আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এ বারই শেষ পার্টি কংগ্রেস। সেখান থেকেই দলের রাজনৈতিক কৌশলগত ‘লাইন’ স্থির করতে হবে। তারই লক্ষ্যে পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে আজ, মঙ্গলবার থেকে কলকাতায় বসছে সিপিএমের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির ৪ দিনের বৈঠক। কংগ্রেসের আর্থিক নীতির বিরোধিতা করতে বিজেপি-র প্রতি ‘নরম’ হওয়ার ‘বার্তা’ যাতে না-যায়, প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করাই দলের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
২০০৮-এ কোয়ম্বত্তূর পার্টি কংগ্রেসে সিপিএমের রাজনৈতিক ‘লাইন’ ছিল বিজেপি-কে রুখতে প্রয়োজনে কংগ্রেসকে সমর্থন। কিন্তু পরমাণু-চুক্তি প্রশ্নে কেন্দ্র থেকে সমর্থন তোলার পরে ৪ বছরে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের ‘দূরত্ব’ বেড়েছে। টু-জি কাণ্ড থেকে কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারি, লোকপাল বিল সম্প্রতি কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপি-র সঙ্গে সিপিএমের ‘বোঝাপড়া’ চোখে পড়েছে জনমানসে!
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার ৮ মাসের মধ্যেই তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের বিবাদের ফলে সিপিএমের একাংশ ‘খুশি’। কংগ্রেস-তৃণমূল দূরত্ব বাড়লে সরাসরি রাজনৈতিক লাভ সিপিএমের। সে দিক থেকে কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে নতুন করে ‘সুসম্পর্ক’ গড়তে পারলে লাভ সিপিএমেরই। তাই আসন্ন কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক দলিল তৈরি করতে গিয়ে এই যাবতীয় সমীকরণ মাথায় রাখতে হচ্ছে সিপিএমকে। কংগ্রেস ও বিজেপি-র সঙ্গে ‘সমদূরত্ব’ই সিপিএমের এখন ঘোষিত অবস্থান। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আগামী লোকসভা ভোটের মাথায় রেখে মানানসই ‘লাইনে’র লক্ষ্যে দলিলের খসড়া চূড়ান্ত করাই কলকাতার বৈঠকের উদ্দেশ্য। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট সোমবার রাতেই কলকাতায় চলে এসেছেন।
অসুস্থতার কারণে কলকাতার বাইরে সাম্প্রতিক কালে কোনও পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে পারেননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ‘নীতিগত প্রশ্নে’ বিরোধিতা থাকলেও ব্যক্তিগত ভাবে বুদ্ধবাবু-সহ এ রাজ্যের সিপিএম নেতৃত্ব কংগ্রেসের সঙ্গে একটি স্তর পর্যন্ত ‘সুসম্পর্ক’ রেখে চলার পক্ষপাতী। একই মতের শরিক এ রাজ্য থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ তথা পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরিও। বুদ্ধবাবু, ইয়েচুরি বা নিরুপম সেন করেন, আগামী দিনেও তৃতীয় ফ্রন্টের তেমন সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপি-কে রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে ‘সদ্ভাব’ রাখা ভাল। পক্ষান্তরে, কারাটেরা কট্টর কংগ্রেস-বিরোধিতার পক্ষে। কেরলের কংগ্রেস সরকার দুর্নীতির অভিযোগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিরোধী দলনেতা অচ্যুতানন্দনের বিরুদ্ধে এফআইআর করায় বিরোধিতার মাত্রা বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের আর্থিক নীতি ও বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে খসড়া দলিল তৈরি হবে বলে সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত।
সামনেই ৫ রাজ্যের ভোট। কোনও রাজ্যেই সিপিএমের বিশেষ ভূমিকা নেই। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে একদা সিপিএম-মিত্র মুলায়ম কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায়। জ্যোতি বসু-সুরজিৎ জীবিত থাকা কালে, বিজেপি-কে রুখতে যেখানে বামেরা নেই, সেখানে কংগ্রেস-সহ অসাম্প্রদায়িক দলকে ভোট দেওয়ার নীতি নেয় সিপিএম। এ বারও নাম না-করে অসাম্প্রদায়িক দলকে ভোট দিতে আবেদন করতে পারে তারা। তা ছাড়া, পার্টি কংগ্রেসে যে মতাদর্শগত দলিল পেশ করা হবে, তা-ও চূড়ান্ত হবে কমিটিতে। গণভিত্তি প্রসারিত করতে দলকে কতটা ‘উন্মুক্ত’ করা হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায় দল। বুদ্ধবাবু, অন্ধ্রের রাজ্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরোর সদস্য বি ভি রাঘোবুলু প্রমুখ দলকে আরও ‘উন্মুক্ত’ করার পক্ষপাতী। কিন্তু তাতেও আপত্তি আছে বহু নেতার। এর আগে দু’বার বুদ্ধবাবু তাঁর মতামত লিখিত ভাবে পলিটব্যুরোয় জানান। এ বার তিনি বৈঠকে থাকছেন। ফলে, এই বৈঠক থেকে সিপিএমের ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারিত হওয়ার সম্ভাবনা। |