীনাথ চক্রবর্তী, অমর সরকারের মতো অন্য চাষিরা জানাচ্ছেন, এটা কারও একার সমস্যা নয়। অতিফলনের জেরে আলু ও ধানের (বোরো ও আমন দুই-ই) দাম না পেয়ে চাষিদের বেশির ভাগই সঙ্কটে পড়েছেন।
সরকার গ্রামে গ্রামে শিবির করে সহায়ক মূল্যে ধান কেনার আশ্বাস দিলেও খুব কম জায়গাতেই তা হয়েছে। ফলে পরের মরসুমের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক কিনতে ফড়েদের কাছে অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। বর্ধমান, হুগলি, দুই মেদিনীপুর কোথাওই হিমঘরে মজুত ৫০ কেজি আলুর বস্তা বিক্রি করে ২০ থেকে ৪০ টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। এক মাত্র কখনও-সখনও কেউ অন্যত্র চালান দেওয়ার জন্য আলু কিনতে এলে তবেই ১২০-১৩০ টাকা দর হাঁকছে হিমঘর। তাতেও চাষের খরচ উঠছে না।
কালনার নান্দাই পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান, আলু ব্যবসায়ী ইদের আলি মোল্লার আক্ষেপ, “৭০০ প্যাকেট আলুর জন্য কোনও দাম পাইনি। আলু রাখার খরচ তুলতে হিমঘরই তা কম দামে বিক্রি করে দিয়েছে।” কালনা মহকুমা প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বিজন শেঠ বলেন, “মজুত আলুর প্রায় কোনও দামই নেই। এমনকী ২ টাকা-৫ টাকাতেও ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে। তা-ও কেনার লোক নেই। আমরাই মহকুমায় আলুর রোজকার বাজারদর স্থির করি। কিন্তু ব্যাপক কম দামে আলু বিক্রি হতে থাকায় ১৫ ডিসেম্বর থেকে বাজারদর ঘোষণা বন্ধ করে দিয়েছি।” এ বারও আলুর ভাল ফলন হয়েছে। ফলে বিপর্যয়ের আশঙ্কায় কোথাও কোথাও তা কম দামেই বেচতে শুরু করেছেন চাষিরা। যেমন পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কিছু এলাকায় ৫০ কেজির নতুন আলুর বস্তা ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ। আলুর কথা না তুললেও ধানের ন্যায্য মূল্য না মেলার অভিযোগ পেয়েছেন বলে কৃষিমন্ত্রী এ দিন মেনে নেন। তিনি বলেন, “খাদ্যমন্ত্রী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।” ফসলের ন্যায্য দাম ও ‘আত্মঘাতী’ চাষির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিতে এ দিনই উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কৃষি দফতরে বিক্ষোভ দেখান প্রায় আড়াইশো কৃষক। সূর্যবাবুও দাবি করেন, “আমরি-কাণ্ড এবং বিষমদ-কাণ্ডে মৃতদের মতোই আত্মঘাতী কৃষক এবং অনাহারে মৃতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।” মুখ্যমন্ত্রী কি দায় এড়াচ্ছেন? সূর্যবাবুর জবাব, “দায় মনে করলে তো দায় এড়াবেন! উনি তো বলছেন, কিছুই হয়নি!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.