কোল ইন্ডিয়া-র কয়লার দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে বিদ্যুতের মাসুল চলতি মাস থেকেই ইউনিটপিছু অন্তত দেড় টাকা বাড়ানো প্রয়োজন বলে রাজ্যের বিদ্যুৎ-কর্তাদের একাংশ মনে করছেন। তাঁদের দাবি, রাজ্য সরকার ‘বাঞ্ছিত’ এই মাসুলবৃদ্ধি আটকে দিলে মাস দুয়েকের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়বে। এবং সে ক্ষেত্রে সারা দিনে কতটুকু সময় গ্রাহকদের বিদ্যুৎ জোগানো যাবে, তার কোনও হিসেবই এখন কষে উঠতে পারছেন না তাঁরা। ওঁদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি তেমন দাঁড়ালে বিদ্যুতের অভাবে কল-কারখানাতেও উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
এমন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কেন?
ওই মহলের যুক্তি: রাজ্যের সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থা, অর্থাৎ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের মাথায় এখনই কয়লা বাবদ কোল ইন্ডিয়া’র কাছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা দেনা। উপরন্তু চলতি মাস থেকে যে হারে কয়লার দাম বেড়েছে, তাতে বকেয়ার বোঝা আরও বাড়বে। তখন প্রাপ্য মেটাতে না-পারলে কোল ইন্ডিয়া কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। ফলে তখন রাজ্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
বিদ্যুৎ-কর্তাদের অনেকের মতে, ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে কোল ইন্ডিয়া যখন কয়লার দাম বাড়িয়েছিল, তখনই ‘ফুয়েল সারচার্জ’ বাবদ বিদ্যুৎ-মাসুল কিছুটা বাড়ানো জরুরি ছিল। কিন্তু তার পরে রাজ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়। এ দিকে নতুন বছরের শুরুতে ফের কয়লার দাম বাড়ল। এই দু’দফা বৃদ্ধি ধরে জ্বালানি খরচের হিসেব কষে বিদ্যুৎ-কর্তারা এখন মনে করছেন, চলতি মাস থেকে ইউনিটে ১ টাকা ৫০ পয়সা মাসুল না-বাড়ালে নিগম তো ডুববেই, পাশাপাশি নিগমের জোগানে টান পড়লে বাজার থেকে চড়া দামে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের সস্তায় দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠবে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থারও। |
নিগমের উৎপাদন এখন গড়ে দৈনিক ২,৫০০-২,৬০০ মেগাওয়াট। এ জন্য নিগমকে কোল ইন্ডিয়া থেকে মাসে ৩০০-৩৩০ কোটি টাকার কয়লা কিনতে হয়। কয়লার মূল্যবৃদ্ধির পরে একই হারে উৎপাদন চালাতে হলে নিগমকে প্রতি মাসে আরও প্রায় দেড়শো কোটি টাকার সংস্থান করতে হবে। “কিন্তু মাসুল না-বাড়ালে তা কোথা থেকে আসবে?” প্রশ্ন তুলছেন নিগম-কর্তারা। এক কর্তার মন্তব্য, “এখন বিদ্যুৎ বেচে যা আয় হয়, বিভিন্ন খরচ ও ব্যাঙ্ক-ঋণের কিস্তি মেটানোর পরে বাকিটা কোল ইন্ডিয়া-কে দিতেই তো শেষ! মাসুল না-বাড়লে বাড়তি দামে কয়লা কিনতে গিয়ে খরচের বহর বাড়বে। তখন ব্যাঙ্কও ঝুঁকি না-নিয়ে ঋণ বন্ধ করে দেবে। এই চলতে থাকলে আগামী অর্থবর্ষের মধ্যে নিগমের লোকসানের বহর দাঁড়াবে কম করে ১৮০০ কোটি টাকা।”
এ দিকে বিদ্যুৎ দফতরের এক সূত্রের দাবি: গত ফেব্রুয়ারির মূল্যবৃদ্ধির সময়ে উচ্চমানের কয়লার দাম দ্বিগুণ করেছিল কোল ইন্ডিয়া। এ বার উচ্চমানের কয়লার দাম তেমন না-বাড়লেও দু’দফা মিলিয়ে গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ৬০%-৭০%। রাজ্যের বিদ্যুৎ-শিল্পমহলের একাংশের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের প্রতিটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সাধারণত নিম্ন ও মধ্যমানের কয়লার সঙ্গে সামান্য উচ্চমানের কয়লা মিশিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। অথচ কোল ইন্ডিয়া’র নতুন নিয়মে মধ্যমানের কয়লার দরই বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
যার জেরে পশ্চিমবঙ্গের মতো অন্যান্য রাজ্যের বিদ্যুৎসংস্থাগুলোরও মাথায় হাত। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্যুৎ-প্রশাসনের একটা বড় অংশ মনে করছে, কয়লার দাম যাতে না-বাড়ে, সে জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া সুরাহার অন্য পথ নেই। এবং এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বড় ভূমিকা নিতে পারেন বলে তাদের অভিমত। এই মহলের যুক্তি, খুচরোয় বিদেশি লগ্নি থেকে লোকপাল সম্প্রতি একাধিক বিষয়ে তৃণমূলনেত্রী কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। কয়লার দামের ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
কোল ইন্ডিয়া’র সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ-মামলা দায়ের করেছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। রাজ্য সরকারকেও তাতে যুক্ত করা হয়েছে। বিচারপতি পিনাকী ঘোষ ও বিচারপতি মৃণালকান্তি চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চে বুধবার মামলাটির শুনানি হয়। কোন নীতিতে কয়লার দাম বাড়ানো হল, সে সম্পর্কে কোল ইন্ডিয়া’র হলফনামা চেয়েছে বেঞ্চ। সুভাষবাবুকেও একটি অতিরিক্ত হলফনামা দিতে বলা হয়েছে। |