|
|
|
|
ভার কমাতে প্রতিমন্ত্রী নিলেন স্বাস্থ্যে, দফতর পাল্টে ‘বার্তা’ কংগ্রেসকে |
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদে জড়ালেন মনোজ |
অনিন্দ্য জানা • কলকাতা |
রাজ্য মন্ত্রিসভার দফতর রদবদল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই সরাসরি তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন কংগ্রেসের মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তী।
সোমবার বিকেলে মন্ত্রিসভায় নতুন দুই মন্ত্রীর শপথ এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মন্ত্রীর দফতর রদবদল করেছেন মমতা। নতুন মন্ত্রী তৃণমূলের অরূপ বিশ্বাসকে মনোজবাবুর জায়গায় পরিষদীয় দফতরের এক জন প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। ওই দফতরের দ্বিতীয় প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে কংগ্রেসের আবু নাসের খান চৌধুরীকে। যিনি ইতিমধ্যেই তৃণমূলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ওই দফতরের পূর্ণমন্ত্রী তৃণমূলের পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
অর্থাৎ, পরিষদীয় দফতরে পার্থবাবুর অধীনে একমাত্র প্রতিমন্ত্রী মনোজবাবুর জায়গায় আনা হয়েছে দুই প্রতিমন্ত্রী অরূপ-নাসেরকে। যা মনোজবাবুর ব্যাখ্যায় তাঁর ‘ডানা ছাঁটা’। মনোজবাবুকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।
তাঁকে ‘না-জানিয়ে’ মুখ্যমন্ত্রী ওই রদবদল করায় মুর্শিদাবাদের বিধায়ক মনোজবাবু সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করে ‘অসৌজন্যে’র অভিযোগ করেন। জবাবে মনোজবাবুকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি যা করেছেন, তা রাজ্য মন্ত্রিসভায় কংগ্রেসের অন্যতম ‘সিনিয়র’ মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াকে জানিয়েই করেছেন। মনোজবাবু কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অধীর চৌধুরীর ‘অনুগামী’ পরিচয়েই প্রতিষ্ঠিত। যিনি বলেছেন, “মুর্শিদাবাদের মানুষের সঙ্গে তঞ্চকতা করা হল!” আর শাসক-শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, ওই সিদ্ধান্তের মারফত মমতা আসলে অধীরকেই ‘বার্তা’ দিয়েছেন। এর কী এবং কতটা ‘প্রভাব’ জোট সরকারে পড়ে, তার দিকে কৌতূহলি নজর রাখছে শাসক ও বিরোধী শিবির।
কংগ্রেসের আরও বক্তব্য, মনোজবাবুর সঙ্গেই ‘ডানা ছাঁটা’ হয়েছে কংগ্রেসের অন্য মন্ত্রী আবু হেনারও। তাঁর হাতে মৎস্য দফতরটি রেখে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে নেওয়া হয়েছে। নেওয়া হতে পারে উদ্যান দফতরও। তবে আবু হেনা ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বরং বলেছেন, “আমার কোনও মন্তব্য করার নেই। কারণ, সরকারি ভাবে আমায় কিছু জানানো হয়নি। যদি দফতর বদল হয়েও থাকে, তা হলেও বলব, এটা মুখ্যমন্ত্রীর এক্তিয়ার-ভুক্ত। আমি ব্যাকরণ মেনে চলি। মুখ্যমন্ত্রী যা ভাল বুঝেছেন, তা-ই করেছেন।”
পরিষদীয় প্রতিমন্ত্রী সংক্রান্ত খবর চাউর হওয়ার পর এ দিন সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ মনোজবাবু সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর ইন্টারকমে ফোন করেন (তার আগে তিনি উত্তেজিত হয়ে পার্থবাবুর ঘরে গিয়ে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন)। এবং জানান, যে ভাবে তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই তাঁর দফতর বদল করা হয়েছে, তাতে তিনি ‘বিড়ম্বিত’। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী শান্ত গলাতেই তাঁকে বলেন, মনোজবাবুর নিজেকে ‘বিড়ম্বিত’ মনে হলে তিনি তাঁর দলের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করুন। তত ক্ষণ পর্যন্ত যে দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে, তা ‘পালন’ করাই তাঁর পক্ষে উচিত হবে।
তখনই মনোজবাবু সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘অসৌজন্যে’র অভিযোগ আনেন। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তাতেও ‘সংযমী’ই ছিলেন। মন্ত্রিসভার সতীর্থকে তিনি মনে করিয়ে দেন, ওই ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা না-বললেই তিনি ভাল করবেন। মনোজবাবুর কোনও ‘আপত্তি’ বা ‘বক্তব্য’ থাকলে তিনি বিষয়টি নিয়ে তাঁর দলের সঙ্গে কথা বলুন। মনোজবাবু তখনও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে থাকলে মমতা তাঁকে জানান, মন্ত্রিসভায় দফতর রদবদলের সিদ্ধান্ত তিনি আগেই কংগ্রেসের মন্ত্রী মানসবাবুকে জানিয়েছিলেন। প্রয়োজনে মনোজবাবু মানসবাবুর সঙ্গে আলোচনা করুন। একটা সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মনোজবাবুকে এমনও বলেন যে, তিনি ‘সহ্যের সীমা’ অতিক্রম না-করলেই মুখ্যমন্ত্রী ‘খুশি’ হবেন।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এর পরেই মনোজবাবুর ফোন নামিয়ে রাখেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং দ্রুত ফোনে ধরেন মানসবাবুকে। তাঁকে মনোজবাবুর ‘বিস্ফোরণে’র কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, মনোজবাবুর ‘ব্যবহার’ ঠিক হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি মনোজবাবুর ওই প্রতিক্রিয়া ‘সমর্থন’ করতে পারছেন না। মানসবাবুকে মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, বিষয়টি তিনি আগেই মানসবাবুকে জানিয়ে রেখেছিলেন। উপরন্তু, দফতরটি তো তৃণমূলের অরূপের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে কংগ্রেসেরই আবু নাসেরকে দেওয়া হয়েছে। তা হলে এই ‘অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া’ কেন? মানসবাবু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় চান। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে রাত ৮টায় আসতে বলেন। সেই মতো মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে এসে মানসবাবু বিষয়টি নিয়ে একপ্রস্ত আলোচনাও করেন। তবে তার বিষয়বস্তু তিনি প্রকাশ করতে চাননি। মুখ্যমন্ত্রীও তার পরেই মহাকরণ ছেড়ে বেরিয়ে যান।
মানসবাবুর সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার আগে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলার চেষ্টা করেন কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই মুহূর্তে ফোনে না-পাওয়ায় প্রণববাবুর সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের কাছে মমতা তাঁর ‘উষ্মা’ জানিয়েছেন বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর।
ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে যাচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যে তথা জোট সরকারে কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্কে এর ‘প্রভাব’ পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তৃণমূলের শীর্ষ সূত্রের খবর, হাইকম্যান্ডের কাছে মুখ্যমন্ত্রী মনোজবাবুর ‘ব্যবহার’ নিয়ে ‘প্রবল উষ্মা’ প্রকাশ করেছেন। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “কিছু দিন আগে মনোজবাবু যখন মহাকরণে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন, হাইকম্যান্ড বললে ছেঁড়া চপ্পলের মতো মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন, তখনই মুখ্যমন্ত্রীর তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল! কিন্তু সৌজন্যের খাতিরে তিনি তা করেননি। এমনকী, কংগ্রেস হাইকম্যান্ডকেও জানাননি। এখন মনোজবাবু মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি ফোন করে অসৌজন্যের অভিযোগ তুলছেন! উনি ওঁর দলের সঙ্গে কথা বলুন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত চাইছেন কেন?”
এ দিনের রদবদলে যে দুই মন্ত্রীর ‘ডানা ছাঁটা’ হল বলে কংগ্রেস শিবিরের একাংশের অভিযোগ, ঘটনাচক্রে, তাঁরা দু’জনেই মুর্শিদাবাদ থেকে নির্বাচিত। এবং ঘটনাচক্রেই, গত ২৯ ডিসেম্বর বহরমপুরের এক সভায় অধীরের উপস্থিতিতে সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। প্রত্যাশিত ভাবেই অধীর এ দিন বলেছেন, “প্রতিহিংসার রাজনীতি হচ্ছে! মহাকরণে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের মন্ত্রীরা কংগ্রেস সম্পর্কে কুৎসা করছেন। অথচ, আমাদের দলের মন্ত্রীরা গঠনমূলক সমালোচনা করলে তাঁদের ডানা ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে! এটা গরিষ্ঠতার স্পর্ধা। এ জন্যই আমাদের দলীয় নেতৃত্বকে আগেভাগেই বলেছিলাম, আমাদের এই মন্ত্রিসভায় যোগ না-দিয়ে বাইরে থেকে সমর্থন করা উচিত!”
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের অবশ্য খবর, মনোজবাবুর এ দিনের ‘ভূমিকা’র পর কংগ্রেস পুরোপুরি সরকার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও মুখ্যমন্ত্রী কিছু ‘মনে করবেন না’। কারণ, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ তাঁর অনুকূলে। কেন্দ্রে সরকার চালাতে, বাজেট-সহ বিভিন্ন বিষয় লোকসভায় পাশ করাতে এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও মমতার সাহায্য কেন্দ্রের তথা কংগ্রেসের দরকার (যে কারণে রাজ্য কংগ্রেসের সরকারি-বিরোধী আন্দোলনের রাশ বারবার টেনে ধরছে হাইকম্যান্ড)। কিন্তু রাজ্যে মমতা এতটা সংখ্যাগরিষ্ঠ যে, তাঁর কংগ্রেসকে না-হলেও চলে। বস্তুত, তৃণমূলের একাংশ চায়, কংগ্রেস নিজে থেকেই মন্ত্রিসভা ছেড়ে চলে যাক! তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “তা হলে তো আমরা আরও সাত জন মন্ত্রী পাব!” ওই নেতার আরও ব্যাখ্যা, “কেন্দ্রে তৃণমূলের যে ছ’জন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন, তাঁদের কোনও কাজই দেওয়া হয় না! রাজ্যে তো তবু কংগ্রেসের মন্ত্রিদের দফতর বণ্টন করে কাজ দেওয়া হয়েছে। মানসবাবুর হাতে সেচ, ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প ও বস্ত্র দফতর রয়েছে। আমরা তো এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ঝগড়া করতে যাইনি!” বিশেষত, মনোজবাবু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এক নেতার বক্তব্য, “উনি তো নিজেই একবার বলেছিলেন, পরিষদীয় দফতরের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে কোনও কাজই করতে দেওয়া হয় না। সে জন্য উনি ওই দফতর ছেড়েও দিতে চেয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী তো তাঁর সেই কথা মনে রেখেই তাঁর দফতর বদলেছেন।”
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে তাঁর বাদানুবাদের কথা মনোজবাবু প্রকাশ্যে বলেননি। মুখ খোলেননি মুখ্যমন্ত্রী নিজেও। তবে পরে মনোজবাবু বলেন, “আমি ব্যাপারটা দেখব, ভাবব, বুঝব। তার পর দলের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।” কংগ্রেস সূত্রের খবর, এ দিন রাতেই অধীরের সঙ্গে কথা বলেছেন মনোজবাবু। তিনি কথা বলবেন প্রণববাবুর সঙ্গেও। মনোজবাবুর বক্তব্য, “কবরে গেলেও আমি প্রতিবাদ করব। যা করণীয়, ওঁদের দু’জনের (প্রণব-অধীর) সঙ্গে কথা বলেই করব।” এত দিন বিভিন্ন বিষয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল তথা মমতার ‘পরোক্ষ বাদানুবাদ’ হয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য কংগ্রেসের সরকার-বিরোধী আন্দোলনের ফলে তা আরও বেড়েছিল। কিন্তু রাজ্য মন্ত্রিসভার কোনও কংগ্রেসি মন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি বাদানুবাদ এই প্রথম! এখন দেখার, এই পরিস্থিতিতে কোন পক্ষে দাঁড়ায় কংগ্রেস হাইকম্যান্ড! |
|
|
|
|
|