|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
আগে এক বছর ছাত্র নির্বাচন বন্ধ থাকুক |
সেই অবসরে আমরা ভেবে দেখি, ছাত্র ইউনিয়ন এবং তার নির্বাচনের পুরো ব্যবস্থাটাই
কী ভাবে আমূল বদলানো যায়। তা না হলে, কলেজে কলেজে যা চলছে, তার স্থায়ী
অবসান হবে না, হওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা প্রাঙ্গণে হিংসার প্রেক্ষিতে লিখছেন সুকান্ত চৌধুরী |
শিক্ষা প্রাঙ্গণে হিংসা নিয়ে সম্প্রতি আলোড়ন হচ্ছে। এমন ঘটনা নতুন নয়। পর্দায় রায়গঞ্জের অধ্যক্ষ নিগ্রহ দেখে কয়েক বছর আগে স্বচক্ষে দেখা একটি দৃশ্য মনে এল। বারংবার ফেল হওয়া কিছু পরীক্ষার্থীকে পাশ করানোর দাবিতে এক দল ছাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পরীক্ষা-নিয়ামকের উপর নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছিল নিছক শারীরিক প্রাবল্যে রায়গঞ্জের চেয়ে অনেক তীব্র। একই ঘটনাপ্রবাহের অঙ্গ হিসাবে ছাত্রদের সপ্তাহব্যাপী অবস্থান (প্রাঙ্গণে নয়, রাস্তায়) পুলিশ দিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনার প্রতিবাদে ফের এক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মাইক বাজিয়ে বহু গণ্যমান্য লোকে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন, ক্লাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ল, গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ মাথায় উঠল। ঘুণাক্ষরেও কেউ আধিকারিকের উপর আক্রমণের উল্লেখ করলেন না।
এ বার দেখে আশ্বস্ত হলাম, সেই গুণী ও শ্রদ্ধেয় বক্তাদের অন্তত দু’জন টিভির পর্দায় রায়গঞ্জ কাণ্ডের নিন্দা করলেন। এই ক’বছরে দেখা যাচ্ছে, সমাজে দুটি পরিবর্তন ঘটেছে। এক, শিক্ষাক্ষেত্রে হিংসা, নৈরাজ্যের নিন্দা করা যাচ্ছে। আমাদের চিরাচরিত সংস্কার এই যে, উপাচার্য, অধ্যক্ষ, এমনকী সাধারণ শিক্ষক-অধ্যাপকরাও প্রকৃত নিয়মে ঘেরাও-অপমান-লাঞ্ছনার জন্য চিহ্নিত জীব ওটা হজম করা তাঁদের পেশাগত কর্তব্য। অন্য যে কোনও স্থানে যে কীর্তির জন্য জেলে যাওয়ার কথা, শিক্ষাপ্রাঙ্গণের পবিত্র ভূমিতে তা বুক ফুলিয়ে হাসিল করা যেত। আইনের শরণ নিলে শিক্ষকেরাই ধিক্কৃত হতেন। আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ ডাকা চলে, যদিও ডাকার পর তাদের ভূমিকা ধোঁয়াটে থেকে যাচ্ছে। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী সে দিন ক’টা মন্তব্য করলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতরটাই আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, সাম্প্রতিক হিংসা-নৈরাজ্যের মোকাবিলার দায়িত্ব শিক্ষা নয়, স্বরাষ্ট্র দফতরের। এই মন্তব্যের যদি কোনও মানে থাকে, তা নিশ্চয়ই এই যে, শিক্ষা প্রাঙ্গণে হিংসা দমনে পুলিশ আসবে অন্য পাঁচটা জায়গায় যেমন আসবে বলে আমরা ধরে নিই, প্রত্যাশা পূরণ হোক আর না হোক।
দুঃখের বিষয়, এতেও কাজের কাজ হচ্ছে না। এত দিন তবু দেখা যেত, তেমন চোখে-ঠেকা নৈরাজ্য ঘটলে কিছু দিন দুর্বৃত্তেরা একটু সমঝে চলছে। এ বার এক সপ্তাহের মধ্যে অন্তত তিনটি বড় ও বেশ ক’টি অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের অশান্তি ঘটল, প্রায় ‘কপিক্যাট’ অপরাধের ছাঁদে। প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের হাত পুড়ল, প্রত্যেকেই দোষারোপ করল অন্যদের। চাক্ষুষ প্রমাণ তুলে ধরলেও নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করল। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটা, দেশের আর সব অনাচারের মতো, তাদের চোখে হয়ে দাঁড়াল কেবল রাজনৈতিক ঘুঁটির ছক। যে দেশে সাধারণ নাগরিকের চেয়ে শাসকশ্রেণির শুভবুদ্ধি কম, সে দেশের বড় দুর্দিন। |
|
সরকার অবশ্য বসে নেই। তারা মূলে গিয়ে সমাধানের কথা ভাবছে। অতএব শরণ নিল খোদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। কমিশনের চার দফা পরামর্শের তিন দফাই দেখা গেল শিক্ষা দফতরের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এতে শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত কোনও মানুষই আশ্চর্য হবেন না। আশ্চর্যের অবকাশ এই ভেবে, ছাত্র রাজনীতিকে আমরা আর কত মাথায় তুলব? গুরুত্বের কোন তুঙ্গে নিয়ে যাব? আর যদি বা যাই-ই, বাজির অঙ্ক বাড়ালে তাতে হিংসা-অনাচারও কেবল বাড়বেই না কি?
শহরতলির এক কলেজ নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টে মামলা রুজু হয়েছিল। মহামান্য আদালত মামলা খারিজ করে দিয়েছে এই যুক্তিতে যে, কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচন প্রণালী একান্ত সেই কলেজের অভ্যন্তরীণ পরিচালনার বিষয়। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসা, তছরুপ বা অন্য আইনগ্রাহ্য অপরাধ ঘটলে তার শাস্তি হবে না। কিন্তু নিছক নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা বৃহত্তর শাসনব্যবস্থার অঙ্গ নয়। এত আইন ঘাঁটারও দরকার নেই। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান কী বলে? ছাত্র নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে নির্বাচন কমিশনের মতো উচ্চ সাংবিধানিক সংস্থাকে? মনোনয়নপত্র জমা পড়বে জেলাশাসকের দফতরে? (এমন প্রস্তাবও শোনা যাচ্ছে) নির্বাচিত ছাত্ররা কি তবে শপথ নেবে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির সামনে?
কেন্দ্রের হোক বা রাজ্যের, নির্বাচন কমিশন কোন নির্বাচন পরিচালনা করে অভ্যস্ত? যেগুলির ফলে দেশের আইনসভা তথা সরকার, নিদেনপক্ষে পুরসভা বা পঞ্চায়েত গঠিত হয়। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনও-না-কোনও স্তরে প্রশাসন চালাবার, সমাজ নিয়ন্ত্রণ করার, উন্নয়ন সংগঠিত করার দায়িত্ব এই সংস্থাগুলোতে ন্যস্ত। এই মৌলিক ও চূড়ান্ত গুরুত্ব আছে বলেই শত অনাচার সত্ত্বেও এগুলি না-হলে আমাদের নয়। সেগুলির নির্বাচন যথাসম্ভব সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্ত করার জন্য তাই কমিশনের একান্ত প্রয়োজন।
এ বার প্রশ্ন, কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের অনুরূপ কোনও ভূমিকা আছে কি? ছাত্র ইউনিয়ন তো কলেজ চালায় না, অন্তত চালালে সেটা অলিখিত ও অবাঞ্ছিত। তা তবে ছাত্রদের কী উপকারে লাগে? প্রশ্নটা আলঙ্কারিক নয়, নিতান্ত বাস্তব। বাস্তব স্তরেই তার উত্তর পাওয়া দরকার। তাত্ত্বিক উত্তরটা আমরা জানি। এতে ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা হয়, দাবি ও অভিযোগ কর্তৃপক্ষের সামনে পেশ করা যায়, ইত্যাদি। কার্যত এই উপকারগুলি কতটা লব্ধ হচ্ছে?
এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ও সম্পূর্ণ তথ্য নেই, যে যা চায় ভাবতে পারে। আমার ধারণাও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। প্রায় চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা কিন্তু বলে, ছাত্রেরা তাদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে আসে ইউনিয়ন নেতা নয়, কর্তৃপক্ষের কাছে। সেখানে ফল না-পেলে সাধারণ শিক্ষকদের কাছে। তাদের অনেক জিজ্ঞাসা করেছি, তোমাদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে যাও না কেন? স্পষ্ট বা পরোক্ষ উত্তর, তাতে সুরাহার আশা কম। ছাত্র আন্দোলনের ধারার সঙ্গে ছাত্রদের বাস্তব প্রয়োজনের যোগ নেই। ইউনিয়ন সদস্যেরা বেশি জঙ্গি হয়ে উঠলে সাধারণ ছাত্ররা বিশেষ করেই তাদের এড়িয়ে যায়।
দেশের তথা রাজ্যের তাবৎ কলেজে ইউনিয়নের নেতৃত্বে কতটুকু উন্নয়নমূলক বা গঠনমূলক কাজ হয়? হয় কোথাও কোথাও, কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে না। আরও মনে রাখবেন, ইউনিয়নের কার্যকর মেয়াদ কিন্তু দু-তিন মাসের বেশি নয়। নির্বাচন ঘিরে কলেজে কলেজে আজ জানুয়ারিতে এত অশান্তি, তার নির্বাচকমণ্ডলী অর্থাৎ ছাত্ররা বর্তমান বর্ষের ক্লাস করবে বড়জোর এপ্রিল মাস অবধি। তিন ভাগের এক ভাগ। তার পর ছাত্রই থাকবে না।
নির্বাচনের গুরুত্ব অন্যত্র, সে জন্যই কোনও দল তার দখল ছাড়তে অপারগ। এক, ছাত্র-রাজনীতির মধ্য দিয়েই উঠে আসে ভবিষ্যতের বৃহত্তর রাজনীতির নেতা ও কর্মিবর্গ। তালিম নেয় তার হালচাল কর্মপদ্ধতিতে, কায়েম করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার অধিকার। এই অর্থেও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক-একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এমন অবস্থায় পুলিশ বা প্রশাসন সক্রিয় ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে এমন ভাবা অবাস্তব। আরও নিকট ও প্রকট উপকার, ইউনিয়নের মাধ্যমে নানা মধুভাণ্ডের দখল হাতে আসে। সর্বোপরি ছাত্র ভর্তির সময়ে ক্ষমতা ও অর্থলাভের প্রভূত সুযোগ। এমন আকর্ষণের লোভে বেপরোয়া লড়াই চলবে, আশ্চর্য কী!
আকষর্ণটা এতই প্রবল যে টোটকায় অসুখ সারবে না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রস্তাব করেছিলেন, সব কলেজের নির্বাচন একই দিনে হোক। এতে এই দিনটিতে কোনও বিশেষ কেন্দ্রে দুর্বৃত্তদের সমাগম কমবে ঠিকই, কিন্তু আগে-পরে বিপদ থেকেই যাবে। গত ক’দিন ধরে সেটাই আমরা দেখছি। আর ৭৫ শতাংশ হাজিরা মিলিয়ে ভোট দিতে দেওয়া? রাজ্য তথা দেশের ক’টা কলেজে ঠিকঠাক বা আদৌ হাজিরা রাখা হয়? পরীক্ষায় বসতেই তাতে বাধা হয় না, ভোটদানে হবে? বরং এর ফলে মিথ্যা হাজিরা প্রত্যয়িত করার জন্য শিক্ষকদের উপর চাপ বাড়বে।
শিক্ষা প্রাঙ্গণের অনাচারে যদি সত্যিই আমরা রাশ টানতে চাই, তার একমাত্র পথ অন্তত এক বছরের জন্য ছাত্র নির্বাচন একেবারে বন্ধ রাখা। রাজনৈতিক শিবির ছাড়া অন্য কোনও তরফে এর প্রতিবাদ হবে কি? হবে কি সাধারণ ছাত্রসমাজের বলার মতো ক্ষতি? মনে রাখতে হবে, নতুন শিক্ষক নিয়োগ-সহ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বেশির ভাগ আবশ্যিক কাজ সারা পশ্চিমবঙ্গে বলতে গেলে গোটা ২০১১ সাল বিভিন্ন আইন ও নির্দেশবলে বন্ধ ছিল। সেটা আমরা মেনে নিয়েছি। ছাত্র নির্বাচন কি তার চেয়েও গুরুতর?
এক বছর অব্যাহতির পর, রাজনৈতিক দলগুলি যা-ই ভাবুক না কেন, সাধারণ মানুষ হিসাব করার সুযোগ পাবে, দীর্ঘ প্রেক্ষিতে বর্তমান ইউনিয়ন ব্যবস্থা কতটা জরুরি? ছাত্রদের নিশ্চয়ই একটা মঞ্চ থাকা দরকার। যেখান থেকে তারা তাদের মত ব্যক্ত করতে পারবে। প্রয়োজনের কথা জানাতে পারবে। অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। সেটা নতুন কোনও পদ্ধতিতে হতে পারে কি না, চিন্তা করার একটা অবকাশ পাওয়া যাবে।
ভুললে চলবে না, শুধু রামকৃষ্ণ মিশন বা সেন্ট জেভিয়ার্স নয়, এই রাজ্যেই সরকার পরিচালিত অন্তত একটি সফল বর্ধিষ্ণু প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচিত কোনও ছাত্র ইউনিয়ন নেই। তা হল শিবপুরের বেসু (বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি)। ছাত্রদের মত-দাবি-অভিযোগ জানাবার জন্য সেখানে অন্য মঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে। যত দিন নির্বাচিত ইউনিয়ন ছিল, বেসু-র প্রাঙ্গণ ছিল হিংসা-বিশৃঙ্খলার পীঠস্থান। আজ রাজ্যের সব উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে বেসু-র গতি সবচেয়ে ঊর্ধ্বগামী। ইউনিয়ন দূরীকরণ অবশ্যই তার একমাত্র, এমনকী প্রধান কারণ নয়। কিন্তু একটা কারণ কি না, তা ভাবতেই হবে।
এ সব কথা বলতেও ভয় হয়, পাছে ওই প্রতিষ্ঠানটির উপর আন্দোলনকারীদের দৃষ্টি পড়ে। বেসু কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রমণ্ডলী আমায় ক্ষমা করবেন, কিন্তু তাঁদের এই সাফল্যের কথা আমাদের জানা দরকার। ভাবা দরকার, এই দৃষ্টান্ত আরও ব্যাপক ভাবে অনুসরণ করা যায় কি না। তা না হলে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে অনাচার বাড়তেই থাকবে। দু’দিন নিষ্ফল নিন্দা-ধিক্কার করেই আমাদের ক্ষান্ত হতে হবে। আর তাবৎ রাজনৈতিক দল তাদের অতি প্রিয় চাপান-উতোর খেলার অফুরন্ত সুযোগ পেয়ে বর্তে যাবে। |
|
|
|
|
|