|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
নায়ক চরিত্র বর্জিত আন্দোলনের নতুন ধারা |
যার নাম ‘আনুভূমিক আন্দোলন’। ওয়াল স্ট্রিট ‘দখল’ অভিযান যার নজির।
নেতার তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলা এই জন-জাগরণের সম্ভাবনা বিচার করেছেন রংগন চক্রবর্তী |
নানান দেশ বা সমাজ যে ভাবে চলছে, চালানো হচ্ছে, যে নেতারা চালাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে সব সমাজেই অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে। আমাদের নেতাভিত্তিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা যেন বলে, ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’। নেতা যিনিই হোন না কেন, গদিতে বসলে কী রকম যেন রাজাই হয়ে ওঠেন, প্রজার কথা আর মাথায় থাকে না। ক্রমশ একটা প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠছে যে, তা হলে কি কেবল আলাদা আদর্শ থাকলেই হবে না? যে কোনও আদর্শভিত্তিক সংগঠন যদি নেতাভিত্তিক দলতন্ত্রের ওপর গড়ে ওঠে, তবে সেই নেতৃত্বের সর্ষের মধ্যেই কি রাজার ভূত ঢুকে পড়ে? নেতারাও রাজা হয়ে ওঠেন? স্তালিন বা মাও জে দঙের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার মধ্যে, এমনকী আমাদের এই বাংলার নানান ছোট বদলের ইতিহাসেও কি সেই এক গল্পই বার বার খুঁজে পাওয়া যায়?
এই অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। যেটা নতুন সেটা হল, আবার অনেক দিন পরে আন্দোলনের ধরন নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়েছে, মানুষ অনেক গোড়ার ভাবনা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা আর ধরন হল নেতাহীন আন্দোলন। এই ধরনের আন্দোলনের ধাঁচকে অনেকে ‘হরাইজন্টাল মুভমেন্ট’ বা আনুভূমিক আন্দোলন বলে বর্ণনা করছেন। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ নিয়ে অনেক আলোচনায়ও এই বিষয়টি উঠে আসছে।
২০০১ সালের ১৯ ও ২০ ডিসেম্বর আর্জেন্তিনা এক নতুন গণ-আন্দোলনের সূচনা দেখেছিল। সেই সময় আই এম এফ নীতি অনুসরণের ফলে দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। বিনিয়োগ চলে যায়। সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। মুদ্রার দাম ভীষণ ভাবে কমে যায়, রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ পথে নামেন। এই আন্দোলনে শামিল হন মধ্যবিত্ত, বেকার, শ্রমিক সমাজের সব ধরনের মানুষ। এই আন্দোলনের কোনও নেতা ছিল না। দু’মাসের মধ্যে পাঁচটি সরকারের পতন ঘটে।
সাধারণ মানুষ পাড়ায় পাড়ায় আঞ্চলিক বিধানসভা জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলেন। শত শত কারখানা শ্রমিকরা দখল করে চালাতে শুরু করেন। |
|
২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের জুকোটি পার্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন শুরু হয়। দেখতে দেখতে এই আন্দোলন দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে মাস মিডিয়া এই আন্দোলনের খবর প্রচার করলেও পরে সেই প্রচার কমে আসে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পুলিশ ওই পার্ক থেকে আন্দোলনকারীদের উচ্ছেদ করলেও, নানান ধরনে নানান ভাবে এই আন্দোলন চলছে।
দু’টি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যই হল যে, এই আন্দোলন দু’টিকেই ‘নেতাহীন আন্দোলন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই আন্দোলনে, বিশেষ করে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটে’ শামিল মানুষেরা বার বার চেষ্টা করছেন, যাতে এই আন্দোলনে কোনও বড় মাতব্বর তৈরি না হয়ে, সবার মতামতের ভিত্তিতে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়। ‘ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন’-এর প্রতিদিনই সাধারণ সভা ডেকে মতামত নেওয়া হচ্ছিল। গত কয়েক বছরে আমাদের এই বাংলাতেও কিন্তু আমরা নেতাহীন আন্দোলনের কিছু অভিজ্ঞতা দেখেছি। রিজওয়ানুর-প্রিয়ঙ্কার ঘটনা, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটনা ঘিরে আন্দোলন ঠিক কোনও সংগঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বে শুরু হয়নি বা পরিচালিত হয়নি। তার মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। কিন্তু পরবর্তী দিনে সেই আন্দোলন আবার দলতান্ত্রিক ক্ষমতা বদলের রাজনীতিতেই ঢুকে গিয়েছে।
|
দোলাও আমার হৃদয় |
আনুভূমিক আন্দোলনকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে অনেকেই বলছেন, এর পেছনে থাকে একটা আবেগের ঐক্য। সেই আবেগটা যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন আন্দোলনটাও ছড়িয়ে পড়ে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, কী ভাবে মানুষ বহু বছরের ভয় বা ইনার্শিয়া অর্থাৎ মানসিক জড়তা কাটিয়ে মফস্সল শহরের তুলনামূলক অ-সুরক্ষিত অবস্থান থেকেও দলীয় ও পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন, নিজের বাড়ির দরজায় পোস্টার টাঙিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যাটা হল, আবেগ তো ক্ষণস্থায়ী, আবেগ ফুরিয়ে গেলে তো আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে যাবে। সাধারণত তাই যায়। কট্টর সংগঠনপন্থীরা তাই নিশ্চিন্তে থাকেন, কারণ তাঁরা জানেন, দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন করতে হলে পুরো সময়ের রাজনীতিক ছাড়া হবে না। সাধারণ মানুষ আন্দোলনে আসবে, তার পর পেটের টানে বা জীবনের চাপে স্কুলে, কলেজে, মাঠে কারখানায়, অফিসে, দোকানে, ব্যবসায়, ঘরের কাজে ফিরে যাবে। আন্দোলন আবার এসে উঠবে ফুল-টাইমারদের হাতে। আবেগভিত্তিক আন্দোলন কখনও দীর্ঘস্থায়ী আর সংগঠিত হতে পারে না।
|
তুমি আমাদের পিতা |
সব চেনা রাজনীতিতেই নেতাদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও অনেক তত্ত্বে লেখা থাকে, মানুষের কাছ থেকে শিখতে হবে। কিন্তু সে সব মন ভোলানো কথা। গাঁধীবাদী নেতাই হোন, বা কমিউনিস্ট হোলটাইমারই হোন, সবাই একটা উঁচু আদর্শ নিয়েই যেন সাধারণ মানুষের কাছে আসেন। দল তাঁদের বলে, সাধারণ মানুষকে আদর্শের উচ্চতায় তুলে আনা তাঁদের কাজ। আমরা সাধারণত এই নেতাদের দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠার সমস্যা নিয়ে কেবল কথা বলি। কিন্তু আর একটু গভীরে খতিয়ে দেখলে, এই যে এক জন মানুষ জীবনস্রোতের বাইরে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ আদর্শের জন্য লড়বেন, এই ধারণার গোড়াতেই কেমন গলদ আছে মনে হয়। এর মধ্যে দিয়ে একটা ‘আমরা আর ওঁরা’ বিভাজন তৈরি হয়। আমাদের ভাবা দরকার রাজনৈতিক সংগঠনকে কেন কেবল বার বার এই ভাবেই তৈরি হতে হবে? কেন চেতনার নেতৃত্ব গচ্ছিত থাকবে কিছু মানুষের ওপরে? কেন আমরা আশা করব, তাঁরাই আমাদের বোধের ভাণ্ডারী আর কাণ্ডারী হবেন? কেন আমরা কিছু অলস অনুগামী তৈরি হব? কেন সব ভাবনার দায়িত্ব ওঁদের ওপর ছেড়ে দিয়ে খুশি থাকব? কেন আবার কোনও নেতৃত্বের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে নির্বাচনী হাড়িকাঠে তাঁদের বলি দিয়ে নিজেদের পাপমুক্ত মনে করব? পশু বলির আলোচনায় নৃতত্ত্ববিদরা বলেছেন যে, বলির পশুটি আসলে সমাজের জমা হওয়া পাপের প্রতীক হিসেবে প্রাণ দিয়ে আমাদের ত্রাণ করে। নেতাদেরও যেন সেই দায়। এই ধারণা আর এই সংগঠন কি সত্যি বদল আনতে পারে? না কি, আমরা নিজেদের যে নেতাদের ভুল রাজনীতির শিকার মনে করি আসলে তাঁরা আমাদেরই শিকারমাত্র? সামাজিক বিকারগুলোকে তাঁদের শরীরে চিহ্নিত করে তাঁদের বধ করে আবার ফিরে যাই নতুন নেতার সন্ধানে। তাই কিছুই আসলে বদলায় না। কারণ, আমরা বদলাই না।
|
যে সব চাওয়া ভিতর হতে |
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যখন ভেঙে পড়ল, ওই সব দেশের মানুষের ছবি বেশি বেশি করে দেখলাম, তখন অবাক লাগল যে, এত দিনের নতুন সমাজে মানুষ একেবারেই বদলাল না? আজ যখন চিনের নানান খবর দেখি, ভিয়েতনাম আর আমেরিকার যৌথ মহড়ার কথা শুনি, বাজারের জন্য সবার হ্যাংলামি দেখে অবাক হই, তখন মনে হয় এর একটা কারণ কি এই যে, কোথাও আসলে নতুন আদর্শ, নতুন মানুষ তৈরি হয়নি? নতুন নতুন নেতারা রাজা রানি হয়েছেন, কিন্তু নতুন বোধ তৈরি হয়নি। এর দায় কি শুধু নেতাদের?
আমাদের চার পাশে কিন্তু কিছু অত্যন্ত সফল নেতাহীন আন্দোলন চলছে। আমরা এদের আন্দোলন বলে চিনতে পারি না। একটার কথা বলি। আমরা জানি, আইনের চোখে ধুলো দিয়ে, সমাজের কিছু অংশের বিরোধিতাকে পাত্তা না দিয়ে, হয়তো বহু মায়ের চোখের জলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়েই চলেছে। এটাকে চট করে কিছু লোভী ডাক্তার আর নার্সিংহোমের ব্যবসা বলে পাশ কাটিয়ে গেলে কিন্তু আমরা নেতাহীন আন্দোলনের তত্ত্বটাকে বোঝার একটা সুযোগ হারাব। ভেবে দেখলে, এটাও একটা আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলন। ভয়ঙ্কর, কিন্তু আন্দোলন তো অনেক সময়েই ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে। কী ঘটছে এই আন্দোলনে? সমাজে গেড়ে বসা একটা গভীর পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ পণ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি কিছু অর্থনৈতিক অজুহাত তৈরি করে রেখেছে, আর তার সুবাদে লক্ষ লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যা চলছে, চলবে। লক্ষ করে দেখুন, এই আন্দোলনকে চালানোর কিন্তু কোনও নেতা নেই। এক জন কেন, এক হাজার জনকে গ্রেফতার করলেও এই আন্দোলন থামবে না। এই আন্দোলনের পেছনে আমাদের চেনা ভাষার কোনও আবেগ নেই, বরং আছে আবেগবিরোধী নির্মম একটা সামাজিক বোধ আর তার অর্থনৈতিক খোঁড়া অজুহাত। মেয়েদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার অধিকার না দিয়ে, তাদের দায় বলে ভেবে তাদের খুন করার অধিকার। কিন্তু সেই বোধ কেবল পুরুষদের কাছে নয়, মেয়েদের কাছেও এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থনযোগ্য করে তোলে, এমনই এর মান্যতা।
প্রশ্ন হল, বস্তাপচা পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ যদি একটা নৃশংস নেতাহীন আন্দোলনকে যুগ যুগ ধরে লালন করতে পারে, তবে এত দিনের অসাম্যের ইতিহাসের বুকে দাঁড়িয়ে একটা জনগোষ্ঠী কেন গণতান্ত্রিক আবেগকে বোধে পরিণত করে লালন করতে পারবে না? কেন বার বার নেতাদের বলি দিয়ে আমরা পুজো থেকে নির্বাচন, ‘আসছে বছর আবার হবে’ জাতীয় উল্লাসে ডুবে কাটিয়ে দেব? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমাদের পরিবারগুলোকে, আমাদের ছোট ছোট বৃত্তগুলোকেই দিতে হবে। চোখের সামনে দেখেছি রিজওয়ানুর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যেতেই আবার কলেজের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বলছে, ‘পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে, কিন্তু আমার বাড়িতেও মুসলমান বিয়ে করাটা একেবারে ‘নো’ ‘নো’। মা আর বাপি বলে দিয়েছে, আর যা-ই করো, মুসলমান বাড়িতে ঢোকাবে না।’ এই বোধ যদি পরিবারের মধ্যে থেকে থাকে এবং না বদলায়, কোথাও একটা আমাদের ই এম আই আর ধানের দামের মধ্যে সঙ্গতির দায়িত্ব যদি আমরা না নিই, তবে তাপসী মালিক আর রিজওয়ানুরের জন্যে জ্বালানো মোমবাতিরা দু’দিনে তো নিভবেই। আর ফিরে আসবে, এসেছে সেই এক অন্ধকার। |
|
|
|
|
|