ভার কমাতে প্রতিমন্ত্রী নিলেন স্বাস্থ্যে, দফতর পাল্টে ‘বার্তা’ কংগ্রেসকে
মমতার মন্ত্রিসভায় আরও দুই নয়া মুখ
প্রধান শাসক দল তৃণমূলের আরও দুই বিধায়ক স্থান পেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায়। সেই সঙ্গে মাঝারি মাপের রদবদলও হল মন্ত্রিসভায়। যার মাধ্যমে ‘বার্তা’ দেওয়া হল জোটশরিক কংগ্রেসের একাংশকে। সরকারে আসার আট মাসের মাথায় মন্ত্রিসভায় নতুন দুই মন্ত্রী নিলেন মমতা। যার ফলে তাঁর মন্ত্রিসভা আড়ে-বহরে গিয়ে দাঁড়াল ৪৪-এ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ২৯৪ জন সদস্যবিশিষ্ট বিধানসভায় সর্বোচ্চ ৪৪ জনই মন্ত্রী হতে পারেন। দুই নতুন মন্ত্রীকে ধরে মন্ত্রিসভায় ৩৭ জন তৃণমূলের, ৭ জন শরিক কংগ্রেসের। ফলে এর পর নতুন মন্ত্রী নিতে গেলে মমতাকে কাউকে না-কাউকে বাদ দিতেই হবে।
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নতুন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
নতুন মন্ত্রীদের শপথ এবং দফতর রদবদল নিয়ে এমনিতে বড় জলঘোলা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সোমবার সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল চূড়ান্ত ‘বিভ্রান্তি এবং নাটকীয়তা’র মধ্যে! তৃণমূল বিধায়ক শশী পাঁজাকে নিয়ে এক প্রস্ত ‘নাটকে’র পরে আপাতত তাঁর বদলে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হলেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। আরও এক নতুন মন্ত্রী হলেন মমতার ‘আস্থাভাজন’, দলে ‘দক্ষ সংগঠক’ হিসেবে পরিচিত, যুব নেতা অরূপ বিশ্বাস। আর কংগ্রেসের সঙ্গে ‘দ্বন্দ্ব’ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।
যাবতীয় ‘বিভ্রান্তি এবং নাটকে’র মধ্যেও জোট-শরিক কংগ্রেসকে ‘স্পষ্ট বার্তা’ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। মুর্শিদাবাদের দুই মন্ত্রী আবু হেনা ও মনোজ চক্রবর্তীর ‘ডানা ছেঁটে’ মালদহের আবু নাসের খান চৌধুরীর (লেবু) ‘গুরুত্ব’ বাড়ানো হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পাশাপাশিই পরিষদীয় দফতরের প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন লেবুবাবু। তৃণমূল শিবিরের ব্যাখ্যায়, এর মাধ্যমে মমতা কংগ্রেস তথা গনি পরিবারের ভিতরের দ্বন্দ্বকে আরও ‘উস্কে’ দিতে চেয়েছেন। অন্য দিকে, মুর্শিদাবাদের অধীর চৌধুরীর ‘ঘনিষ্ঠ’ নেতা মনোজবাবুকে পরিষদীয় ও ক্ষুদ্র শিল্প দফতর থেকে সরিয়ে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। পূর্ণমন্ত্রী হেনার কাছ থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ হয়ে সুব্রত বক্সীর ছেড়ে-যাওয়া দু’টি দফতরের শূন্যস্থান পূরণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিবহণ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন মদন মিত্র। ক্রীড়া দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর পাশাপাশি এই বাড়তি দায়িত্ব সামলাবেন মদনবাবু। পরিবেশের পাশাপাশি পূর্ত দফতরের পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার।
যে সমস্ত মন্ত্রীর কাজে মমতা ‘সন্তুষ্ট’ ছিলেন না, ‘বার্তা’ দেওয়া হয়েছে তাঁদেরও। নদিয়ার উজ্জ্বল বিশ্বাসের থেকে যুবকল্যাণ দফতরটি নিয়ে ওই দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে অরূপকে। হেনার হাত থেকে নেওয়া খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের ভার দেওয়া হয়েছে উজ্জ্বল বিশ্বাসকে। আবাসনমন্ত্রী শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়ের দফতরে নতুন প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে অরূপকে। সেই সঙ্গে তাঁকে দেওয়া হয়েছে পরিষদীয় দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও। অর্থাৎ এক দিকে যেমন অরূপবাবু তিনটি দফতরের প্রতিমন্ত্রী (যার মধ্যে যুবকল্যাণ দফতরটি স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত) হয়েছেন, তেমনই পরিষদীয় মন্ত্রী হিসেবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাজের চাপ কমানো হয়েছে। তাঁর অধীনে পরিষদীয় দফতরের এখন থেকে দু’জন প্রতিমন্ত্রী তৃণমূলের অরূপবাবু এবং কংগ্রেসের লেবুবাবু।
মদনবাবু মৎস্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সরকারের একটি সূত্রের খবর, তিনি দু’টি দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় মৎস্য প্রতিমন্ত্রীর ভার দেওয়া হয়েছে মুর্শিদাবাদ থেকে নির্বাচিত বিধায়ক সুব্রত সাহাকে। যিনি পূর্ত দফতরেরও প্রতিমন্ত্রী। তবে সুব্রতবাবু জানিয়েছেন, এ দিন রাত পর্যন্ত এই নিয়ে তাঁর কাছে কোনও খবর নেই। প্রাথমিক ভাবে মন্ত্রিসভার রদবদলের খবর জানিয়েছিলেন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ। তবে শেষ পর্যন্ত কোন দফতরে কে এলেন, তা নিয়ে রাত পর্যন্ত ‘বিভ্রান্তি’ রয়েছে।
রদবদল
পূর্ণমন্ত্রী
নাম ছিল দেওয়া হল/রইল
• আবু হেনা মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ, উদ্যান* মৎস্য, খাদ্য
• সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার পরিবেশ পরিবেশ ও পূর্ত
• উজ্জ্বল বিশ্বাস যুব কল্যাণ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, প্রতিমন্ত্রী
প্রতিমন্ত্রী
• মনোজ চক্রবর্তী পরিষদীয়, ক্ষুদ্র খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও কুটির শিল্প
• আবু নাসের খান চৌধুরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিষদীয়
• মদন মিত্র ক্রীড়া ক্রীড়া, পরিবহণ (স্বাধীন দায়িত্ব)
• সুব্রত সাহা পূর্ত* মৎস্য
নতুন মন্ত্রী দেওয়া হল
চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য স্বাস্থ্য (প্রতিমন্ত্রী)
অরূপ বিশ্বাস যুব কল্যাণ (স্বাধীন দায়িত্ব), আবাসন ও পরিষদীয়
* এই দফতর দু’টি নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে, রাজভবনের বিজ্ঞপ্তিতে যা কাটার সম্ভাবনা।
এ দিনের ‘নাটকে’র সূত্রপাত শশীদেবীকে নিয়ে। অরূপের সঙ্গে তাঁকেই মন্ত্রী করার কথা ভাবা হয়েছিল। প্রয়াত অজিত পাঁজার পুত্রবধূ, পেশায় চিকিৎসক শশীদেবীর কথা মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন তাঁর হাতে-থাকা স্বাস্থ্য দফতরের ভার ‘লাঘব’ করার জন্যই। শপথ গ্রহণের দিন প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছিল কাল, বুধবার, ১৮ জানুয়ারি। কিন্তু এ দিন সকালেই রাজভবন থেকে সরকারকে জানানো হয়, রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বুধবার কলকাতার বাইরে থাকবেন।
মুখ্যমন্ত্রী তখন ঠিক করেন, এ দিনই শপথ অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু বিধানসভার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির কাজে শ্যামপুকুরের বিধায়ক শশীদেবী আপাতত কোচবিহারে। কোনও ভাবেই তাঁর পক্ষে এ দিন বিকাল ৪টের মধ্যে কলকাতায় ফেরা সম্ভব ছিল না। তখন মন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হয় চন্দ্রিমাদেবীর নাম! এবং তাঁকেই স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। শশীদেবীর কথা তিনি ‘পরে ভাববেন’ বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
‘শেষ মুহূর্তে’ অনুষ্ঠান নিয়ে ‘বিভ্রান্তির’ জেরে শেষ পর্যন্ত শপথ অনুষ্ঠানে যাননি বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা-সহ পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভার শপথ এবং পরে কংগ্রেসের মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠানে প্রথা মেনেই তিনি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এ দিন তৃণমূলের দুই বিধায়কের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দিনে বিরোধী দলনেতার কাছে আমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছয় শেষ মুহূর্তে। সূর্যবাবু ঠিক করেন, তখন আর না-যাওয়াই শ্রেয়। তবে বিরোধী দলনেতার দাবি, তিনি শপথ অনুষ্ঠান ‘বয়কট’ করেননি। অনুষ্ঠান ছিল বিকাল ৪টেয়। রাজ্য সরকারের তরফে বিধানসভায় তাঁর কাছে আমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছয় ৩টে ২৫ মিনিটে! সূর্যবাবুর বক্তব্য, “বয়কট করিনি। কিন্তু সব কিছুর একটা পদ্ধতি থাকা উচিত। গ্রামের দিকে একটা চালু কথা আছে, নিমন্ত্রণ দু’রকমের হয়। একটা এমন ডাক, যা শুনে কেউ না-এসে থাকতে পারবে না। আর একটা এমন ডাক, যা শুনলে কেউ আসবে না!”
রাজভবনে বিকাল সওয়া ৪টে নাগাদ রাজ্যপাল আনুষ্ঠানিক ভাবে দুই মন্ত্রীকে শপথবাক্য পাঠ করান। মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। শপথ নেওয়ার পরে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান দুই নতুন মন্ত্রী।
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নতুন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
পরে চন্দ্রিমাদেবী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি অধীনে (মমতাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী) কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। ওঁর প্রত্যাশা, রাজ্য জুড়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা যাতে আরও উন্নত করা যায়। এ নিয়ে ওঁর অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। সে সব বাস্তবায়িত করাই আমার লক্ষ্য।”
তাঁর আরও বক্তব্য, “গত ৩৪ বছরের বাম আমলে এ রাজ্যের মানুষ স্বাস্থ্যের অধিকার হারিয়েছেন। সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করতে চাই।” আর অরূপ জানান, আজ, মঙ্গলবার থেকেই তিনি দফতরের কাজ শুরু করে দেবেন। তাঁর কথায়, “সরকারের নতুন মন্ত্রী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াসকে সার্থক করাই হবে আমার লক্ষ্য।”
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে দাবি করে আসছিলেন বিরোধী দলনেতা। চন্দ্রিমাদেবীকে স্বাস্থ্যের প্রতিমন্ত্রী করার প্রেক্ষিতে সূর্যবাবুর মন্তব্য, “স্বাস্থ্য দফতরে পূর্ণমন্ত্রী দরকার ছিল। তবে এই মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রীরাও কাজ করতে পারেন না! তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন!”
রদবদলের জেরে সব চেয়ে বেশি হইচই হচ্ছে মনোজবাবুকে নিয়েই। মহাকরণের তিন তলায় এ দিন পর্যন্ত ছিল তাঁর বসার ঘর। রদবদলের খবর পেয়ে দোতলায় নেমে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের দিকে দ্রুত ও উত্তেজিত পায়ে হাঁটতে দেখা যায় তাঁকে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কিছু বলবেন? হাঁটতে হাঁটতেই মনোজবাবু উত্তর দেন, “আই ডোন্ট নো হোয়াট ইজ রিয়েলিটি! লেট মি নো!”
এর পরে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ঘর পেরিয়ে শিল্প-বাণিজ্য এবং পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবুর ঘরে ঢুকে সরাসরিই জিজ্ঞাসা করেন, তাঁকে কি বাদ দেওয়া হল?
পার্থবাবু জানান, তিনি বাদ দেওয়ার কেউ নন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন মুখ্যমন্ত্রীই। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পার্থবাবু বলেন, “মন্ত্রিসভায় কী রদবদল হয়েছে, তা মুখ্যমন্ত্রীই বলতে পারবেন। তবে পরিষদীয় কাজে সাহায্যের জন্য আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অতিরিক্ত এক জনকে চেয়েছিলাম। মনোজবাবুকে আমি বলেছি, সরকারি বিজ্ঞপ্তির জন্য অপেক্ষা করতে।” মহাকরণ ছেড়ে বেরোনোর সময় মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষমান সংবাদমাধ্যমকে বলে যান, “যা বলার, রাজভবন থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হবে।”

ছবি: রাজীব বসু।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.