বরং টিকিট বিক্রি করলেই বোঝা যায়, সত্যিই কত মানুষ নাট্যমুখী হয়েছেন।
বাংলা নাটক এবং তার বিপণন নিয়ে লিখছেন
কৌশিক সেন |
বিশিষ্ট নাট্যনির্দেশক শ্রীবিভাস চক্রবর্তী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন ‘সাম্প্রতিক বাংলা থিয়েটার’-এর সম্পর্কে। (‘আইস, আমরা কমার্শিয়াল হই’ ২২-১২) বাংলা থিয়েটারে বিভাসবাবুর অনন্য কীর্তির কথা স্মরণে রেখে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সকলের মতোই তিনিও এই প্রবীণ বয়সে, সজীব ও সজাগ থেকে খুঁজে পেতে চাইছেন সেই ‘পথ’, যে পথে চললে একটি কমবয়সি ছেলে বা মেয়ে আমাদের থিয়েটারের আঙিনায় আসতে আগ্রহী হবেন শিল্পী অথবা এক রসজ্ঞ দর্শক হিসেবে। খুব যেমন-তেমন করে নাট্য প্রযোজনা করতে গেলেও যে অর্থের প্রয়োজন, তা আসবে কী উপায়ে? ‘রাষ্ট্রের ভর্তুকি’-‘কর্পোরেট অনুদান’-‘মিডিয়ার সাহায্য’-‘টিকিট বিক্রি’-‘আমন্ত্রিত অভিনয়’-‘নামী-দামি শিল্পী’-‘নাট্যবস্তু’ এই সব হতে পারে আলোচনার বিষয়। তবু নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, আমাদের এই অন্য ধারার ‘নাট্যচর্চা’ নানান টানাপড়েনে, চূড়ান্ত অর্থাভাব নিয়েও কমবেশি সাফল্য-অসাফল্যের মধ্যে দিয়ে আজও সে সচল। তার অন্যতম কারণ, বিভিন্ন টালমাটাল ‘সময়’-এর মাঝে ‘থিয়েটার’ আমাকে এমন একটা স্পেস দেয়, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি আমার মতো করে ‘সময়’-এর মুখোমুখি হতে পারি। ৫০০ অথবা ৭০০ পেরনো ‘মারীচ সংবাদ’ কিংবা ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ থেকে ২০০ রজনী পার হতে-না-পারা (বিভাসবাবুর নিপুণ তথ্য অনুসারে) ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ বা ‘রুদ্ধসংগীত’ পর্যন্ত যে নির্মাণের ইতিবৃত্ত, তার শ্রম ও নিষ্ঠার পিছনে একই তাগিদ ‘সময়’কে প্রকাশ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। দিনে তারা দেখার জন্যও বড় মাপের স্বপ্ন দেখতে জানতে হয়। সেটা অবাস্তবও নয় মনে পড়ে: ‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে’।
বিভাসবাবু মনে করেন ‘অন্য ধারার নাট্যচর্চা’ করা এই আমরাই এখন ‘বনরাজ্যে শেয়ালরাজা’ যেহেতু সাধারণ রঙ্গালয় নেই, অফিস-ক্লাব নেই, গণনাট্য সংঘ ক্ষীণতোয়া, ওয়ানওয়াল বন্ধ সুতরাং... প্রথমত এই বনরাজ্যে বাংলা নাটককে ‘একমাত্র’ হওয়ার কারণেই সামনাসামনি হতে হচ্ছে একশোটি রঙ-বেরঙের টেলিভিশন চ্যানেলের, বছরভর নানান নিত্য-নতুন বিনোদনের সঙ্গে লড়াই করে দর্শককে টেনে আনতে হচ্ছে প্রেক্ষাগৃহে, অথচ এ এমন এক শিল্পমাধ্যম, যার কোনও ‘রেপ্লিকা’ হয় না, এর কোনও ‘রি-সেল’ ভ্যালু নেই একে টিকে থাকতে গেলে প্রতিনিয়ত নানান পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে চলতে হবে, খুঁজে দেখতে হবে নানান সম্ভাবনা। তা-ও টেলিভিশনের ঘেরাটোপ ছেড়ে মানুষ আসছেন নাটক দেখতে মনে রাখা প্রয়োজন, গত দশ বছরে বাংলায় স্কুল ছাত্রছাত্রীদের থিয়েটার করার আগ্রহ দারুণ বেড়েছে (নান্দীকার সহ বিভিন্ন নাট্যদল ও প্রয়াত রমাপ্রসাদ বণিকের নাম এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়)। ৩১ ডিসেম্বর এই ‘বনরাজ্য’ যখন নানান হুল্লোড়ে মেতে উঠে স্বাগত জানায় নতুন বছরকে, তখন বিভাসবাবুর নাট্যদলের আয়োজনে রবীন্দ্রসদনে সারা রাত্রিব্যাপী নাট্য উৎসব দেখতে প্রেক্ষাগৃহ থাকে পূর্ণ এবং কী আশ্চর্য! তাঁরা টিকিট কেটেই আসেন। তাঁরা সকলেই কি ‘খদ্দের’? ‘বিনিপয়সার’ দর্শক মানেই নিশ্চয়ই লঘু চরিত্রের নয়, তেমনি টিকিট কাটা মানেই সেই দর্শকদের সঙ্গে সম্পর্ক নিছকই ‘পাওনা-গন্ডার’?
বছরে একটি মাত্র নাট্য-উৎসবে বিনামূল্যে টিকিট বিতরণ করলেই মানুষ ‘নাট্যমুখী’ হয়ে উঠবেন? বরং টিকিট বিক্রয় করলেই ঠিক ভাবে বোঝা যেত ‘সত্যি-সত্যি’ কত মানুষ নাট্যমুখী হয়েছেন। ‘মিডিয়া’র কিছু ‘অকিঞ্চিৎকর’ নাটক ও প্রযোজনা নিয়ে মাতামাতি (বিভাসবাবুর ভাষায়) করাটাও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ আমার দর্শকদের ওপর আস্থা আছে তাঁরা বুদ্ধিমান, ভাল-মন্দের প্রভেদ বোঝেন এবং অনেক সময় আমাদের বাংলা থিয়েটারের প্রবীণ গুণিজনদের প্রশংসাবাক্য এমন সব নাটকের প্রতি ধাবিত হয়েছে, যা আগ্রহ নিয়ে দেখতে গিয়ে হতাশ হয়েছি। সুতরাং, ‘ভাল মন্দ’ ব্যাপারটি বড়ই গোলমেলে।
আমাদের নাট্যদল ‘স্বপ্নসন্ধানী’তে একটি ছাত্র-সদস্য থিয়েটার করতে আসে হরিপাল থেকে। মাঝে মাঝেই সে তার বাবাকে খেতের কাজে সাহায্য করে বলে দলে আসতে পারে না, ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছেলেটি দারুণ প্রতিভাবান। ওকে বা ওর মতো আরও অনেক তরুণ সদস্যের হাতে মাঝে মাঝে দল যে টাকাটা তুলে দিতে পারে, সেটা বড় নগণ্য। আমি দিনে তারা দেখার মতোই স্বপ্ন দেখি যে, ওদের মতো টগবগে ছেলেমেয়েরা থিয়েটার থেকে একটা সম্মানজনক প্রাপ্য পাচ্ছে। এটাকে সত্যি করার জন্য সমস্ত রাস্তাগুলিই খোলা রাখতে হবে। ‘যুগান্তকারী’ বাংলা প্রযোজনার কপালে ‘কোনও সরকারি গ্রান্ট বা সুযোগসুবিধা জোটেনি’র পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করলে নবীন প্রজন্ম আর আমাদের ক্ষমা করবে না। এই শহরে এক কাপ গরম কফির দাম ৬০ টাকা, আর বাংলা নাটকের সর্বাধিক টিকিটের মূল্যও ৬০ টাকা (এর বেশি হলেই কর দিতে হবে), তা-ও যদি বিনামূল্যে বিতরণ করে লোক টানতে হয়, তেমন নাট্য-উৎসবের সার্থকতা কী?
শেষে জানাই, গ্রান্ট (সরকারি বা বেসরকারি) যদি কোনও দিন বন্ধ হয়ে যায়, তা হলেও নাট্যচর্চা বন্ধ হবে না, তা তখন হবে ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভাবনায় আলোকিত হয়ে। থিয়েটার করতে মাত্র দু’জনকে প্রয়োজন হয়: ‘এক জন অভিনেতা, এক জন দর্শক’। তেমন দিন এলে এ ভাবেও হবে নাট্যচর্চা। |