টাইটানিক দেখেও বুঝিনি
জাহাজডুবি কাকে বলে
চোখটা লেগে এসেছিল। হঠাৎ প্রচণ্ড আওয়াজ। কেবিনের টিভিটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। বুঝতে পারলাম জাহাজ এক দিকে হেলে গিয়েছে। এবং আমরা ক্রমশই ডুবে যাচ্ছি।
৭ জানুয়ারি ইতালির স্থানীয় সময় অনুযায়ী বিকেল ৫টা নাগাদ জেনিভার কাছে সাভোনা বন্দর থেকে ছেড়েছিল আমাদের জাহাজ কোস্টা কনকর্ডিয়া। আমি জাহাজের নাবিক। ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৩০০ টনের পেল্লায় জাহাজে প্রায় সাড়ে তেরোশো ক্রু। যাত্রী ৩৭৮০ জন। সকলেই প্রায় পর্যটক। ফ্রান্স, স্পেন হয়ে জাহাজ ফিরছিল আবার সাভোনার দিকেই।
১৩ জানুয়ারি রাত প্রায় ৯টা। আমাদের জাহাজটা ডুবন্ত পাহাড়ে ধাক্কা লেগে কাত হয়ে গিয়েছিল। জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে বেরিয়ে এলাম কেবিনের বাইরে। ভাগ্যিস ওটা পরেছিলাম। পকেটে ছিল মোবাইল। খুব কাজে লেগেছে। রাতে ফোন করেছিলাম বনগাঁর পাইপ রোডের বাড়িতে। বাইরে এসে দেখি, বাঁচার তাগিদে ডেকে তখন হাজার হাজার লোক হাতের কাছে যা পাচ্ছে, তা-ই আঁকড়ে ধরতে চাইছে। আর্ত চিৎকার চতুর্দিকে। বছর চারেক হয়ে গেল জলে জলে কাটছে। দৌড়ে চলে এলাম ইমার্জেন্সি স্টেশনে। এখান থেকেই লাইফবোটে তুলে নেওয়ার কথা যাত্রীদের। প্রাণ বাঁচাতে যাত্রীরা আমাদেরও ধাক্কাধাক্কি করছিলেন। ওঁদের বোঝাচ্ছিলাম, মারধর করবেন না। আমরা না থাকলে আপনাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ, আপনারা কেউ বোট চালাতেই পারেন না।
কোনও মতে বোটে ঠাসাঠাসি করে ১২০-২৫ জনকে তুলে নিলাম। এক মহিলা ছুটে এলেন। কোলে-কাঁখে দু’টো বাচ্চা। ছোটটার বয়স আমার দেড় মাসের ছেলের থেকে কয়েক মাস বেশি হবে। মহিলা বলছিলেন, ওঁদের বোটে তুলে নিতে। আমি বললাম, ফিরে এসে ঠিক তুলে নেব। কিন্তু এই আশায় কী মায়ের মন ভোলে। ভদ্রমহিলা বললেন, অন্তত বাচ্চা দু’টোকে যেন তুলে নিই। আমি সাত-পাঁচ না ভেবে ঝুঁকি নিয়েই তুলে নিলাম তিন জনকে।
আমাদের জাহাজে লাইফবোট ছিল ২৬টা। আমার বোটের নম্বর ২৭। কেন?
ইতালির লোক ১৩ সংখ্যাটাকে খুবই অশুভ বলে মনে করে। সে জন্য লাইফবোটে ওই ১৩ নম্বর ব্যবহারই করা হয় না। এই ঘটনার পরে মনে হয় ওদের সেই বিশ্বাস আরও বদ্ধমূল হবে। কারণ, আমাদের এই জাহাজ ডুবল তো সেই ১৩ তারিখেই! এত বিপদের মধ্যে একটাই আশার কথা, আমরা পাড় থেকে খুব বেশি দূরে ছিলাম না। মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। সকলকে নামিয়ে আমরা ফিরে এলাম জাহাজের কাছে। পর পর চার বার আমি জাহাজ থেকে লোক তুলে রেখে এলাম পাড়ে। আর পারছিলাম না। ঠান্ডায় মাংসপেশিতে টান ধরছিল। পাড়ের যে জায়গায় উঠেছিলাম, সেখানে লোকজন খুবই সাহায্য করেছেন। পরে আমাদের রোমের কাছে কসরিয়া লা পিনচিমিনা নামে একটা জায়গায় হোটেলে এনে তোলা হয়। জাহাজের কর্মীদের মধ্যে কল্যাণীর মিঠুন মণ্ডল এবং খিদিরপুরের এক যুবকও আছেন। এখানে খাবার, পোশাক দিয়েছে। কিন্তু আমি ১১ নম্বর জুতো পরি। সেই মাপের জুতো জোগাড় করতে পারেনি ওরা। পাসপোর্ট-ভিসা সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দেশে ফিরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় করতে হবে। ভারতীয় দূতাবাস থেকে যোগাযোগ করেছে আমাদের সঙ্গে। শুনলাম বাবা মহাকরণে গিয়েছেন।
টাইটানিক ছবিটা বাড়িতে বসে দেখেছি। বুঝতে পারিনি জাহাজডুবির অভিজ্ঞতা কী মারাত্মক, কী ভয়ঙ্কর হতে পারে। প্রায় দু’রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। মানুষের আর্তনাদ, প্রাণ বাঁচানোর জন্য উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটির দৃশ্য সবসময়ই ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

নিখোঁজ এক ভারতীয়
ইতালিয় প্রমোদতরী কোস্টা কনকর্ডিয়া বালির চরে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যাওয়ার ঘটনায় নিখোঁজ ১৫ জনের মধ্যে এক ভারতীয়ও রয়েছেন। নাম রেবেল্লো রাসেল টেরেন্স বলে জানিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ। রোমে ভারতীয় দূতাবাসের মুখপাত্র নেগি জানান, প্রমোদতরীটিতে ২০৩ জন ভারতীয় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক জন যাত্রী ও বাকি সবাই প্রমোদতরীটির কর্মচারী। ২০২ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাঁরা সকলেই সুস্থ আছেন বলে জানান নেগি। নিখোঁজ রেবেল্লোর হদিস পেতে ইতালির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে সেখানকার ভারতীয় দূতাবাস। ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন ইতালিতে ভারতীয় দূত দেবব্রত সাহা। দুর্ঘটনায় অনেকেরই পাসপোর্ট, ভিসা বা টাকা খোয়া গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে যাতে উদ্ধার হওয়া ভারতীয়দের দেশে ফিরতে অসুবিধা না হয় সে দিকে দূতাবাসগুলিকে বিশেষ নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কৃষ্ণ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.