প্রবন্ধ ১...
স্মৃতির দুর্মর দলিল
খনও কেবল টিভি আসেনি। জানা গেল, মাছের কাঁটার মতো একটা এক্সট্রা অ্যান্টেনা লাগালে বাংলাদেশ টিভি-ও দেখা যাবে। এ দেশে তখনও বাংলা মেগা চালু হয়নি, সংগীতানুষ্ঠান বলতে দূরদর্শনে আজও যা, তখনও তাই। ফলে আমরা খুব মন দিয়ে ওপারের টেলিনাটক ও মিউজিক ভিডিয়ো দেখতে থাকি। ’৪৭ থেকে সেই দিন তক যারা ও পার থেকে আমাদের পাড়ায় এসে পড়েছে, কখনও ফিরে দেখে আসব ভাবে ভিটের আমগাছখানি, কারও ঘরবাড়ি অধিকৃত হয়ে বানানো হয়েছে পোর্ট, সান্ধ্যকালীন বাংলাদেশ টিভি চ্যানেলে একযোগে সব্বার মোক্ষপ্রাপ্তি হতে থাকে। আর আমাদের শৈশবকালে বাঙাল টানটোন অতিরিক্ত একটিই ভাব এসে পৌঁছয়। মুক্তিযুদ্ধ। রম্য অনুষ্ঠান শেষে অদ্ভুত আকুতিভরা কণ্ঠ ভেসে আসত রোজ, পেছনে শহিদমিনারে লাল বলওয়ালা ঘন সবুজ পতাকা কাঁপত,
‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না
আমি গাইব বিজয়ের গান
ওরা আসবে চুপি চুপি
যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।’

বিপ বিপ কাউন্টডাউনে খবর শুরু হত। কিন্তু, খবর কে-ই বা শোনে।
সেই সব দিন। রুশ বইয়ের পাতা ওল্টালেই যখন যৌথ খামার, বাংলাদেশ টিভি খুললেই মুক্তিযুদ্ধ। তার মধ্যে বই খুলে চৌরিচৌরার ঘটনা মুখস্থ করতে কান্না পেয়ে যেত। আমরা বরং মন দিয়ে দেখতাম ঘাটলায় মেয়েটি গাইছে,
‘আমি ডুব সাঁতারে পদ্মাপাড়ি দেব শুনে
সবাই বলে দস্যি মেয়ে
একাত্তরে ভাইয়া যে তোর গেছে অমনি করে।’

দিদু জানি কাকে ফিস ফিস করে বলল, জবার মতো লাগে, না? আমরা জানতাম এই মেয়েটার মতো জবার ভাইও বন্ধুদের সঙ্গে খালি পায়ে দেশ স্বাধীন করতে গিয়েছিল জয় বাংলা বলে। জানতাম একাত্তরে ও পারের গ্রাম থেকে এ পারে পৌঁছতে জবা পাগল হয়ে গিয়েছিল। তত দিনে আমরা টিভি মারফত জেনে গেছি খানসেনা, জেনে গেছি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চার অক্ষর ‘রাজাকার’।

হয় না, হঠাৎ করে ইতিহাসের আলো আমাদের আলগোছে সরে থাকার প্রবণতা চূর্ণ করে দেয়। তেমনি গিনসবার্গের কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যেসোর রোড’ ও তার মৌসুমী ভৌমিক কৃত অনুবাদ গায়ন আমাদের শৈশব-কৈশোরের যশোর রোড সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগনাতে মুক্তিযুদ্ধের দূরবর্তী নস্টালজিয়া ছাড়িয়ে তার ক্লেশ-যাতনা-ক্রোধ-নিষ্ফলতার আত্মা বের করে দেয়। ঘোর ভাঙে। ঘুরে দেখি, প্রতিটি পরিবার ইতিহাসঋদ্ধ, সবাক। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তরে বদলে গেছে যশোর রোড ধরে ও পার থেকে এ পারে চলন। এ বার শুধু দেশ কোথায় বললে, বিক্রমপুর কি চট্টগ্রাম বলে কুলোচ্ছে না, বরং একাত্তরের অসামান্য গৃহচ্যুতি ও চূড়ান্ত ক্লেশ-অবমাননায় স্পষ্ট ও উড্ডীন থেকেছে একটি ভবিষ্যৎ জয় বাংলা উচ্চারণে। এক কোটি মানুষের একারণ বাস্তুচ্যুতি ও প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিদ্ধ যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে ছাপিয়ে থাকে বাংলা ভাষায় কথা বলে এমন একটি রাষ্ট্রকল্পনা, যা শুধু রাষ্ট্রই নয়, একটি বিশুদ্ধ আবেগ। আমাদের পাড়ার মুক্তি ও তার মামাতো বোন স্বীকৃতি, দু’জনের জন্ম এ পারে। তাদের পরিবার গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে পার হয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের নামে মুক্তি। যে দিন রাষ্ট্রপুঞ্জ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল, সেই দিনে জন্মানোয় বোনের নাম স্বীকৃতি। ফলত, এ ওদের দেশ, আমরা ছেড়ে এলাম এ বার নিজেদের দেশে একাত্তরে এমনটি নয়। একটু ব্যাপক দেখলে, বহুধাবিভক্ত ও পরস্পরঋদ্ধ জটিল ভারতীয়ত্বে শামিল হয়েও বাংলা ভাষায় ‘আ মরি’ বলে দুলে ওঠা তো আমাদেরই। সে কি আমাদের জাতিরাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে আত্মপরিচয়ের সন্ধান? একদা বিচ্যুত ভূমিভাগের প্রতি লেগে থাকা অনপনেয় দুর্মর মমতা?
শেখ মুজিবের সেই অমোঘ উচ্চারণ ‘সাত কোটি বাঙালিকে তোমরা দাবায়ে রাখতে পারবা না’ শুনে আমরা কতই না উদ্বেল হয়ে উঠেছি, যুদ্ধে না গেলেও। না কি, লিয়ার লেভিনের ফুটেজ, যা কিনা তারেক মাসুদ তাঁর ‘মুক্তির গান’ ছবিতে ব্যবহার করেছেন ঘরছাড়া মানুষের বিপন্নতার ও মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে, তার সামনে দাঁড়িয়ে সে বাঙালি না উর্দুভাষী, এই সব আত্ম-পরের নির্দিষ্টতা ভুলে শিউরে ওঠা যে, নগ্ন নির্লজ্জ উৎকট ক্ষমতা কী ভাবে মানবতাকে টুঁটি টিপে জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে মারে!

বিলম্বিত। যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিতে। ঢাকা, ডিসেম্বর ’১১। ছবি: এ এফ পি
একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়ের কারণ খুঁজতে জুলফিকার আলি ভুট্টোর নির্দেশে গঠিত হয় হামুদুর রহমান কমিশন। তার রিপোর্টে ধরা পড়ে গণহত্যার বিপুল ছবি, আর্মির নৈতিক অধঃপতনের, ক্ষমতালিপ্সার ভয়াবহ উদাহরণ, রিপোর্ট প্রকাশ হয় না ফলত। পরে তার সম্পূরক অংশটি প্রকাশ পেলে দেখা যায়, যতই সরকার-ঘেঁষা হোক প্রতিবেদন, যাতে মুক্তিযুদ্ধকে এক কথায় নৃশংস বলে প্রমাণের চেষ্টা চলুক, পুরো ১৯৭১ জুড়ে অত্যাচার, গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের যে অধ্যায় চলে একটি জাতির স্বাধীনতাকামী প্রচেষ্টাকে থেঁতলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমত নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিরল। গণহত্যায় একটি জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচারের মাত্রাটি বোঝা যায় তো বটেই, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নির্বাচিত হত্যায় একটি প্রজন্মের মেধার অনুশীলনকে স্থগিত ও শূন্য করে দেওয়া হল, তার পূরণ অতীব আয়াসসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ।

ঢাকায় পৌঁছে দেখি উত্তাল। জামাত-এ-ইসলামির নেতা দেলওয়ার হোসেন সয়েদি-র বিচার চলছে। অপরাধ, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা ইত্যাদি মানবাধিকারী উল্লঙ্ঘনকারী কার্যকলাপ। এই বিরল ঐতিহাসিক মুহূর্তে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, আইনপ্রণেতা থেকে সাধারণ মানুষ, সকলের মনোযোগ মামলার গতিপ্রকৃতির দিকে। বিরল ও ঐতিহাসিক। কেননা, না পাকিস্তানি সেনা, না তাদের সঙ্গে হাত মেলানো দেশি দালাল ‘রাজাকার’, কারও ক্রিয়াকলাপই কাঠগড়ায় ওঠেনি আজ পর্যন্ত, অপরাধ হিসেবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পর যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে আইনের পথে চিন্তাভাবনা হয়নি। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিচার উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট নামে একটি আইন প্রণয়ন হলেও, ১৯৭৫-এ সামরিক অভ্যুত্থানে যেই আওয়ামি লিগের ক্ষমতা শেষ হয়, গণহত্যার বিচারও স্থগিত হয়ে যায়। এর মধ্যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দেশে ফিরে যায়, স্থানীয় রাজাকাররা পাইকারি মার্জনা পেয়ে যায়। বাংলাদেশ সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ-এর তৎকালীন প্রধান আহমেদ জিয়াউদ্দিন ২০০১-এ বলেছিলেন, গণহত্যার বিচার না হলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য, নির্যাতনের ইতিহাস নিষ্কাশিত হবে না, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দিয়ে যাওয়া যাবে না হিসাব। কিন্তু বাংলাদেশের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বিচারের দাবি সরব হতে হতে এসে গিয়েছিল ১৯৯০। জাহানারা ইমাম গড়ে তুলেছিলেন ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অঙ্গীকার, দেশের প্রতি ভালবাসা এবং যুদ্ধপরাধীদের বিচার করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে’। রাজাকারদের তালিকা নির্মাণ ও বিচারের আওতায় আনা আসলে ন্যায় ও সত্যের কথা বলা, এই ছিল এদের অভিপ্রায়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রায় এই সময় থেকেই মুক্তিযুদ্ধকালীন যাবতীয় নথি-তথ্যাদির একটি ব্যাপক সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বললেন, এই বিচার গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সরকারি তরফে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হল, এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনা নির্দেশিত গণহত্যা, অত্যাচার, ধর্ষণকে ধরা হল মানবাধিকারবিরোধী কার্যকলাপ হিসেবে। দ্বিতীয়ত, পুরো বিচার প্রক্রিয়াটিই ঘটেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিজস্ব বিচারব্যবস্থায়। যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে কোনও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়নি। তিনি এও বললেন যে, এ বার এই দৃষ্টান্তের অনুসরণে পাকিস্তানেরও ফিরে দেখা উচিত ১৯৭১-কে এবং পাক সেনানায়কদের বিচারের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। খুলে দেওয়া উচিত তাদের শাসনকালের নথি দিয়ে তৈরি আর্কাইভও।

বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলন এ কালের সবচেয়ে অ-নথিভুক্ত আন্দোলন। ১৯৯৯-তে পর্যন্ত বধ্যভূমি খুঁজে পায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মিরপুরে মুসলিমবাজারে। তারই সংগ্রহ, হাড়, খুলি, জামা-জুতোর টুকরো, চুড়ি, দাঁত, চুলের বেণী, বাচ্চাদের জুতো, সেনাদের জুতো, তার পর মুক্তিবাহিনীর ছেঁড়া ন্যাকড়ার জুতো দেখতে গিয়ে মনে পড়ল শৈশবের টিভি। মুক্তিযুদ্ধ তত দিনে অতীত, কিন্তু ও পারের সম্প্রচারে তার কথা ও ছবি অবিরত।
এক কালে মনে হত, পুরো জাতি নস্টালজিয়ায় ভুগছে। আজ মনে হল, যখন শাসক তার শাসনের চিহ্ন লোপাট করে দেয়, স্মৃতিভ্রংশ করে দেয়, তথ্য হারিয়ে দেয় মাটির গভীরে শব পুঁতে, তখন একটা জাতি আর কী করে শোধ করে আত্মোৎসর্গের ঋণ? আখ্যান রচনা ছাড়া? যাতে যা মুখে মুখে প্রবাহিত, দলিলের অতীত, যেন তা বিস্মৃত না হই।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.